Home ইসলাম সোনালি যুগে মুসলমানদের বিজয় রহস্য

সোনালি যুগে মুসলমানদের বিজয় রহস্য

।। মুফতি মাহমুদ হাসান ।।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা দুর্বল হয়ো না এবং দুঃখিত হয়ো না, তোমরাই বিজয়ী—যদি মুমিন হয়ে থাকো। ’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত- ১৩৯)।

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদের এই মর্মে ওয়াদা দিয়েছেন যে তিনি নিশ্চিতভাবে তাদের জমিনের প্রতিনিধিত্ব প্রদান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব প্রদান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদের এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য শক্তিশালী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দ্বিনকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তিনি তাদের ভয়ভীতি শান্তি-নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা আমারই ইবাদত করবে, আমার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করবে না। আর এরপর যারা অস্বীকার করবে তারাই ফাসিক’। (সুরা নূর, আয়াত- ৫৫)।

কোরআনুল কারিমের এই শাশ্বত বাণীর বাস্তবতা ও সত্যতা ফুটে উঠেছে অনেক অমুসলিম নেতা ও বড় বড় মনীষীর মুখ থেকেও, যাঁরা কখনো কোরআন ছুঁয়েও দেখেননি। আমরা ইতিহাসের পাতা থেকে এমন কিছু উদাহরণ এখানে উপস্থাপন করছি, যেগুলোর মধ্যে অমুসলিম মনীষীরা মুসলিমদের ঈমান ও আমলের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেছেন এবং এটিকেই মুসলিমদের শক্তির উৎস ও তাদের বিজয়ের রহস্য বলে অভিহিত করেছেন।

রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের স্বীকারোক্তি

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবিদের বিজয়ের ধারাবাহিকতা ও রোম সেনাদের পরাজয়ের চিত্র দেখে রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াস তাঁর বাহিনীপ্রধানদের লক্ষ্য করে বললেন : তোমাদের বিনাশ হোক! তোমরা যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বারবার পরাজিত হচ্ছ, তারা কি তোমাদের মতো মানুষ নয়? তারা বলল, অবশ্যই। সম্রাট বললেন, সংখ্যায় তারা বেশি, নাকি তোমরা? তারা বলল, সব যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা বেশি ছিলাম।

সম্রাট বলেন, তাহলে তোমরা বারবার পরাজিত হচ্ছ কেন? তখন তাদের বয়োবৃদ্ধ এক সেনা কর্মকর্তা বলল, কারণ তারা রাতে দাঁড়িয়ে ইবাদত করে আর দিনের বেলা রোজা রাখে, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে, সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজ থেকে বাধা দেয়, একে অন্যের প্রতি ইনসাফ করে। আর এর বিপরীতে আমরা মদ পান করি, ব্যভিচার করি, অন্যায় করি, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করি, জুলুম করি, আল্লাহর সন্তুষ্টির কাজ থেকে মানুষদের বিরত রাখি এবং জমিনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করি’। তখন সম্রাট হেরাক্লিয়াস বললেন, তুমি আমাকে সত্য বলেছ। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ৭/২০)।

অন্য একটি ঘটনা এরূপ বর্ণিত হয়েছে যে রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াস তাঁর নগরী শাম থেকে পরাজিত হয়ে অবশেষে কনস্টান্টিনোপলে গিয়ে অবস্থান করলেন এবং সেখানে রাজত্ব গড়ে তুললেন। একদা তাঁর এক অনুচর মুসলিমদের বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে তাঁর কাছে গেলে তিনি বললেন, এই জাতি সম্পর্কে তুমি আমাকে কিছু বলো। ওই ব্যক্তি বলল, আমি তাদের এমন বিবরণ দেব, যেন আপনি তাদের স্বচক্ষে দেখছেন—তারা দিনের বেলা অশ্বারোহী বীর আর রাতের অন্ধকারে দুনিয়াত্যাগী ইবাদতগোজার, জিনিসের মূল্য পরিশোধ করেই তারা ভোগ করে, সালাম দিয়ে প্রবেশ করে, যুদ্ধের ময়দানে অবিচল। সম্রাট হেরাক্লিয়াস তা শুনে বললেন, যদি তুমি সত্য বলে থাকো, তাহলে তো তারা আমার পদতলের এই জায়গাটুকুও দখল করে নেবে। ’ (তারিখে তাবারি- ৩/৬০৩, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ৭/৬২)

জনৈক খ্রিস্টান পুরোহিতের স্পষ্ট ভাষণ

এক বর্ণনায় এসেছে, সাহাবায়ে কেরামের ধারাবাহিক বিজয় ও রোম সেনাদের পরাজয়ের চিত্র দেখে রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াস তাঁর সভাসদদের সামনে এর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তখন জনৈক পুরোহিত তাঁকে বলল : হে মহামান্য সম্রাট! এর কারণ হলো, আমাদের জাতি তাদের দ্বিন-ধর্মকে পরিবর্তন করে ফেলেছে, ঈসা (আ.)-এর অনুসরণ ছেড়ে দিয়েছে, পরস্পর জুলুমে লিপ্ত, এ জাতির মধ্যে এমন কেউ নেই যে সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বাধা দেবে, এ জাতির মধ্যে কোনো ন্যায়-ইনসাফ ও দয়া নেই, ইবাদত-বন্দেগি করে না, নামাজের সময় বিনষ্ট করে, সুদ গ্রহণ করে, ব্যভিচারে লিপ্ত এবং এদের মধ্যে গুনাহ ও অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়েছে।

আর এই আরবরা তাদের প্রভুর আদেশ মান্যকারী, তাদের দ্বিনের অনুসারী, তারা রাতে দুনিয়াত্যাগী ইবাদতগোজার আর দিনের বেলা রোজাদার, তাদের রবের জিকিরে এবং তাদের নবীর ওপর দরুদ পাঠে তারা গাফিল হয় না, আর তাদের মধ্যে কোনো জুলুম-অবিচার নেই, তারা একে অন্যের ওপর অহংকার করে না। তাদের বৈশিষ্ট্য হলো সততা, আর তাদের পোশাক হলো ইবাদত। তারা আমাদের ওপর আক্রমণ করলে ফিরে যায় না, আর আমরা আক্রমণ করলে পালায় না। তাদের বিশ্বাস হলো, দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী আর আখিরাত চিরস্থায়ী। ’ (ফুতুহুশ শাম, ওয়াকেদি- ১/১৪৯)।

পাদ্রির কাছে গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং পাদ্রির অভিব্যক্তি

যখন সাহাবায়ে কেরাম জর্দানের নিকটবর্তী এলাকায় অবতরণ করলেন, তখন দামেস্কের জনৈক পাদ্রি তাঁদের খবর সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে দুজন আরবিভাষী খ্রিস্টানকে গুপ্তচর হিসেবে পাঠালেন। তারা দুজন গিয়ে সাহাবায়ে কেরামের দিন-রাতের অবস্থাদি পর্যবেক্ষণ করে ফিরে এসে বলল, আমি কিছু প্রখর লোকের কাছ থেকে এসেছি, যারা উত্তম ঘোড়ায় আরোহণ করে, রাতের অন্ধকারে তারা দুনিয়াত্যাগী ইবাদতগোজার, আর দিনের বেলা অশ্বারোহী বীর, তীরের পালক লাগাচ্ছে এবং বর্শা ধার দিচ্ছে। আপনি যদি পাশের লোকের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের কোরআন তিলাওয়াত ও জিকিরের আওয়াজের কারণে তারা তা শুনবে না। তখন ওই পাদ্রি তাঁর সহচরদের লক্ষ্য করে বলেন, তোমাদের কাছে এমন এক জাতি এসে পৌঁছেছে, যাদের মোকাবেলা করার শক্তি তোমাদের নেই। ’ (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ৭/২০)।

আরও পড়তে পারেন-

মুসলমানদের ব্যাপারে চীন সম্রাটের অভিব্যক্তি

পারস্য সম্রাট কিসরা যখন পরাজিত হয়ে দূরদেশে পালিয়ে গিয়ে ভগ্নহৃদয়ে তাঁর কয়েকজন সহচরের সঙ্গে তাঁর করণীয় বিষয়ে পরামর্শ করছিলেন, সম্রাটের ইচ্ছা ছিল যে চীন সম্রাটের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তাঁর থেকে সৈন্য-সামন্ত ও সাহায্য নিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করবেন। তখন জনৈক বুদ্ধিমান সহচর তাঁকে এই পরামর্শ দিল যে আপনি তা না করে বরং এই আরব লোকগুলোর মধ্যে দ্বিনদারি ও বিশ্বস্ততা আছে, আপনি চাইলে তাদের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে স্বচ্ছন্দে এখানে তাদের পার্শ্ববর্তী দেশে বসবাস করতে পারেন। কিন্তু কিসরার এই পরামর্শ পছন্দ হয়নি।

তাই তিনি চীন সম্রাটের কাছে দূত পাঠিয়ে সাহায্যের আবেদন করলেন। তখন চীন সম্রাট ওই দূতের কাছে বিশ্বজয়ী মুসলমানদের সম্পর্কে খবরাখবর নিলেন। তখন ওই দূত তাঁকে মুসলিমদের নামাজ, ইবাদত, যুদ্ধ, অশ্বারোহণসহ বিস্তারিত বর্ণনা করলেন। চীন সম্রাট সব খবর শুনে কিসরার কাছে এই মর্মে লিখে পাঠালেন— “আমি আপনার কাছে এমন বিশাল সৈন্যবহর পাঠাতেও আপত্তি নেই, যার শুরু হবে ‘মারব’ আর শেষ প্রান্ত হবে চীনে, কিন্তু এ জাতি যার বিবরণ আপনার প্রেরিত দূত আমাকে দিয়েছে, যত দিন তারা এই গুণে গুণান্বিত থাকবে যার বর্ণনা আমি দূত থেকে শুনেছি, তারা যদি পর্বতের সঙ্গেও টক্কর দেয় তাহলে তা-ও বিচূর্ণ হয়ে যাবে, আমি যদি আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসি তারা আমাকেও নিশ্চিহ্ন করে দেবে। অতএব, কল্যাণ এতেই আছে যে আপনি তাদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে নিরাপদে থাকুন। ’ কিন্তু কিসরা তা না করে কুল-কিনারা না পেয়ে দেশে দেশে পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন। এর দুই বছর পর তিনি নিহত হন। (তারিখে তাবারি : ৪/১৭২, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ৭/১৪৫)।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।