Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ ‘যুদ্ধের নায়ক’ থেকে পলাতক রাষ্ট্রপতি: রাজাপাকসেদের যেভাবে উত্থান-পতন

‘যুদ্ধের নায়ক’ থেকে পলাতক রাষ্ট্রপতি: রাজাপাকসেদের যেভাবে উত্থান-পতন

রিয়া মোগুল (সিএনএন): একসময় তাদেরকে জাতির নায়ক হিসেবে দেখা হতো; সম্মান করা হতো রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পরাজিতকারী ‘যুদ্ধ-নায়ক’ হিসেবে। কিন্তু, শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে রাজবংশের গল্পের শেষপ্রান্তে এসে এর বিপরীত চিত্রই দেখা যাচ্ছে।

কয়েকদিন আগেই দেশটির হাজারো বিক্ষোভকারী প্রেসিডেন্ট ভবন দখলে নেয়। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের অবিলম্বে পদত্যাগের দাবি জানায় তারা। রাজাপাকসে যদিও বুধবার (১৩ জুলাই) পদত্যাগ করবেন বলে জানিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন নি। বরং অস্থিতিশীল দেশটি থেকে পালিয়ে মালদ্বীপ চলে যান বিতর্কিত এই নেতা।

শ্রীলঙ্কার মানুষের জন্য গোতাবায়ার প্রস্থান একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।

একসময়ের জনপ্রিয় শাসকরা দেশটির নাগরিকদের বিশ্বাস হারানোর আগে গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে এই দ্বীপরাষ্ট্র শাসন করেছে।

ওডিআই গ্লোবালের ব্রিটিশ থিঙ্ক ট্যাঙ্কের সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট গণেশান ভিগনারাজা বলেন, “বিমান বাহিনীর বিমানে চড়ে শ্রীলঙ্কা থেকে গোতাবায়ার পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য এই পরিবারের পতনকে তুলে ধরে।”

আগামী ২৪ ঘণ্টায় যা ঘটবে তা দেশটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে বেশ বড় ভূমিকা রাখবে। তবে, রাজাপাকসের দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য এখনও অস্পষ্ট রয়ে গেছে।

রাজাপাকসের উত্থান

রাজাপাকসে পরিবারের মধ্যে গোতাবায়াই প্রথম সদস্য নন যিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তার মতোই যুদ্ধ-নায়ক হিসেবে বিবেচিত তার মাহিন্দা রাজাপাকসে ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

এর চার বছর পর, ২০০৯ সালে লিবারেশন টাইগারস অব তামিল এলম রেবেলসদের বিরুদ্ধে ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধে বিজয় ঘোষণা করার পর তিনি প্রায় কিংবদন্তি মর্যাদা অর্জন করেন।

এই বিজয়ের ফলে ১০ বছর ধরে দেশটির শীর্ষ নেতা হওয়ার সুযোগ পেয়ে যান মাহিন্দা। শ্রীলঙ্কার মানুষ একসময় তাকে ‘আপ্পাচ্চি’ বা জাতির পিতা হিসেবেও উল্লেখ করতো। তিনি হেঁটে গেলে লোকেরা তার সম্মানে মাথা নত করে রাখতেন বলেও জানা যায়।

মাহিন্দা রাজাপাকসে তার মেয়াদের বেশিরভাগ সময়ই সংসদকে একটি পারিবারিক ব্যবসার মতো করে চালিয়েছেন। নিজের ভাইদেরকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছেন।

গোতাবায় রাজাপাকসেকে প্রতিরক্ষা সচিব হিসেবে, বাসিল রাজাপাকসেকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন মন্ত্রী হিসেবে এবং সংসদের স্পিকার হিসেবে তিনি নিয়োগ দেন চামাল রাজাপাকসেকে।

সেসময় স্বজনপ্রীতি সম্পর্কে অভিযোগ উঠলেও রাজাপাকসে ভাইয়েরা ছিলেন মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। বিদেশ থেকে বড় অংকের ঋণ নিলেও, তারা আসার পর দেশটি বছরের পর বছর ধরে উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি দেখেছে। কিন্তু, সেই ভাল সময় বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।

কয়েক দিন আগে শ্রীলঙ্কার বিক্ষুব্ধ জনতা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ দখল করে নেয়।

সংক্ষিপ্ত বিরতির পর প্রত্যাবর্তন

যদিও শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ মাহিন্দা রাজাপাকসের কিংবদন্তি অবতার তৈরি করতে বড় ভূমিকা রাখে, এই একই ঘটনা থেকে তার পতনেরও শুরু।

২০১১ সালের জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, শ্রীলঙ্কার সরকারি সৈন্যরা বেসামরিক নাগরিকদেরকে নিজেদের ইচ্ছামতো গুলি করে হত্যা করা, মৃত্যুদণ্ড দেওয়া এবং ধর্ষণের জন্য দায়ী। এমনকি ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের কাছে খাদ্য ও ওষুধ পৌঁছাতে বাধাও দেয় তারা।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “কিছু বিশ্বাসযোগ্য সূত্রের অনুমান অনুযায়ী, তাদের হাতে প্রায় ৪০ হাজার বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হতে পারে।”

কিন্তু মাহিন্দা রাজাপাকসের সরকার বরাবরই এ ধরনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে, রাজাপাকসে সরকারের সমস্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে।

যুদ্ধ ছাপিয়ে এবার মানবাধিকারজনিত উদ্বেগ দেখা দেয় দেশের সংখ্যালঘুদেরকে ঘিরে। দেশটির বিরোধী দল মাহিন্দা রাজাপাকসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে যে তিনি অতি-ডানপন্থী বৌদ্ধ গোষ্ঠীগুলোকে নিরঙ্কুশ অনুমোদন দিয়েছেন। এতে করে শঙ্কিত হয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কার মুসলিম ও তামিল সংখ্যালঘুরা।

একই সময়ে অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়গুলো একটু একটু করে ধরা দিতে থাকে। দেশের প্রবৃদ্ধির জন্য সরকারকে যে চড়া ঋণ পরিশোধ করতে হবে, তা স্পষ্ট হয়ে যায়।

২০১৫ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার কাছে চীনের পাওনা ছিল ৮ বিলিয়ন ডলার। সেসময় শ্রীলঙ্কার সরকারি কর্মকর্তারা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, অপরিশোধিত বিদেশি ঋণ দেশটির জিডিপির ৯৪ শতাংশই গ্রাস করে ফেলবে।

আরও পড়তে পারেন-

সেবছর মাহিন্দা রাজাপাকসে তার একসময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হেরে যান।

“শ্রীলঙ্কা একটি গণতান্ত্রিক দেশ। স্বজনপ্রীতি এবং অর্থনীতির অব্যবস্থাপনার এই সমন্বয় দেখে জনগণ বিরক্ত ছিল যে তারা এই লোকদেরকে নেতা হিসেবে নির্বাচিত করেছে,” ভিগনারাজা বলছিলেন।

অন্যকোনো ছোট রাজবংশকে শেষ করার জন্য এই কারণ যথেষ্ট হতে পারে, কিন্তু রাজাপাকসাদের জন্য নয়।

২০১৯ সালের এপ্রিলে ইসলামিক জঙ্গিরা দেশটির গির্জা এবং বিলাসবহুল হোটেলগুলোতে একের পর এক বোমা হামলা চালায়। সেসব হামলায় কমপক্ষে ২৯০ জন নিহত হয়। আতঙ্কিত দেশের জনগণ আবারো ওই একই পরিবারের কাছে সাহায্য চায় যাদের একসময় জাতীয় নিরাপত্তার প্রমাণিত রেকর্ড ছিল।

ওই বছরের নভেম্বরে, গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তার ভাইয়ের মতো তিনিও শাসনকে পারিবারিক বিষয় হিসেবেই বিবেচনা করেন।

এক বছর পর পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে মাহিন্দা রাজাপাকসে বলেন, “জনগণ আবারও আমাদের প্রতি তাদের পূর্ণ আস্থা রেখেছে। আমরা তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করব এবং তারা আমাদের প্রতি যে আস্থা রেখেছেন তার সর্বদা মূল্য দেব।”

রাজাপাকসে পরিবারের পতন

মাহিন্দার মতোই গোতাবায়া রাজাপাকসের রাষ্ট্রপতিত্বে ফাটল দেখা দিতে শুরু করে। তার সময়ও সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন বাড়তে থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পূর্ণভাবে সরকারের দোষ ছিল না। কিন্তু পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে ধারাবাহিকভাবে সরকারের নেওয়া ভুল সিদ্ধান্তের কারণে।

একটি বিশাল ঘাটতির সম্মুখীন হয়ে রাজাপাকসে দেশটির অর্থনীতিকে উদ্দীপিত করার উদ্দেশ্যে কর কমিয়ে দেন।

কিন্তু এই পদক্ষেপটি দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। সেসময় সরকারি ঋণ পরিশোধের জন্য নিজেদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহার করতে হয় শ্রীলঙ্কাকে। এটি পরবর্তীতে জ্বালানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিকে প্রভাবিত করে, ফলে বাড়তে থাকে দাম।

রাজাপাকসেদের একসময়ের আরাধ্য জনসাধারণের বর্তমানে নিজেদের পরিবারকে খাওয়ানোর ক্ষমতা নেই। জ্বালানির অভাবে নিজেদের যানবাহন চালাতেও হিমশিম খান তারা। এখন মানুষকে জ্বালানির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়। অপেক্ষারত অবস্থায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয় প্রায়ই। এদিকে, সুপারমার্কেটের তাকগুলো খালি পড়ে আছে। ওষুধের সরবরাহ কমে আসছে বিপজ্জনকহারে।

আর এর জন্য তারা দোষারোপ করেছে রাজাপাকসেদেরকে। কয়েকমাস ধরে প্রতিকুল পরিস্থিতিতে জীবনযাপন করা ক্ষুব্ধ শ্রীলঙ্কানরা রাস্তায় নেমেছে।

প্রথমে এই বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হলেও মে মাসে তা সহিংস রূপ নেয়। এই বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়েন নি তার ভাই গোতাবায়া।

পদত্যাগ না করলেও শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। একসময় যে ভবনে তিনি থাকতেন সেখানে আজ বসতি গড়েছে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ।

তারই সুইমিংপুলে সাঁতার কাটছে তারা, তার রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে খাচ্ছে। এই দৃশ্যকে ভিগনারাজা একটি যুগের উপযুক্ত সমাপ্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

“একদা জাতির নায়ক হিসাবে বিবেচিত লোকেরা অকল্পনীয়ভাবে এখন নিজের বাড়ি থেকেই বিতাড়িত। সিংহাসন থেকে পরিপূর্ণ পতনের চিত্র তুলে ধরে এই ঘটনা,” বলেন তিনি।

সূত্র- টিবিএস।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।