Home ইসলাম ইস্পাতশিল্পের বিকাশে মুসলমানের অবদান

ইস্পাতশিল্পের বিকাশে মুসলমানের অবদান

আবুধাবির শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ।

।।মো. আবদুল মজিদ মোল্লা ।।

ইসলামের আগমনের আগে থেকে আরব উপদ্বীপের ইয়েমেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইস্পাতশিল্পের চর্চা ছিল। বিশেষত পারস্যের খাওয়ারিজম, ফারগানা, সমরকন্দের খনিজ পদার্থ ও খনিজশিল্পের কদর ছিল বিশ্ববাজারে। তবে তার বেশির ভাগই ব্যবহূত হতো সরমাস্ত্রশিল্পে। মুসলিম শাসকরা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে এই শিল্পে বিপুল বিনিয়োগ ও পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং ইস্পাতকে নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের উপযোগী করেন।

ফলে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন খনিজ শিল্পকেন্দ্র গড়ে ওঠে। মুসলিম শাসকদের অনুদানে আরবের মসুল, হারান ও নাসিবাইনে বৃহৎ লৌহ ও ইস্পাত কারখানা গড়ে ওঠে। যেখানে উন্নতমানের চেইন, ছুরি, কিরিস, পরিমাপযন্ত্র, রোলার, প্রকৌশলবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, বিজ্ঞান গবেষণা উপকরণ তৈরি হতো। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে মুসলিম স্পেনেও ইস্পাতশিল্পের বিপুল বিস্তার ঘটে।

ইস্পাতের শ্রেণিবিন্যাস : ঐতিহাসিক জে ভি হ্যামার পার্গস্টল বলেন, আল-কিন্দি তরবারি তৈরির ইস্পাতকে সর্বপ্রথম শ্রেণিতে বিভক্ত করেন। এর ভেতর ইস্পাত মৌলিক দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেন। এক. Iron Works Steel ও দুই. Non Iron Works Steel। এরপর তিনি Iron Works Steel ইস্পাতকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। তা হলো Carbon Steel ও Wrought Iron। এই দুই প্রকার ইস্পাতের সমন্বয়ে তিনি ‘যৌগিক ইস্পাত’ নামে তৃতীয় প্রকার ইসলামের উদ্ভাবন করেন। আল-কিন্দির ভাষায় যৌগিক ইস্পাতের বৈশিষ্ট্য হলো, এর মধ্যে পুরুষের কঠোরতা ও নারীর দৃঢ়তার বৈশিষ্ট্য একত্র হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান যাকে Laminated Steel বলে এটি সেই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ইউরোপ ও ইন্দোনেশিয়ায় বিস্তার : ঐতিহাসিক এইচ ই উলফ বলেন, স্পেনের টলেডোতে ইস্পাতশিল্পের সূচনা মুসলিমদের মাধ্যমেই হয়েছিল। সিসিলিতে দীর্ঘদিন মুসলমানদের সঙ্গে বসবাস করার সময় নরম্যানরা মুসলিমদের কাছ থেকেই ইস্পাতশিল্পের জ্ঞান লাভ করেছিল। এরপর মুসলিমরা এই শিল্পকে ইন্দোনেশিয়ানদের শেখায়। দশম থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত জাভার (ইন্দোনেশিয়া) সঙ্গে মুসলিমদের যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, তার ভিত্তিতেই ইন্দোনেশিয়ায় এই শিল্পের বিকাশ ঘটে এবং তারা পামোর (ছুরি বিশেষ) তৈরির কৌশল রপ্ত করে।

মধ্য এশিয়ায় ইস্পাতশিল্পের বিকাশ : এ ছাড়া উজবেকিস্তানের ‘আবু মুসলিম কালা’ নামক প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলটিতেও মুসলিম আমলে ইস্পাতশিল্পের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। মধ্য এশিয়ার এই কেন্দ্রের সঙ্গে খাওরিজম সাম্রাজ্যের বেশির ভাগ শহরের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। এখান থেকে বিভিন্ন প্রকার ধাতুর কাঁচামাল ও প্রস্তুত সরঞ্জাম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যেত। বিশেষত এটা প্রক্রিয়াজাত ইস্পাতের একটি বিশ্বস্ত কেন্দ্র। তবে ঐতিহাসিক সমীক্ষাগুলো থেকে বোঝা যায় এই অঞ্চলে ইস্পাতশিল্পে যেসব কাঁচামাল ব্যবহার করা হতো তার বেশির ভাগ অন্য অঞ্চলে থেকে আনা হতো। কেননা অত্র অঞ্চলে ইস্পাতের খনি ছিল না।

ইস্পাতের বহুমুখী ব্যবহার : মুসলিম আমলে ধাতব কারিগররা ব্রঞ্জ, পিতল ও তামা দ্বারা বাতি, কলস, বাটি, মগ, কাপ, বেসিন এবং বিভিন্ন ধরনের পাত্র তৈরি করে। এ ছাড়া তারা খেলনা হিসেবে সিংহ, ড্রাগন, স্ফিংস, ময়ূর ও ঘুঘু তৈরি করত। এ ছাড়া তারা ইস্পাত দ্বারা সূক্ষ্ম কারুকাজবিশিষ্ট বিভিন্ন আসবাব তৈরি করত।

আরও পড়তে পারেন-

মুসলিম আমলে দামেস্কের তরবারির বিশেষ সুনাম ছিল। তরবারিগুলো অস্ত্র হিসেবে যেমন কার্যকর ছিল, তেমনি তাতে নানা ধরনের শৈল্পিক কারুকাজও হতো। এমনকি তাতে স্বর্ণ, রৌপ্য ও মূল্যবান পাথর বসানো হতো। মুসলিম আমলে সমগ্র স্পেনজুড়ে ইস্পাতশিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। মুরসিয়া লোহা ও পিতলের জন্য, টলোডো তরবারির জন্য, করডোভা ঢালের জন্য বিখ্যাত ছিল।

বিস্মিত আধুনিক বিজ্ঞানীরাও : সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা ইস্পাতশিল্পে মুসলমানের অবদানকে আরো উজ্জ্বল প্রমাণ করেছে এবং বিস্মিত করেছে সমকালীন বিজ্ঞানীদের। যেমন ব্রিটেনের বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ‘ন্যাচার’-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে, দামেস্কের তরবারি উৎপাদনে ‘ন্যানো টিউব’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতো। অথচ মানুষের ধারণা ছিল প্রযুক্তিটি বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আবিষ্কৃত।

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার : একইভাবে ধারালো ও মজবুত তরবারি ‘সাবরিজ’-ও দামেস্কের ইস্পাতশিল্পের অবদান। তবে এটি ভারতীয় ইস্পাত দিয়ে তৈরি হতো এটাকে ‘উখস’ (গৃহীত) নামকরণ করা হয়। জার্মানির ‘দ্য টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব ড্রেজডেন’-এর পিটার পফলার ও তার সহকর্মীরা সপ্তদশ শতাব্দীর একটি উখস তরবারি ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কপের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখেছেন যে তাতে একটি ন্যানোমিটার টিউবের মাইক্রোস্ট্রাকচার ব্যবহার করা হয়েছে। যা ওজর হালকা রেখে মজবুত করতে ব্যবহৃত আধুনিক প্রযুক্তি কার্বন ন্যানোটিউবের মতো।

দামেস্কে তৈরি তরবারিতে ব্যবহৃত ইস্পাতের সমকক্ষ ইস্পাত ইউরোপে খুঁজে পাওয়া যায় না। দৃঢ়তা, কার্যকরিতা ও নকশা সব দিক বিবেচনায় তা শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার ছিল। বর্তমান সময়ের বিজ্ঞানীরা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সমিশন ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কপি দ্বারা সপ্তদশ শতাব্দীর দামেস্কের সাবরি ইস্পাত পরীক্ষা করে দেখেছেন, তাতে কার্বন ন্যানো টিউবের মতো সিমেন্টাইট ন্যানো ওয়ারস ব্যবহার করা হয়েছে।

মুসলমানের গ্রন্থগুলো শ্রেষ্ঠ : মুসলিমরা শুধু ইস্পাতশিল্পের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখেনি; বরং এ বিষয়ে বই লিখে পরবর্তীদের পথ দেখিয়েছে। ইস্পাতশিল্প বিষয়ক মুসলিম গ্রন্থগুলো সম্পর্কে ঐতিহাসিক ডাব্লিউ ডুরান্ট বলেন, আমরা কোনো সংশয় ছাড়াই বলতে পারি নবম থেকে অষ্টদশ শতাব্দী পর্যন্ত লেখা ইসলামী বইগুলোই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ। এখন পর্যন্ত এই বইগুলোর সমকক্ষ কোনো বই কি আমাদের সামনে আছে?

তথ্যঋণ : মুসলিম হেরিটেইজ ডটকম ও ক্যামব্রিজ ডটঅর্গ

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।