।। মুফতি হাবিবুর রহমান ।।
[গত ৭ অক্টোবর শুক্রবার হাটহাজারী আলীপুরস্থ উচ্চতর ইসলামী গবেষণাকেন্দ্র মারকাযুত তা’লীম ওয়াত তারবিয়াহ ক্যাম্পাস জামে মসজিদে জুমার খুতবপূর্ব বয়ানে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ও খতীব মুফতি হাবিবুর রহমান ‘ইসলামের আলোকে কথিত ঈদে মিলাদুন্নবী ও জুলুস’ শীর্ষক বয়ান করেন। বয়ানে মারকাযুত তা’লীম ওয়াত তারবিয়াহর শিক্ষার্থীগণ ছাড়াও মুসল্লীগণ শরীক ছিলেন। বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে ‘উম্মাহ’ পাঠক সমীপে বয়ানটির অনুলিপি উপস্থাপন করা হলো]
হামদ ও সালাতের পর… প্রত্যেকটি মুমিন হবে সীমান্ত প্রহরীদের মত সতর্ক ও বুদ্ধিমান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিখ্যাত হাদীস- لا يلدغ المؤمن من جحر واحد مرتين “কোন মুমিন এক গর্তে দু’বার দংশিত হয় না”। (বুখারী, মুসলিম,আবু দাউদ)। বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) এই হাদিসের ব্যাখ্যায় আরেকটি হাদিস উল্লেখ করেন- المؤمن كيس حذر বা অন্য রেওয়াতে আছে المؤمن كيس فطن অর্থাৎ “মুমিন হবে বিচক্ষণ ও সদা সতর্ক”।
অর্থাৎ- প্রতিটি মুমিনকে সর্বদা বিচক্ষণতার সাথে সতর্ক থাকতে হবে। দুনিয়ার সমস্ত শয়তানি শক্তি তার ঈমান আমল আখলাককে ধ্বংস করতে চাইবে এমনকি হাদিসের মর্ম কথা অনুযায়ী মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে সারা জীবনের সকল ইবাদতকে ধ্বংস করার জন্য শয়তান সমস্ত শক্তি ব্যয় করে।
এজন্য প্রতিটি মুমিন সর্বদা সীমান্ত প্রহরীদের মতো সশস্ত্র ও সতর্ক থাকতে হবে। সতর্কতা মানে হলো “তাকওয়া” আল্লাহর ভয় হৃদয়ে লালন করা। আর সশস্ত্রতা মানে হল শরীয়তের মানদন্ড মেনে চলা।
মুমিন যখন হৃদয়ে আল্লাহর ভয় লালন করবে এবং সত্য মিথ্যার মাপকাঠিতে প্রতিটি বিষয়কে উত্তীর্ণ করে পথ চলবে; তখন সে শয়তানি শক্তির এ সমস্ত আগ্রাসন থেকে মুক্ত থাকবে।
শরীয়তের মাপকাঠি হল: উম্মতের সর্ব স্বীকৃত আকাবির আসলাফের ব্যাখ্যা সহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবীদের হেদায়েত। এটাই হল সব যুগে হক ও হক্কানিয়তের শাস্বত মানদন্ড। ১২ই রবিউল আউয়াল মিলাদুন্নবী উপলক্ষে আমাদের সমাজের কিছু মানুষ ঈদ পালন করে, জুলুস করে, শরীয়তের দৃষ্টিতে এর বিধান কি তা আমরা বুঝার চেষ্টা করব। শরীয়তে ইসলামের একটি বড় মূলনীতি হলো-
অর্থাৎ কোন বিষয়কে এবাদত হিসেবে প্রমাণ করার জন্য রাসূলুল্লাহ বা সাহাবীদের কথা কর্ম বা স্বীকৃতি প্রয়োজন। বিবেকের বিচারে যেকোনো ভালো কাজই শরীয়তে এবাদত হিসেবে গৃহীত হয় না।
হযরত সালেম ইবনে উবায়েদ (রা) থেকে বর্ণিত: একবার সফরকালে তার এক সঙ্গী হাঁচি দেয়ার পর বলল “আসসালামু আলাইকুম” তিনি বললেন- عليك و على أمك “তোমার উপর আর তোমার মায়ের উপর” এই কথার কারণে যখন তিনি তার চেহারায় বিরক্তিভাব লক্ষ্য করলেন; তখন বললেন এটি আমি বলিনি বরং রাসূলুল্লাহর মজলিসে এক ব্যক্তি হাঁচির জবাবে সালাম দিয়েছিল তখন রাসূলুল্লাহ তাকে এই জবাব দিয়েছিলেন। (জামে তিরমিযী, হাদীস নং- ২৭৪০)।
লক্ষ্য করুন, হাঁচির জবাবে সে সালাম দিয়েছিল। এটি একটি ভালো কাজ। কিন্তু যেহেতু শরীয়তে হাজির জবাব ভিন্নভাবে বর্ণিত রয়েছে তাই রাসুলুল্লাহ এটাকে চরমভাবে অপছন্দ করেছেন।
তাই ইবাদত হিসেবে কোন কাজকে গ্রহণ করার জন্য শরীয়ত কর্তৃক কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকা যথেষ্ট নয় বরং সরাসরি রাসূলুল্লাহ বা সাহাবাদের আমল দ্বারা প্রমাণিত হওয়া জরুরী। এটা পোশাক-আশাক আর ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো নয় যে,শরীয়ত কর্তৃক কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকলেই নতুন নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করা যাবে। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অনেক কিছুই ইবাদত হিসেবে করা হয় না বরং বৈধ হিসেবে করা হয়।
পক্ষান্তরে ঈদে মিলাদুন্নবী তারা এটাকে সুন্নত বরং আবশ্যকীয় ওয়াজিব হিসেবে পালন করে। শুধু তাই নয়, এটাকে “আশেকে রাসুল” হওয়ার মানদন্ড বিচার করে। যার জন্য শরীয়তের মূলনীতি অনুযায়ী অবশ্যই প্রমাণিত হতে হবে।
আমরা এখন দেখব এই তথাকথিত ঈদ কি প্রমাণিত? এটাকে “ঈদ” হিসেবে পালন করা তো দূরের কথা কোন ধরনের আনুষ্ঠানিকতার সাথে এই দিনকে উদযাপন করার প্রমাণ ৬০০ হিজরীর পূর্বে পাওয়া যায় না । ৬০৪ হিজরীতে সর্বপ্রথম বাদশাহ আবু সাঈদ মোজাফফার এই দিনে রাসূলের শানে অনুষ্ঠান আয়োজন করে। তখন জমানার বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম এটাকে অপছন্দ করেছেন। যদিও সে এটাকে ইবাদত (মুস্তাহাব সুন্নত বা ওয়াজিব) হিসেবে অথবা “ঈদ” মনে করে পালন করেনি।
অতএব নিঃসন্দেহে তথাকথিত এই ঈদে মিলাদুন্নবী একটি বিদআত ও পরিত্যাজ্য বিষয়।
আমাদের বিদাআতি ভাইদের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী প্রণীত “যা আল হাক্ব এ তিনিও এটাকে নব আবিষ্কৃত বিদআত বলেছেন (আমার কাছে এই বইয়ের হার্ডকপি রয়েছে)। এটা তো গেল ইবাদতের ক্ষেত্রে মূলনীতি।
প্রশ্ন: যদি বলা হয় যে, ঈদ বা ইবাদত হিসেবে নয় বরং আমরা মোবাহ বা বৈধ হিসেবে এই দিনে খুশি ও আনন্দ উদযাপন করি। তার কি অনুমতি আছে?
জবাব: প্রথমত যারা এই দিনটিকে উদযাপন করে তারা এটাকে ইবাদত হিসেবেই উদযাপন করে। বরং দ্বীনের “শিয়ার” ঈদ হিসেবে পালন করে, সুন্নত বা ওয়াজিব মনে করে। তবে কেউ যদি এবাদত হিসেবে নয় বরং মোবাহ হিসেবে পালন করে, এবং এর সাথে বা এর কারণে শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ প্রকাশ পাবার আশঙ্কা না থাকে তাহলেও অনেক ওলামায়ে কেরাম এটাকে অপছন্দ করেছেন।
কিন্তু বর্তমানে এই ঈদ পালন করতে গিয়ে হাজারো শরীয়ত বিরোধী কাজ করা হচ্ছে। মানুষের মধ্যে ভুল আকিদা ঢুকে যাচ্ছে। আখলাক ও আমলের মধ্যে চরম গাফলতি হচ্ছে। শুধু তাই নয় বেদয়াতিরা এটাকে নিজেদের “শিয়ার” বা পরিচয় বানিয়ে নিয়েছে।
আরও পড়তে পারেন-
- কঠিন কাজের সময় রাসুল (সা.) যে দোয়া করতেন
- মুচকি হাসা মহানবীর (সা.)-এর সুন্নত
- বিভিন্ন দেশে কোরআন হিফজ করার পদ্ধতি
- ইসলামে সামাজিক সম্পর্ক এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখার গুরুত্ব
- মানুষ মারা যাওয়ার পর, তাঁর আত্মার কি হয় ?
তাই ইবাদত মনে না করেও এই দিনটিকে বিশেষভাবে উদযাপন করা জায়েজ নয়।
বেশ কয়েক বছর পূর্বে চট্টগ্রাম শহরে অনুষ্ঠিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী তে সারাদিন ছিলাম। এই জুলুসের সদারত করেছিলেন পাকিস্তানের তাহের শাহ। তার সাথে তার দুই সুপুত্র পীরজাদা আলোচনা করেন। মানুষকে তরিকতের ছবক দান করেন। অথচ তাদের দুজনের কারোই সুন্নতি দাড়ি ছিল না।
তেমনি গত বছর এই জুলুসের নেতৃত্ব দেন সিরিকোট শরীফের সৈয়দ সাবের শাহ। তার দাড়ির ও এমন দৈন্যদশা। অথচ কোরআন হাদিস ও ফিকহের নির্ভরযোগ্য মতানুযায়ী এক মুষ্টির নিচে দাড়ি কাটা হারাম। এমন ব্যক্তি ফাসেক হিসেবে বিবেচিত হয়। স্বয়ং তাদের নির্ভরযোগ্য ফতোয়া গ্রন্থ “বাহারে শরীয়ত” এ আছে-
যার সারকথা হলো, দাড়ি মুণ্ডন করা বা এক মুষ্টি থেকে কম রাখা হারাম, অভ্যাসগতভাবে এমন করলে সে ফাসেক, এবং তার পিছে নামাজ পড়া জায়েজ নেই। তাছাড়া সেদিনের বিশাল এই জামায়াতে কতজন আসরের নামাজ আদায় করেছে তা আল্লাহই ভালো জানেন। জোহরের নামাজের জামাত হয় আসরের একদম পূর্ব মুহূর্তে। তারপর মাগরিব পর্যন্ত সেখানে ছিলাম, মুষ্টি কয়েক মানুষকে আসরের নামাজ আদায় করতে দেখেছি। বাকিরা সবাই গাড়িতে গাড়িতে গান বাজনা করতে করতে ফিরে যায়।
অনেকে বলে থাকেন, এর দ্বারা দ্বীনে ইসলামের শান-শওকত প্রকাশ পায়, যা মুসলিমদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াতের কারণ হয়, আবার অনেকে বলেন, এটা একটি মানবিক বিষয়। সব ধর্মেই তাদের ধর্ম গুরুর জন্মদিন কে এভাবে উদযাপন করা হয় , যেমনটা তাদের সবচেয়ে অথেন্টিক গ্রন্থ “যা আল হকে” উল্লেখ করা হয়েছে । অথচ এমন শত মুনকারের জন্মদাতা বিদআতের মাধ্যমে কয়জন মানুষ যে মুসলমান হয়েছে তা পৃথিবীর অবস্থা ও ইতিহাস দেখলে বুঝা যায়।
আমরা দেখছি পৃথিবীব্যাপী দাওয়াত ও তাবলীগ, ভারতের মাওলানা কালীম সিদ্দিকীর দাওয়াতি মিশন এবং আমাদের সালাফি ভাইদের দাওয়াতী কার্যক্রমের মাধ্যমে পৃথিবীতে ইসলামের আদর্শিক সৌন্দর্য মানুষের কাছে ফুটে উঠছে, লাখো মানুষ ইসলামে দীক্ষিত হচ্ছে। এমন কোন প্রমাণ কি রয়েছে এই বিদআতি কার্যক্রমের দ্বারা মানুষ মুসলমান হওয়ার?
তাছাড়া আনুষ্ঠানিকতা ও উৎসবের মাধ্যমে তো মানুষকে ধর্মের দিকে আহ্বান করার কাজটি ইসকন আরো ভালোভাবে আদায় করছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলোতে। মানুষ ইসলামের দিকে নয় বরং হিন্দু ধর্মের দিকে ধাবিত হচ্ছে কেননা হিন্দু ধর্মের ফেস্টিবল ও উৎসব আরো আনন্দদায়ক মনোরঞ্জক।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে বুঝার তৌফিক দান করুন পরিশেষে মোজাদ্দিদে আলফে সানী (র.) এর একটি মাকতূবনামা পেশ করছি-
এখানে মোজাদ্দেদে আলফেসানী আল্লাহর কাছে রোনাজারি করছেন যে, আল্লাহ আমাকে এবং আমার অনুসারীদেরকে যা রাসূলুল্লাহ এবং খোলাফায়ে রাশেদিন এর জামানায় ছিল না এমন বিদআতে লিপ্ত হওয়া থেকে হেফাজত করুন। যদিও তা সূর্যের মতো আলোকিত হয়। এবং এমন বিদআতের বাহ্যিক সৌন্দর্যে বিমোহিত ও ধোকাগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করুন।
সুনানে দারেমির মুকাদ্দামায় একটি হাদিস আছে, একবার দুজন বিদআতি বিখ্যাত তাবেঈ ইবনে সীরীন(রহ.) এর কাছে এসে হাদিস শুনাতে চাইল। তিনি নিষেধ করলেন। তারা একটি আয়াত শুনাতে চাইল। তিনি আবারও নিষেধ করলেন। এবং তাদেরকে মজলিস থেকে তাড়িয়ে দিলেন। তখন একজন বললো, আপনি তাদের থেকে একটি আয়াত শুনলে কী ক্ষতি ছিল? তিনি জবাবে বললেন-
আমি ভয় পেয়েছি তারা কুরআনের আয়াতের অপব্যাখ্যা করবে, আর হয়তো আমার কাছে ভালো লেগে যাবে।
আলোচনার সারকথা হলো, ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নতুন বিদআত ই পথভ্রষ্টতা ও জাহান্নামে যাওয়ার কারণ। যদিও তা বাহ্য দৃষ্টিতে,ও বিবেকের মানদন্ডে সঠিক, উপকারী মনে হয়। বরং হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী মুমিন হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের সীমান্ত প্রহরীর মত সদা সশস্র ও সতর্ক থাকতে হবে। শরীয়তের সঠিক মাপকাঠিতে প্রত্যেকটি বিষয়কে পরখ করতে হবে। আরবি কবি বলেন-
অর্থাৎ- ” সব কল্যাণই সালাফের অনুসরণে / সব ক্ষতিই খালাফের বিদআত অনুকরণে ।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ