Home লাইফ স্টাইল কাজের চাপে যদি আমাদের মন-মগজ-শরীর তিনটাই বিগড়ে যায়, তাহলে কী হবে?

কাজের চাপে যদি আমাদের মন-মগজ-শরীর তিনটাই বিগড়ে যায়, তাহলে কী হবে?

।। শাহানা হুদা রঞ্জনা ।।

আসাদগেট থেকে শ্যামলী পর্যন্ত ‘পরিস্থান’ নামের একটি বাসের পেছন পেছন চলছি। ঢাকা শহরে এতো জ্যাম যে প্রায় ৩০/৪০ মিনিট যাবৎ সব গাড়ি পিঁপড়ার মতো এগুচ্ছে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম নিজের অজান্তেই অফিসে দেরিতে পৌঁছানোর শঙ্কার কথা না ভেবে বা বাসায় ফেলে আসা অর্ধসমাপ্ত কাজের কথা বাদ দিয়ে সেই পরিস্থান নামের বাসটিকে লক্ষ্য করতে শুরু করেছি।

এই বাসের নাম পরিস্থান হলেও কোনো দিক দিয়েই পরী শব্দটির সাথে মিল নেই। বাসটির শুধু বডি আছে। আশেপাশের খোল-নলচে খুলে পড়ে গেছে। পেছন দিকে একটা বড় ফুটো হা করে আছে। নম্বর প্লেট নেই বললেই চলে। প্রচণ্ড জ্যামের মধ্যেও হর্ণ বাজিয়ে হুর হুর করে টানার কায়দা দেখে চালকের বয়স নির্ধারণের চেষ্টা করলাম। বড়জোর ১৬ বা ১৭ বছর হবে।

বাসের ভেতরে যাত্রী ঠাসা। জুলাইয়ের অসহ্য গরমে একজন যাত্রী জানালা দিয়ে মুখ বের করে বমি করে দিলেন সকালবেলাতেই। একটুর জন্য পাশের সিএনজি অটোতে বমি পড়েনি। তাও দেখলাম সিএনজি যাত্রী গেটের ফাঁক দিয়েই গালাগালি করছেন। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের কাছে পৌঁছুতেই পরিস্থান থেকে অন্য কেউ একজন নাস্তা খেয়ে পলিথিনের প্যাকেট ও ঠোঙ্গা ছুঁড়ে মারলেন রাস্তার দিকে। পড়লো গিয়ে একটি গাড়ির বনেটে। কিন্তু এতো ভিড় যে ঐ গাড়ির চালকের পক্ষে নেমে হইচই করারও উপায় ছিল না। এরমধ্যে পথেই আরো দু’চারটি ছোটখাট বিপর্যয় চোখে পড়লো। আর টানা হর্ন, আমলাদের গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন তো আছেই।

যেতে যেতে ভাবলাম এই আমাদের শহর, এই আমাদের জীবনযাপন। এইভাবেই চলে অধিকাংশ মানুষের নিত্য যাওয়া-আসা। সত্যি কথা বলতে প্রায় সবক্ষেত্রে আমাদের পরিস্থানের মতো হালত। সকালে উঠে সংসারের ১০/১২ ধরনের কাজ সামলে যখন মানুষ ‘পরিস্থানে’ চেপে দ্রুত অফিসে বা কাজের জায়গায় পৌঁছানোর জন্য বের হন, তখন তাকে পথিমধ্যেই এতগুলো হাঙ্গামার মুখে পড়তে হয়।

এরপরতো আছে কাজের জায়গায় চাপ, অস্বাচ্ছন্দ্য, চ্যালেঞ্জ, হয়রানি, সহকর্মীদের অসহযোগিতা এবং আরো নানান ঝামেলা। এর ভেতরে থেকেও মানুষকে বাসার শত রকমের দায়িত্ব সামলাতে হয়। চিন্তাজগতে এলোমেলো কাজ বা কাজের তাড়া চলতেই থাকে। নানা ধরণের কাজ আমাদের প্রায় সবাইকে ম্যানেজ করতে হয় বলে মনে হয় দিনটা কেন আরো বড় হয় না?

এতোকিছুর মধ্যে দিয়ে যেতে হয় বলে মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষ কি যন্ত্র? মানুষ কি দশভুজা? নাকি মানুষ অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন কোন প্রাণী? আমরা বলি ‘শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সহাইবে, তাহাই সয়।’ মানুষের মস্তিকও কি সেইরকমই মহাশয় জাতীয় কিছু? একটার পর একটা চিন্তা শুধু বসিয়ে দিলেই হলো। আমরা বলি ঠিকই, কিন্তু আমাদের শরীর বা মন বা মস্তিস্ক কোনটাই অতিরিক্ত চাপ, তাপ সহ্য করতে পারে না।

এদিকে আধুনিক ও শহুরে জীবন মানে নানাধরনের চাপ ও তাপ মোকাবেলা করা। এই জীবনে আমরা যে যতো বেশি কাজ করতে পারছি, যতো বেশি বোঝা নিতে পারছি, যতো বেশি দায়িত্ব নিতে পারছি, ততোই নিজেদের সফল বলে মনে করছি, অন্যেরাও ভাবছে। আমরা ভাবছি যে এই নানা ধরনের দায়িত্ব পালনের বা কাজ করার মধ্যেই সফলতা আছে।

আজ কালকার শহুরে জীবনে একজন কর্মজীবি পুরুষ সকাল হওয়ার সাথে সাথে নিজে অফিসের জন্য তৈরি হন, বাচ্চাকে স্কুলে নামান, যানজটের শহরে সময়মতো অফিসে পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন। অফিসে কাজের দায়িত্ব, বহুমুখী কৈফিয়ত, বাসার খরচের চিন্তা, বাচ্চার পড়াশোনা, চাকরি টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ- সবকিছু সামলাতে হয়।

আর একজন কর্মজীবি নারীর কথা যদি ভাবি, দেখবো সব দায়-দায়িত্ব সারার পরেও, তাকে রাতে মাথায় একরাশ চিন্তা নিয়ে ঘুমাতে যেতে হয়। সকালে বাসার সহকারী ঠিক সময়ে আসবেন তো? সবার জন্য কী টিফিন বানাবেন? পরিবারে তার সকাল হয় সবার আগে। স্বামীর টিফিন, বাচ্চার টিফিন, নিজের খাবার তৈরি করতে হয়। বাচ্চাকে ঘুম থেকে তুলে স্কুলের জন্য তৈরি করতে হয়, পোশাক পরাতে হয়, কাউকে কাউকে বাচ্চাকে স্কুলে নামিয়েও দিতে হয়। এরপর শুরু হয় ‘পরিস্থানে’ চেপে সঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছানোর ঝামেলা। গণপরিবহণে করে যে নারীকে অফিসে যেতে হয়, তার অবস্থা হয় আরো অনেক কঠিন।

অফিসে পৌঁছানোর পর শুরু হয় কাজের তাড়া। মিটিং, মেইলের উত্তর, কনফারেন্সের জন্য পেপার তৈরি করা, বসের সাথে যোগাযোগ, নিজের টিমকে কাজ ভাগ করে দেয়া, টেলিফোন কলের উত্তর, পাবলিক ম্যানেজমেন্ট এবং আরো অনেককিছু। শুধু যদি অফিসের চিন্তা থাকতো, তাহলেও অনেকটা সহজ হতো জীবন। কিন্তু না; অফিস, সংসার, হাসপাতাল, রোগী, অতিথি, অনুষ্ঠানসহ নানাধরনের চিন্তা চলতেই থাকে মানুষের মনোজগতে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, একসাথে অনেকধরনের কাজ বা কাজের চিন্তা মানুষের কর্মদক্ষতা নষ্ট করে দেয়, এরকম হলে মানুষ ভুলভ্রান্তিও বেশি করে। আমরাও মাঝেমাঝে ভাবি আদতে কি আমরা অনেক ধরনের কাজ এক সাথে করতে পারি? নিউরো সাইকোলজিস্টরা বলেন, আমাদের মস্তিস্ক একটি নির্দিষ্ট সময়ে একধরনের কাজই করতে পারে। যখন আমরা মনে করি যে আমরা একসাথে অনেক কাজ করছি, তখন কিন্তু আমরা দুটি কাজ একসাথে করতে পারছি না। এর পরিবর্তে আমরা পর পর আলাদা আলাদা কাজ বা রোস্টার ডিউটি করে যেতে থাকি।

আরও পড়তে পারেন-

বেশ কয়েকটি জরিপে দেখানো হয়েছে, মাত্র ২.৫ শতাংশ মানুষ কার্যকরভাবে একসাথে অনেকধরনের কাজ করতে পারেন। যখন নাকি আমাদের মস্তিস্ক সামনে-পেছনে, ডানে-বায়ে একসাথে চলতে থাকে। বিশেষ করে কাজগুলো যখন জটিল ধরনের হয় এবং অনেক মনোযোগ দিতে হয়, তখন আমরা অনেক কাজ একসাথে করতে গিয়ে কম মনোযোগী হয়ে পড়ি এবং ভুলও বেশি করি।

অথচ দেখছি ক্রমশ আমাদের সকলের জীবন মাল্টিটাস্কিং-নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। আমরা একে এড়াতে পারছি না। সাইকোথেরাপিস্টরা বলেই যাচ্ছেন, আমরা যতো বেশি মাল্টিটাস্কের মধ্যে থাকবো, ততো কম কাজ করতে পারবো। কারণ আমরা তখন কোনকিছু শেখার ক্ষেত্রে নিজেদের কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। অনেক কাজের চাপ এবং একসাথে অনেক কাজ করে যাওয়া ডিপ্রেশন, দুশ্চিন্তা, ক্রনিক পেইন এর কারণ। এছাড়া এর ফলে পারফরমেন্স নষ্ট হয়, ব্রেইনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষণা বলছে, মানুষ অনেক কাজ একসাথে ভালোমতোই করছে এ কথা ভাবলেও, তারা আসলে ভালভাবে সব কাজ করতে পারেনা। খুব ঝামেলা পোহাতে হয় সব কাজকে সুসংহত করতে, অপ্রয়োজনীয় তথ্য বাদ দিতে এবং এক কাজ থেকে অন্য কাজে যেতে। মানুষ তখন তার কাজে ধীর হয়ে পড়ে। মানুষের ব্রেইন একসময়ে একটা কাজই করতে পারে। এক্ষেত্রে ব্রেইন নষ্ট যদি নাও হয়, এই টেন্ডেসি সমস্যা বাড়িয়ে দেয়, কাজে মনোযোগ কমিয়ে দেয় এবং অনুপুঙ্খ চিন্তা করার ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। একটার পর একটা কাজ উৎপাদন ক্ষমতাও নষ্ট করে দেয়।

এতোসব তথ্য জেনে বা না জেনে আমরা আমাদের সাংসারিক ও পেশাগত পরিসরে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতে গিয়ে বা বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছি। ১৯৬০ সালে যখন কম্পিউটারের জন্য ‘মাল্টিটাস্কিং’ শব্দটি চালু হলো, তখন বোঝা যায়নি এটা মানুষের জন্যও একসময় প্রযোজ্য হবে।

শহুরে জীবনে কাজ আর চাপ প্রতিনিয়ত মানুষের সাথে সাথে চলছে। সকাল থেকে রাত অবসরহীন ক্লান্ত জীবনযাপন আমাদের। কত ধরণের চাপ একজন নাগরিককে বহন করতে হয় এর কোন শেষ নেই। গণপরিবহণ, যানজট, গরম, হয়রানি, পথেঘাটের অনিরাপত্তা ও অব্যবস্থা, সন্তানের স্কুল, তাদের আনা-নেওয়া, বাজার, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অসুখ-বিসুখ, সন্তানের বেড়ে ওঠা সবই আমাদের প্রতিদিন মোকাবেলা করতে হচ্ছে। অধিকাংশ সময়েই একসাথেই ২/৩ টা করে দায়িত্ব একজনকে পালন করতে হচ্ছে।

এই লাগাতার চাপের মধ্যেও কি হাফ ফেলার অবকাশ বের করা সম্ভব? ডিজিটাল প্রযুক্তি ও সর্বদা যোগাযোগের তাগিদের মাঝেও কি নিরুত্তাপ থাকা সম্ভব? আমাদের আগের প্রজন্মও চাপ সামলেছেন, কিন্তু এইভাবে নয়। তখন অধিকাংশ পরিবারের পুরুষরা আয় করতেন, বাইরের কাজগুলো করতেন, বাজারহাট করতেন। নারীরা রান্নাবান্না ও ঘরকন্নার কাজ করতেন। সন্তানের দেখাশোনা পুরোটাই ছিল মায়ের উপর। আয় নিয়ে নারীরা প্রায় উদ্বেগহীন ছিলেন, অন্যদিকে সংসারের দেখভাল নিয়ে বাবারা ছিলেন উদ্বেগহীন। কাজের বিভাজন ছিল।

সময় বদলেছে, নারী ও পুরুষের কাজের ধরন ও চাপ বেড়েছে। দায়িত্ব ভাগাভাগি হয়ে গেছে। নারীর দায়িত্ব আগের চাইতে অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে চাকুরিজীবি নারীদের সাংসারিক চাপের পাশাপাশি অফিসের প্রশাসনিক চাপও অনেক। যেমন আজ কী রান্না হবে, কী বাজার আছে, বাচ্চার জন্য বাসায় গিয়েই কী নাস্তা দিবো? ছাদে যে কাপড় শুকাতে দেয়া হয়েছিল, তা কি তোলা হয়েছে? হঠাৎ ঝড়ো বাতাস বইছে জানালাগুলো কি খোলাই আছে? বাবা ঠিক সময়ে ওষুধটা খেয়েছেন কি? বাচ্চার পড়াটা দেখতে হবে। আজকে পরীক্ষাইবা কেমন হলো?

এখানেই শেষ না, সাথে সাথে এই চিন্তাও আছে অফিসের ওয়ার্কিং পেপারটা রেডি করতে পারবো তো ৫ টার মধ্যে? মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশনটা কেমন হলো? প্রডাক্টগুলো কি সময়মতো ডেলিভারি দিতে পারবো? অথবা ফ্যাক্টরির ওয়ার্কাররা ঠিকমতো কাজ করছে কিনা, চালান রেডি হয়েছে কিনা ইত্যাদি নানাকিছু।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, কাজ ও কাজের চাপ থাকবেই, কিন্তু একে ম্যানেজ করে চলাটাই আসল। এতো কাজ, এতো চিন্তা বা দুশ্চিন্তা বিশেষ করে মাল্টিটাস্কিং বিষয়টা এড়িয়ে চলা খুব কঠিন আধুনিক সাংসারিক ও পেশাগত জীবনে। তারা বলেন, স্ট্রেসের অন্য সমস্যা হলো, স্ট্রেস আমাদের হরমোন প্রণালীর উপর এমন প্রভাব বিস্তার করে যে তাতে শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যাদের ‘পরিস্থানে’ চড়তে হয়, যাদের যানজটের অসহনীয় ভোগান্তি সামলাতে হয়, যাদের সংসার চালাতে হয়, যাদের পড়াশোনার বোঝা টানতে হয়, যাদের অন্যের মুখে ভাত যোগাতে হয়, যাদের একসাথে ১০ ধরনের কাজ সারতে হয়, তাদের উচিৎ স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট কীভাবে-কোথায় করা যায় সেই সম্পর্কে জানা। অনেক কাজ একসাথে না করে কিভাবে একটা কাজই ভালো করে করা যায়, কিভাবে মেজাজটা ঠিক রাখা যায়, নিজের আচরণ কিভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সেটাও ভাবা দরকার।

ভারতের প্রসিদ্ধ নিউরোসার্জন ডা. শাকির হোসাইন সবসময় বলেন নিজেকে সময় দেও। নিজের কথা ভাবো। খানিকটা স্বার্থপর হও। নিজে ভাল না থাকলে তুমি আরো পাঁচজনকে ভালো রাখতে পারবে না। কাজেই যতোই কাজের চাপ থাকুক নিয়মিত ঘুমানো, ব্যায়াম ও ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করা প্রয়োজন। একসাথে অনেক কাজের দায়িত্ব নিয়ে কাজে নামার চেষ্টা করোনা। তাহলে মন, মগজ ও শরীর তিনটিই বিগড়ে যাবে।

লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।

সূত্র- টিবিএস।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।