Home মহিলাঙ্গন মুসলিম নারীদের সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের দৃষ্টান্ত

মুসলিম নারীদের সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের দৃষ্টান্ত

।। আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন ।।

হযরত আয়েশা (রাযি.)এর অসৎকাজের প্রতি বাধা প্রদান

হযরত আয়েশা (রাযি.) ছোট বাচ্চাদের রোগের চিকিৎসা করতেন। এক সময় জনৈক ব্যক্তি তার ভাইকে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর কাছে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসলেন। তিনি তার চিকিৎসা করার পরে দেখলেন যে, তার পায়ের উপর রূপার দু’টি পাত লাগানো।

হযরত আয়েশা (রাযি.) এ অবস্থা দেখে তাদেরকে বললেন, তোমাদের কি বিশ্বাস যে, এই রূপার পাত তোমাদের তাকদীর পাল্টিয়ে দিবে এবং রোগ থেকে মুক্তি দিবে? অতঃপর বললেন, আমি যদি পূর্বেই এই অবস্থা দেখতাম, তাহলে চিকিৎসা করতাম না। উপরোক্ত ঘটনার দ্বারা আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, হযরত আয়েশা (রাযি.) খারাপ আক্বিদা-বিশ্বাসের ব্যপারে কি রকম কঠোর ছিলেন এবং এই অসৎ কাজ দেখে সাথে সাথে তাদেরকে বাধা প্রদান করেছেন।

উম্মুল মুমিনীন হযরত মায়মুনা (রাযি.)এর সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ

হযরত মায়মুনা (রাযি.) এক সময় নিজের ভাতিজা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.)কে এলোমেলো চুল এবং শরীরে ময়লাযুক্ত অবস্থায় দেখতে পেলেন। তখন তিনি তার অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বললেন, আমার মাথায় যিনি চিরুনি লাগিয়ে পরিপাটি করেন, তিনি আজকে হায়েযের (মাসিক ঋতুস্রাব) রোগে আক্রান্ত, তাই আমার এই অবস্থা।

একথা শুনা মাত্রই হযরত মায়মুনা (রাযি.) তাঁর ভাতিজার কথার প্রতিবাদ করলেন এবং বললেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কারো হায়েযের অবস্থা জানা সত্ত্বেও আমাদের কাছে তাশরিফ আনতেন এবং হায়েয থাকা স্ত্রীর শরীরে ঠেস দিয়ে বসতেন। এমন কি টেক লাগানো অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াতও করতেন। উক্ত ঘটনায় প্রতিয়মান হয় যে, ইসলামের আসল সৌন্দর্য হচ্ছে বাহ্যিক ও ভিতরগত দিক দিয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা। আর এর আদেশ করলেন হযরত মায়মুনা (রাযি.)।

এখানে তিনি হাদীসের মলনীতি বাতলিয়ে দিয়েছেন। এটাই হলো সৎকাজের আদেশ। তাছাড়া তিনি তাঁর ভাতিজার ভুলও সংশোধন করিয়ে দিলেন। এটাই হলো অসৎকাজে বাধা প্রদান। হযরত মায়মুনা (রাযি.) এর প্রতি খুব গুরুত্ব দিয়েছেন, যা উপরোক্ত ঘটনা দ্বারা প্রতিয়মান হয়।

আয়েশা (রাযি.)এর সৎকাজের আদেশ

এক সময় হযরত আয়েশা (রাযি.)এর ভাই আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর তাঁর সামনে অযূ করছিলেন। তখন হযরত আয়েশা (রাযি.) বললেন, হে আব্দুর রহমান! পরিপূর্ণ রূপে অযূ কর। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি যে, তিনি ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি অযূ করার সময় পায়ের টাখনু উত্তমরূপে ধৌত করবে না, তার ঐ টাখনু জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। এতেও বুঝা গেল যে, হযরত আয়েশা (রাযি.) সৎকাজের আদেশ করতেন।

হুযূর (সা.)এর আজাদকৃত বাঁদী হযরত সালমী (রাযি.) কর্তৃক তাঁর স্বামীকে অযূ করার আহ্বান

এক সময় হযরত আবু রাফে (রাযি.)এর নামায রত অবস্থায় বায়ু নির্গত হওয়ায় অযূ ভেঙ্গে যায়। এটা জানা সত্ত্বেও তিনি ঐ অবস্থাই নামায পড়ছিলেন। তখন তার স্ত্রী হযরত সালমী (রাযি.) বললেন, আপনি অযূ করে আসুন। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন যে, যদি পেছনের রাস্তা দিয়ে বায়ু নির্গত হয়, তাহলে সে যেন অযূ করে নেয়।

হযরত ওমরা (রাযি.) কর্তৃক নিজ স্বামীর প্রতি ইবাদতের আহ্বান

ইমাম ইবনে জুযী (রাহ.) উল্লেখ করেন যে, হাবীব আজমীর স্ত্রী ওমরা (রাযি.) এক সময় ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে গেলেন, তখনও হাবীব আজমী ঘুমাচ্ছিলেন। তখন হযরত ওমরা (রাযি.) নিজের স্বামীকে শেষ রাতে জাগ্রত করতে করতে বললেন, হে শ্রদ্ধেয় স্বামী! ঘুম থেকে জেগে উঠুন। রাত শেষ হয়ে দিন শুরু হয়ে গেছে। আমাদের সামনে রাস্তা অনেক লম্বা, কিন্তু রাস্তার প্রয়োজনীয় রসদ অনেক কম। নেককারের দল অনেক সামনে চলে গেছে, আমরা অনেক পিছনে রয়ে গেছি। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ূন, যাতে আমরা দ্রুত তাদের কাছে পৌঁছার চেষ্টা করি। কি পরিমান নেক্কার ও সুখী ঐ সমস্ত পরিবার, যাদের স্ত্রী নিজেও আল্লাহর ইবাদত করে এবং ঘরের সকলকে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য উদ্ধুদ্ধ করে এবং নির্দেশ দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ সমস্ত নেক্কার স্ত্রীদের জন্য দোয়া করেছেন, যারা নিজেদের স্বামীকে আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের জন্য ঘুম থেকে উঠিয়ে দেন।

খানা উপস্থিত থাকা অবস্থায় হযরত আয়েশা (রাযি.)এর নিজ ভাতিজাকে নামায থেকে বারণ করা

ইবনে আতিক বর্ণনা করেন, আমি এবং হযরত আয়েশা (রাযি.)এর ভাতিজা কাসেম আয়েশা (রাযি.)এর সামনে পরস্পর আলোচনা বা কথাবার্তার মধ্যে লিপ্ত ছিলাম। কাসেম একটু উচ্চ আওয়াজে কথা বলছিল। তখন হযরত আয়েশা (রাযি.) বললেন, হে কাসেম! তুমি আতিকের মত কথাবার্তা বল না কেন? সাথে সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.) একথাও বললেন, হ্যাঁ, আমার জানা আছে যে, তোমরা কার মাধ্যমে দুনিয়ায় এসেছ। অর্থাৎ কাসেম এক বাঁদির এবং আতিক এক স্বাধীন মহিলার ছেলে। এ কথা শুনে কাসেম মনক্ষুণ্ন হয়ে পড়লেন। এরপর কাসেম যখন হযরত আয়েশা (রাযি.)কে খাবারের আয়োজন করতে দেখল, সে চলে যেতে চাইল।

হযরত আয়েশা (রাযি.) জিজ্ঞাসা করলেন, হে কাসেম! কোথায় যাচ্ছ? উত্তরে কাসেম বললেন, নামায পড়তে যাচ্ছি। আয়েশা (রাযি.) ধমকি দিয়ে বললেন, খানা খেয়ে নাও পরে নামায পড়বে। কারণ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, খানা সামনে উপস্থিত থাকা কালীন নামায পড়বে না। আর প্রস্রাব-পায়খানার হাজতের সময়ও নামায পড়বে না। বরং খানা ও হাজত থেকে ফারেগ হয়ে তবেই নামায পড়বে। উপরোক্ত ঘটনা দ্বারা প্রতিয়মান হয় যে, আয়েশা (রাযি.) কথাবার্তা বলার আদব বলে দিলেন। এবং কথাবার্তা নরম আওয়াজে বলার নির্দেশ দিলেন। আর অসৎকাজ থেকে বারণ করার ব্যপারে খুবই কঠোর ছিলেন। এমনকি তার ভাতিজাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের কথা না মানার উপর খুব কঠোর বাক্য প্রয়োগ করে ধমকি দিয়েছেন।

হযরত উম্মে সালমা (রাযি.) কর্তৃক নিজের একজন আত্মিয়কে নামাযের মধ্যে‘ফুঁ’ দিয়ে সিজদার জায়গা পরিস্কার করা থেকে বারণ করা

এক সময় উম্মে সালমা (রাযি.)এর এক আত্মিয়কে নামাযে দাঁড়িয়ে নামাযরত অবস্থায় সিজদার জায়গা ফুঁ দিয়ে পরিস্কার করতে দেখে বললেন, হে প্রিয় ছেলে! এরকম করিও না। কারণ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি, তিনি এক হাবশি গোলামকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন যে, তুমি তোমার চেহারাকে নামাযের মধ্যে ধূলো লাগা থেকে বারণ করিও না, বরং ধূলো-মাটি লাগতে দাও।

১. এখানে উম্মে সালমা (রাযি.) নামাযের মধ্যে ফুঁ দেয়া থেকে বারণ করার সাথে সাথে শরীয়তের হুকুম সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করার দিকেও লক্ষ্য করলেন।

২. এবং একথাও বুঝা গেল যে, অসৎকাজ থেকে বারণ করার মধ্যে কোমল ও স্পষ্ট ভাষী হও।

হযরত আয়েশা (রাযি.) কর্তৃক নিজের আত্মিয়কে পরের হক্ব নষ্ট করা থেকে বাধা প্রদান

ইমাম হাকেম মাইমুনা (রাযি.)এর ভাতিজা ইয়াযিদ ইবনে আছেম (রাযি.) থেকে হাদিস বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, হযরত আয়েশা (রাযি.) মক্কা থেকে প্রত্যাবর্তন কর ছিলেন, এমন সময় আমি এবং আয়েশা (রাযি.)এর ভাতিজা তার সামনে চলে এসে একটি বাগানের মধ্যে প্রবেশ করে ফল-ফলাদি ছিঁড়তে ছিলাম। আমাদের এ অবস্থা হযরত আয়শা (রাযি.) জানার পরে তিনি প্রথমে নিজ ভাতিজাকে তিরষ্কার করলেন। এরপর আমার দিকে দৃষ্টিপাত করে খুবই গুরুত্ব সহকারে পরের হক্ব নষ্ট করা থেকে বিরত থাকার জন্য নসীহত করলেন।

আরও পড়তে পারেন-

উপরোক্ত ঘটনার দ্বারা বুঝা গেল যে, যে কোন খারাপ বা গর্হিত কাজ থেকে প্রথমতঃ নিজ আত্মিয় ও আপনজনকে বারণ করতে হবে এবং তাকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে হবে।

হযরত মাইমুনা (রাযি.)এর আপন নিকটাত্মিয়কে ধমকী

ইমাম ইবনে সা’দ ইয়াযিদ ইবনে আসম থেকে বর্ণনা করেন যে, এক সময় হযরত মাইমুনা (রাযি.) তার মুখ থেকে শরাবের দুর্গন্ধ অনুভব করলেন। এবং বললেন যে, যদি এই অবস্থায় তুমি মুসলমানদের কাছে যাও, তাহলে অবশ্যই বেত্রাঘাত খাবে। আর ভবিষ্যতে কখনও আমার কাছে আসবে না।

সুতরাং বুঝা যেল যে, শরীয়তের হুকুম অনুযায়ী নিকটাত্মিয় হলেও সে যদি কোন অবৈধ কাজ করে, সাথে সাথে কঠোরভাবে বারণ করা উচিত। এর মধ্যে শৈথিল্যতা করা যাবে না।

এক মহিলার ইজ্জত হিফাযতের ঘটনা

ইমাম আব্দুর রাজ্জাক উবাইদ ইবনে উমাইর থেকে রেওয়াত নকল করেন যে, এক ব্যক্তি হোজাইল গোত্রে মেহমান হলেন। এবং তারা নিজেদের প্রথা অনুযায়ী মেহ্মানের সম্মানে তার সাথে একজন দাসীকে জঙ্গলের দিকে পাঠিয়ে দিল। অতঃপর মেহমান ঐ দাসীর পিছনে পিছনে চলা আরম্ভ করল। ইত্যবসরে মেহমান উক্ত দাসীর নিকট নিজের কু-প্রবৃত্তি চরিতার্থের ইচ্ছা পোষণ করলে বাঁদী খুবই কঠোরভাবে অস্বীকৃতি জানালেন।

কিন্তু তাতেও ক্ষান্ত না হওয়ায় শেষে অপারগ হয়ে বাঁদী একটা পাথর দিয়ে আঘাত করে উক্ত মেহামানের মাথাকে টুকরো টুকরো করে তাকে দুনিয়া থেকে চিরতরে বিদায় দিয়ে দিলেন। পরে বাঁদী ঘরে পৌঁছার পরে গৃহকর্তা ঘটনা জানতে পেরে হযরত ওমর (রাযি.)এর নিকট সবিস্তার বর্ণনা করলেন। হযরত ওমর (রাযি.) ঘটনার প্রকৃত তথ্য নিয়ে বাঁদীর কিসাস মাফ করে দিলেন। উপরোক্ত ঘটনার দ্বারা বুঝা গেল যে, প্রতিটি মহিলার জন্য নিজেদের সতীত্ব হিফাযত করা জরুরী। আর যদি ইজ্জত রক্ষা করা কাউকে আঘাত ছাড়া সম্ভব না হয়, তবে তা করাও জায়েয।

লেখকঃ বিশিষ্ট ইসলামী আইনবিদ, গবেষক, গ্রন্থ প্রণেতা এবং মুফতি ও সহযোগী পরিচালক- দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকবেন।