Home মহিলাঙ্গন এক মা যেভাবে তার মেয়ের ‘মৃত’ ধর্ষককে খুঁজে বের করলেন

এক মা যেভাবে তার মেয়ের ‘মৃত’ ধর্ষককে খুঁজে বের করলেন

গত বছরের এক ফেব্রুয়ারির সকাল। গঙ্গার তীরে শ্মশানঘাটে এসে পৌঁছল দুজন লোক।

লোক দুটো এসেছে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে। চিতায় জ্বালানোর জন্য লাকড়ি নিয়ে আসছিল তারা। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, লোক দুটোর সঙ্গে কোনো লাশ নেই।

তারা শ্মশানে পৌঁছার পর ঘটনা আরও গোলমেলে হয়ে গেল।

সঙ্গে নিয়ে আসা কাঠ দিয়ে লোক দুটো চিতা বানাল। তারপর একজন নিজেই শুয়ে পড়ল চিতার ওপর। সাদা কাপড়ে নিজের শরীর মুড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার সঙ্গী চিতায় কাঠ চড়াতে লাগল। অবশেষে প্রথম ব্যক্তির মাথাটা শুধু কাঠের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে, এমন অবস্থায় এসে থামল।

ওই দৃশ্যের দুটো ছবি তোলা হলো। ছবিগুলো কে তুলেছে কিংবা তৃতীয় কোনো ব্যক্তি ওখানে ছিল কি না, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।

‘মৃত’ লোকটির নাম নিরাজ মোদি। বয়স ৩৯। পেশায় স্কুলশিক্ষক। অপরজন তার বাবা, রাজারাম মোদি। বয়স ষাটের কিছু বেশি। পেশায় কৃষক।

যাহোক, ছবি তোলার পর্ব সমাধা হলে রাজারাম মোদি একজন আইনজীবীকে নিয়ে ১০০ কিলোমিটার দূরের একটি আদালতে গিয়ে হাজির হলেন। সেখানে গিয়ে হলফনামায় স্বাক্ষর করে বলেন যে, তার ছেলে নিরাজ মোদি ২৭ ফেব্রুয়ারি গ্রামে নিজ বাড়িতে মারা গেছেন। সঙ্গে প্রমাণ হিসেবে অন্ত্যেষ্টিকর্মের দুটো ছবি আর চিতার কাঠ কেনার রসিদও দাখিল করেন।

এই ঘটনা নিরাজ মোদির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ গঠনের ছয় দিন পরের। নিরাজের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ১২ বছর বয়সি এক মেয়েকে ধর্ষণ করার অভিযোগ ছিল। মেয়েটি ছিল তার ছাত্রী।

মেয়েটিকে আখ খেতে একা পেয়ে ধর্ষণ করেন নিরাজ। তারপর তাকে হুমকি দিয়ে বলেন, ধর্ষণের ঘটনা ভিডিও করে রেখেছেন, কাউকে কিছু বললে সেটি অনলাইনে ছড়িয়ে দেবেন।

মেয়েটির মা পুলিশে অভিযোগ করলে দ্রুতই নিরাজকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে দুই মাস জেল খাটার পরই জামিনে বেরিয়ে আসেন অভিযুক্ত।

গত বছর নিরাজ মোদির ‘মৃত্যুর’ পর ঘটনা দ্রুত ঘটতে থাকে। তার বাবা আদালতে ছেলের ‘মৃত্যুর’ খবর জানানোর পর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তার ডেথ সার্টিফিকেট দেয়। ‘মামলার একমাত্র অভিযুক্ত’ মারা যাওয়ায় মে মাসে আদালত মামলাটি বন্ধ করে দেন।

তখন কেবল একজন মানুষই সন্দেহ করেছিলেন যে নিরাজ সাজা এড়ানোর জন্য নিজের ভুয়া মৃত্যু সাজিয়ে ফেরার হয়েছেন। ওই মানুষটি ভুক্তভোগীর মা।

তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘নিরাজ মোদির মৃত্যুর খবর পাওয়ামাত্রই বুঝেছিলাম এটা ডাহা মিঠা। আমি জানতাম লোকটা বেঁচে আছে।’

ভারতে শহরের চেয়ে গ্রামে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। এবং দেশটির ৫৪ বছরের পুরনো আইন অনুসারে জন্ম মৃত্যু নিবন্ধন করানো বাধ্যতামূলক—তবে মৃত্যুর কারণ নিবন্ধন করানো বাধ্যতামূলক নয়।

বিহারের কোনো গ্রামে কেউ মারা গেলে তার পরিবারের সদস্যকে মৃতের ইউনিক বায়োমেট্রিক আইডেন্টিটি নাম্বার জমা দিতে হয়। এছাড়া মৃত্যু সত্যায়িত করার জন্য গ্রামের পাঁচজন বাসিন্দার স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হয়।

এসব জমা দিতে হয় স্থানীয় পঞ্চায়েতে। স্থানীয় রেজিস্ট্রারসহ পঞ্চায়েতের সদস্যরা কাগজপত্র যাচাই করেন। সবকিছু ঠিক থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে তারা ডেথ সার্টিফিকেট দেন।

ধর্ষণের শিকার মেয়েটির আইনজীবী জয় করণ গুপ্তা বলেন, ‘আমাদের গ্রামগুলো খুব ঘনবসতিপূর্ণ আর কাছাকাছি। এখানে সবাই সবাইকে চেনে। তাই কারও মৃত্যু হলে সে খবর কারও অজানা থাকে না।’

রাজারাম মোদি তার ছেলেকে মৃত বলে ঘোষণা দেওয়া হলফনামাসহ পাঁচজন গ্রামবাসীর স্বাক্ষর ও বায়োমেট্রিক আইডেন্টিটি নাম্বার জমা দেন। এরপর ছেলের ডেথ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেন। কাগজে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ ছিল না। লাকড়ির দোকানের রসিদে লেখা ছিল নিরাজের মৃত্যুর কারণ ‘অসুখ’।

গত মে-র একদিন ওই মেয়ের মা একজন উকিলের কাছ থেকে জানতে পারেন, নিরাজ মোদির মারা যাওয়ায় তার বিরুদ্ধে করা মামলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

তখনই ওই মায়ের মনে প্রশ্ন জাগে, একজন শিক্ষকের মৃত্যুর খবর কেউ পেল না কেন? মৃত্যুর পর কোনো আচার-প্রথা পালন করা হলো না কেন? আর মৃত্যু নিয়ে কোনো কথাই বা হলো না কেন?

এরপর ওই মা ঘরে ঘরে গিয়ে জানতে চান নিরাজ আসলেই মারা গেছেন কি না। কিন্তু কেউই খবরটা শোনেনি। এরপর তিনি মামলার পুনঃতদন্তের আরজি নিয়ে আদালতে গেলেন। কিন্তু বিচারক শিক্ষকের বেঁচে থাকার প্রমাণ চাইলেন।

মে মাসের মাঝামাঝি নাগাদ ওই ছাত্রীর মা একজন সিনিয়র স্থানীয় কর্মকর্তার কাছে এই বলে আবেদন করেন যে গ্রাম পঞ্চায়েত ভুয়া কাগজপত্রের ভিত্তি ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছে। এর তদন্ত হওয়া দরকার।

আবেদন পেয়ে ওই কর্মকর্তা তদন্তের আদেশ দিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতকে জানান। পঞ্চায়েত সদস্যরা এবার রাজারাম মোদির কাছে তার ছেলের মৃত্যু-সংক্রান্ত আরও প্রমাণাদি চাইলেন—মৃত্যুর পর মৃতের ছবি, এছাড়া শবদাহ, জ্বলন্ত চিতা, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ছবি এবং নতুন পাঁচজন সাক্ষীর সাক্ষ্য।

আরও পড়তে পারেন-

পঞ্চায়েত সদস্য প্রায় ২৫০ গ্রামবাসীর বাড়িতে যান। কোনো বাসিন্দায় নিরাজ মোদির মৃত্যুর খবর শোনেনি। নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর পর হিন্দুরা সাধারণত মাথা কামান। কিন্তু মোদি পরিবারের একজনও মাথা কামাননি।

ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর মেয়েটির স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ছবি: স্বস্তিক পাল
তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা রোহিত কুমার পাসওয়ান বিবিসিকে জানান, ‘এমনকি নিরাজ মোদির আত্মীয়-স্বজনরাও তার মৃত্যুর অথবা তিনি কোথায় আছেন, সে খবর জানত না। তারা বারবার বলেছে, কেউ মারা গেলে বাড়িতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হতো।’

গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যরা আবারও রাজারাম মোদিকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। ছেলের মৃত্যু-সংক্রান্ত নতুন কোনো প্রমাণাদি দিতে পারলেন না তিনি। কোনো প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তরও দিতে পারলেন না।

তদন্তে সিদ্ধান্তে আসা হয়, নিরাজ মোদি নিজেকে মৃত সাজিয়ে বাবা-ছেলে মিলে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট নিয়েছেন।

পুলিশ জানতে পারে, নিরাজ তার পাঁচজন শিক্ষার্থীর বাবা-মায়ের বায়োমেট্রিক আইডেন্টিটি নাম্বার নিয়ে তাদের স্বাক্ষর নকল করে নিজের ডেথ সার্টিফিকেট নেন। শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়েদের বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের বৃত্তির জন্য তাদের সই প্রয়োজন।

২৩ মে কর্মকর্তারা নিরাজ মোদির ডেথ সার্টিফিকেট বাতিল করেন। পুলিশ তার বাবাকে গ্রেপ্তার করে তার বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ আনে।

জুলাইয়ে আদালত ধর্ষণ মামলা ফের চালু করেন। ভুক্তভোগীর মা অভিযুক্তের গ্রেপ্তার চেয়ে আদালতে যান।

অক্টোবরে, মৃত ঘোষষিত হওয়ার নয় মাস পর, নিরাজ মোদি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। বিচার চলার সময় তিনি ধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করেন। যদিও তাতে শেষ রক্ষা হয়নি।

গত মাসে ওই মেয়েকে ধর্ষণের জন্য নিরাজ মোদিকে দোষী সাব্যস্ত করেন আদালত। তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সঙ্গে ভুক্তভোগীকে ৩ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। প্রতারণা ও অসততার অভিযোগে রাজারাম মোদিও জেল খাটছেন। বাবা-ছেলে দুজনেই এখন ডেথ সার্টিফিকেট জালিয়াতির অভিযোগের মোকাবিলা করছেন।

ভুক্তভোগীর মা বলেন, ‘তিন বছর আমি আদালতে দৌড়াদৌড়ি করেছি আমার মেয়েকে ধর্ষণ করা লোকটির শাস্তি নিশ্চিত করতে। অথচ একদিন উকিল বললেন লোকটা মারা গেছে। একটা লোক হুট করে এভাবে বাতাসে মিলিয়ে যায় কী করে?

‘উকিল বলেছিলেন তার মৃত্যু যে ভুয়া, তা প্রমাণ করার জন্য নতুন মামলা চালাতে প্রচুর টাকা লাগবে। অন্যরা বলেছে, লোকটা জেল থেকে বেরিয়ে প্রতিশোধ নেবে।

‘আমি কোনো কিছু পরোয়া করিনি। বলেছি, আমি টাকার ব্যবস্থা করব। আমি ভয় পাচ্ছি না।’

এই মা দুই স্কুলপড়ুয়া ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে ছোট্ট একটা জানালাবিহীন ইটের তৈরি বাড়িতে থাকেন। অন্ধকার, বিষণ্ণ ঘরটি প্রায় ফাঁকা। আসবাব বলতে একটা দড়ি আর কাঠের খাট, একটা ইস্পাতের কলস, একটা মাটির চুলা আর কিছু কাপড়চোপড়। এই পরিবারের কোনো জমিজমাও নেই।

গ্রামটিতে বিদ্যুৎ ও পাইপের পানি আছে, কিন্তু কোনো চাকরি নেই। এ কারণে মেয়েটির বাবাকে কাজের সন্ধানে ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ ভারতের এক রাজ্যে পাড়ি জমাতে হয়েছে।

২০১৯ সালে এক বিশাল শৌচাগার কর্মসূচি শেষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা দেন, ভারতের কোনো গ্রামেই এখন আর উন্মুক্ত জায়গায় মলত্যাগ করা হয় না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এখনও দেশটির বহু বাড়িতে শৌচাগার নেই। নেই ওই মেয়েটির বাড়িতেও।

এ কারণেই মেয়েটি আখ খেতে গিয়েছিল শৌচকর্ম সারতে। ওই সময়ই নিরাজ মোদি তার মুখ চেপে ধরে ধর্ষণ করেন। ধর্ষণের ভিডিও-ও ধারণ করেন তিনি। তারপর বাচ্চা মেয়েটিকে হুমকি দেন, কাউকে কিছু জানালে ওই ভিডিও ভাইরাল করে দেবেন।

ঘটনার পরদিন আতঙ্কিত মেয়েটি মাকে সব খুলে বলে। সব শুনে তার মা পুলিশের কাছে যান। ওই মেয়ে পুলিশকে জানায়, ‘নিরাজ মোদি আমাকে প্রায়ই স্কুলে মারেন।’

নিরাজ মোদি গ্রেপ্তার হওয়ার পর মেয়েটি ফের স্কুলে যাওয়া শুরু করে। কিন্তু তিনি জামিনে বেরিয়ে এলে সে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। গত চার বছর ধরে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ। তার স্কুলের বইপত্র ভাঙারিওয়ালার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।

মেয়েটির এখন বেশিরভাগ সময় কাটে অন্ধকার ঘরে। তার মা বিবিসিকে বলেন, ‘ওর শিক্ষাজীবন তো শেষ। ওকে বাইরে যেতে দিতে সাহস পাই না। আশা করছি ওকে বিয়ে দিতে পারব।’

এখনও অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। ঠিকমতো যাচাই না করে গ্রাম পঞ্চায়েত নিরাজের ডেথ সার্টিফিকেট দিল কী করে? ওই মা বলেন, ‘আমি পরে তাদের চ্যালেঞ্জ করলে তারা বলেন যে ভুল করে ফেলেছেন।’

এই সাহসী মা বলেন, ‘সত্যটা বের করে আনার জন্য গ্রাম পঞ্চায়েত ও কর্মকর্তাদের কাছে তদবির করেছি আমি। যে লোক আমার মেয়েকে ধর্ষণ করেছে এবং ওর জীবনে দাগ ফেলেছে, সে যে এখন জেলে তাতে আমি খুশি।

‘কিন্তু আমার মেয়ের জীবন তো শেষ হয়ে গেল। ওর কী হবে?’

সূত্র: বিবিসি

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।