ইসলামের প্রথম যুগে নারী সাহাবিয়্যাগণের দান-সদকা

।। আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন ।।

উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রাযি.)এর খেদমতে একবার দেরহাম ভর্তি দু’টি বস্তা পেশ করা হল। যার মধ্যে এক লক্ষেরও বেশী দেরহাম ছিল। হযরত আয়েশা (রাযি.) একটি থালা এনে তা ভর্তি করে সাদকা করতে লাগলেন। এমনকি সন্ধ্যার মধ্যেই সব শেষ করে দিলেন। একটি দেরহামও নিজের কাছে বাকী রাখলেন না। ঐদিন তিনি রোযা ছিলেন, ইফতারের সময় বাঁদীকে বললেন, ইফতারের জন্য কিছু আন। সে একটি রুটি ও যায়তুনের তৈল নিয়ে আসল এবং বলতে লাগল, যদি এক দেরহাম দিয়ে কিছু গোশত আনতেন, তাহলে ভাল হত, আজ আমরা গোশত দ্বারা ইফতার করতাম। উত্তরে তিনি বাঁদীকে বললেন, এখন বললে কি হবে? ঐ সময় আমাকে স্মরণ করালে আমি খরিদ করিয়ে আনতাম।

এভাবে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর কাছে হাদিয়া আসলে তিনি উহা সদকা করে দিতেন। অথচ সদকা করে নিজে কষ্ট করতেন এবং অসচ্ছল জীবন যাপন করতেন।

তাঁর এভাবে দান করা এবং কষ্ট ভোগ করা দেখে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাযি.) (যিনি হযরত আয়েশার ভাগিনা ছিলেন) চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং একবার বললেন, খালাম্মার হাতকে বাঁধা দেওয়া চাই। এ খবর হযরত আয়েশার কানে পৌঁছলে তিনি হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবাইরের প্রতি অসন্তুষ্ট হলেন। এমনকি তার সাথে কথা বলবেন না বলে মান্নত স্বরূপ কসম খাইলেন। খালার অসন্তুষ্টিতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর অত্যš বেদনাহত হলেন। এবং অনেক লোকের মাধ্যমে সুপারিশ করালেন। কিন্তু হযরত আয়েশা (রাযি.) নিজের কসমের ওযর পেশ করলেন।

অবশেষে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর যখন অত্যন্ত পেরেশান ও চিন্তিত হয়ে পড়লেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মাতৃবংশের দু’জন ব্যক্তিকে সুপারিশকারী হিসাবে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। তারা উভয়ে অনুমতি নিয়ে ভিতরে গেলেন। তিনিও গোপনে তাদের সাথে গেলেন। যখন তারা দুইজন পর্দার আড়াল থেকে হযরত আয়েশার সাথে কথা-বার্তা বলতে লাগলেন, তখন তিনি দ্রুত পর্দার ভিতরে গিয়ে খালাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতে লাগলেন এবং অনুনয়-বিনয় করলেন।

উক্ত দুই ব্যক্তিও সুপারিশ করতে থাকল। এবং মুসলমানদের সাথে কথোপকথন বন্ধ করে দেয়া সম্পর্কিত হুযূর (সা.)এর হাদীস স্মরণ করাতে থাকলেন। এ সম্পর্কে যে সব নিষেধাজ্ঞা হাদীসে এসেছে, তাও শুনাতে থাকলেন। যার ফলে হযরত আয়েশা (রাযি.) মুসলমানদের সাথে কথা বন্ধ রাখা সম্পর্কে হাদীস শরীফে যে সকল নিষেধাজ্ঞা ও শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে উহা সহ্য করতে না পেরে কাঁদতে লাগলেন। অবশেষে আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরকে ক্ষমা করে দিলেন এবং কথা বলা শুরু করলেন। কিন্তু তার সেই কসমের কাফফারা স্বরূপ বারবার গোলাম আযাদ করতে থাকেন, এমনকি চল্লিশ জন গোলাম পর্যন্ত আযাদ করলেন। আর যখনই ঐ কসম ভঙ্গ করার কথা স্মরণ হত, তখন এত কাঁদতেন যে, চোখের পানিতে ওড়না পর্যন্ত ভিজে যেত।

এই ছিল উম্মুল মু’মিনীনের সাদকার অবস্থা। তাঁর সদকার এমন অবস্থা হওয়া সত্ত্বেও তিনি বলতেন; হায়! আমি যদি বৃক্ষ হতাম, সর্বদা তাসবীহ পাঠে রত থাকতাম, আর আখেরাতে আমার কোন হিসাব হত না। হায়! আমি যদি পাথর হতাম। হায়! আমি যদি মাটির ঢিলা হতাম। হায়! আমি যদি সৃষ্টিই না হতাম, হায়! আমি যদি গাছের পাতা হতাম, হায়! আমি যদি ঘাস হতাম। তার খোদাভীতির অবস্থা এমনই ছিল।

আরও পড়তে পারেন-

• ধর্ষণ প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা
• কিশোর অপরাধ রোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে
• আদর্শ পরিবার গঠনে যে সব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরী
• ইসলামে সামাজিক সম্পর্ক এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখার গুরুত্ব
• মানুষ মারা যাওয়ার পর, তাঁর আত্মার কি হয় ?

তদ্রুপ হযরত আসমা (রাযি.)ও বড় দানশীলা ছিলেন। প্রথমে তিনি যা কিছু খরচ করতেন, আনুমানিক হিসাব করে খরচ করতেন। কিন্তু যখন হুযূর (সা.) বললেন, বেঁধে বেঁধে রেখে দিবে না, হিসাব করবে না এবং সামর্থানুযায়ী খরচ করতে থাক। তারপর খুব খরচ করতে লাগলেন। তিনি আপন কন্যাদেরকে এবং ঘরের অন্যান্য মহিলাদেরকে উপদেশ দিতেন যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করতে এবং সাদকা করতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়ার এবং বেঁচে যাওয়ার অপেক্ষা করবে না। যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়ার অপেক্ষা করতে থাক, তবে তা কখনো হবে না। কেননা প্রয়োজন স্বয়ং বাড়িতে থাকে। আর যদি সদকা করতে থাক, তবে সদকার মধ্যে খরচ করে দেওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

হযরত উম্মে সালমার সাদকা করার আদেশ

আল্লামা হাফেজ ইবনে আব্দুর রব উম্মে হুসাইন (রাযি.) থেকে নকল করেন যে, উম্মে হুসাইন ইরশাদ করলেন, আমি উম্মে সালমা (রাযি.)এর কাছে বসা ছিলাম। ইতিমধ্যে দরিদ্রদের একটা দল তার কাছে আসল এবং সাহায্য চাইতে শুরু করল। তাদের মধ্যে মহিলাও ছিল। উম্মে হুসাইন বললেন, চলে যাও, চলে যাও। একথা শুনে উম্মে সালমা তৎক্ষণাৎ বললেন, হে আল্লাহর বাঁদী! এ কী রকম কথা বললে? তাদের প্রত্যেককে কিছু কিছু সাদকা দিয়ে দাও। কমপক্ষে একটা খেজুর হলেও তাদের হাতে দিয়ে দাও। এটাই ছিল তাদের সাদকার ব্যাপারে গুরুত্ব, যা পয়গাম্বর (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন।

মহিলাদের যুদ্ধে অংশ গ্রহণের কতিপয় দৃষ্টান্ত

হুযূর (সা.)এর যামানায় পুরুষদের তো জিহাদে শরীক হওয়ার আগ্রহ ছিলই, সাথে সাথে মহিলাদের আগ্রহও পুরুষদের চেয়ে কম ছিল না। তারা সব সময় আগ্রহী থাকতেন। যেখানে সুযোগ পেতেন পৌঁছে যেতেন। উম্মে যিয়াদ (রাযি.) বলেন, আমরা ছয় জন মহিলা খাইবারের যুদ্ধে শরীক হওয়ার জন্য রওয়ানা হলাম। হুযূর (সা.) সংবাদ পেয়ে আমাদেরকে ডাকলেন। হুযূরের নূরানী চেহারায় রাগের চিহ্ন পরিলক্ষিত হচ্ছিল। অতঃপর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কার অনুমতি নিয়ে এবং কার সাথে এসেছ? আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা পশম বুনতে জানি। জিহাদে উহার প্রয়োজন হয়। আমাদের সাথে জখমের ঔষধও রয়েছে। আর কিছু না হোক, মুজাহিদদের কাছে তীর পৌঁছে দেওয়ার কাজে সাহায্য করা যেতে পারে। ছাতু ইত্যাদি গুলানো এবং পান করানোর ব্যাপারে সাহায্য করব। অতঃপর হুযূর (সা.) আমাদেরকে অংশ গ্রহণের অনুমতি দিলেন।

হযরত উম্মে হারাম (রাযি.)এর সামুদ্রিক যুদ্ধে শরীক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা

তিনি হযরত আনাস (রাযি.)এর খালা ছিলেন। হুযূর (সা.) প্রায়ই তার ঘরে তাশরীফ নিতেন এবং কখনো দুপুরে সেখানেই বিশ্রাম নিতেন। একদা হুযূর (সা.) তার ঘরে আরাম করছিলেন। হঠাৎ মুচকি হেসে ঘুম হতে জাগ্রত হলেন। উম্মে হারাম (রাযি.) আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! আপনার উপর আমার পিতা-মাতার কোরবান হোক। আপনি কি জন্য মুচকি হাসছিলেন?

হুযূর (সা.) প্রত্যুত্তরে বললেন, আমাকে আমার উম্মতের কিছু লোক দেখানো হয়েছে, যারা সমুদ্র পথে যুদ্ধের জন্য এমনভাবে সাওয়ার হয়েছে, যেন সিংহাসনে বাদশা বসে আছে। উম্মে হারাম (রাযি.) আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! দোয়া করুন, আল্লাহ যেন আমাকেও তাদের মধ্যে শামিল করেন। হুযূর (সা.) বললেন, তুমিও তাদের মধ্যে শামিল থাকবে। অতঃপর হুযূর (সা.) পুণরায় ঘুমাচ্ছিলেন এবং কিছুক্ষণ পর আবার মুচকি হেসে ঘুম হতে জাগ্রত হলেন।

উম্মে হারাম (রাযি.) হাসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি আবার অনুরূপ উত্তর দিলেন। উম্মে হারাম (রাযি.) পুণরায় নিজে তাদের মধ্যে শরীক হওয়ার জন্য হুযূর (সা.)এর কাছে দোয়া চাইলেন। হুযূর (সা.) বললেন, তুমি প্রথম দলে থাকবে। অতঃপর হযরত উসমানের খেলাফত কালে হযরত মুয়াবিয়া (রাযি.) সিরিয়ার গভর্ণর ছিলেন।

তিনি জাযায়েরে কাবরাস বা সাইপ্রাস দ্বীপ আক্রমণের অনুমতি চাইলেন। হযরত উসমান (রাযি.) অনুমতি দিলেন। আমীরে মুয়াবিয়া (রাযি.) একদল সেনা নিয়ে আক্রমণ করলেন, যাতে উম্মে হারাম ও তার স্বামী উবাদা (রাযি.)ও শরীক ছিলেন। ফেরার সময় তিনি একটি খচ্চরের উপর সাওয়ার হচ্ছিলেন, এমতাবস্থায় খচ্চর লাফিয়ে উঠলে তিনি পড়ে যান এবং ঘাড় ভেঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর সেখানেই তাকে দাফন করা হয়।

লেখকঃ বিশিষ্ট ইসলামী আইনবিদ, গবেষক, গ্রন্থ লেখক, মুহাদ্দিস এবং সহযোগী পরিচালক- দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকবেন।