Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ‘যাকাত’ গরীবদের প্রতি অনুকম্পা নয়, বরং সম্পদকে পরিশুদ্ধ করার অনন্য মাধ্যম

‘যাকাত’ গরীবদের প্রতি অনুকম্পা নয়, বরং সম্পদকে পরিশুদ্ধ করার অনন্য মাধ্যম

।। শায়খুল হাদীস মাওলানা তাজুল ইসলাম আশরাফী ।।

ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে যাকাত। আরবী ‘যাকাত’ শব্দের বাংলা অর্থ হচ্ছে- পবিত্রতা, প্রবৃদ্ধি, কোন বস্ত্তর উত্তম অংশ, বরকত ইত্যাদি। সম্পদশালী ব্যক্তিগণের উপরই কেবল যাকাত ফরয। যারা নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদের মালিক হবেন, বছরান্তে তারা নির্দিষ্ট অংশ শরী‘আত নির্ধারিত খাত সমূহে বণ্টন করবেন। অপরদিকে ‘ছাদাক্বা’ বলা হয় স্বেচ্ছা প্রদত্ত ঐ দানকে, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয়। শারঈ পরিভাষায় যাকাত ও ছাদাক্বা একই মর্মার্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আপনি তাদের মাল-সম্পদ হতে ছাদাক্বা (যাকাত) গ্রহণ করুন, যা তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে’ (তওবা ১০৩)।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,পাঁচ অসাক্ব খেজুরের নীচে কোন ছাদাক্বা (যাকাত) নেই’। উপরোক্ত আয়াত ও হাদীছে যাকাত ও ছাদাক্বাকে একই অর্থে বুঝানো হয়েছে। তবে প্রচলিত অর্থে যাকাত অপরিহার্য দান এবং ছাদাক্বা স্বেচ্ছা দান বা নফল দান হিসাবে পরিচিত।পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে যাকাত আদায়ের পুরস্কারের কথা যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি যাকাত আদায় না করার কঠোর শাস্তির কথাও বিধৃত হয়েছে। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে যাকাত ও ছাদাক্বা আদায়ের শারঈ বিধান ও তা অনাদায়ের পরিণতি সস্পর্কে আলোকপাত করা হল-

যাকাতের গুরুত্ব : যাকাত আদায়ের গুরুত্ব অত্যন্ত ব্যাপক। পবিত্র কুরআন মাজীদে ৮২ জায়গায় ছালাতের সাথে যাকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।ছালাত ও ছিয়ামের ন্যায় যাকাতও সামর্থ্যবানদের উপর ফরয। যাকাত সম্পদকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করার একমাত্র মাধ্যম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ছাদাক্বার মাধ্যমে তোমাদের পীড়ার চিকিৎসা কর, যাকাত আদায়ের মাধ্যমে তোমাদের সম্পদকে সুরক্ষিত (পরিশুদ্ধ) কর এবং দো‘আর মাধ্যমে বালা-মুছীবত থেকে বাঁচার প্রস্ত্ততি গ্রহণ কর’।

আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি হাছিল ও তাঁর ক্রোধ থেকে নিষ্কৃতির মাধ্যমও এটি। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই ছাদাক্বা আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধকে নির্বাপিত করে দেয়’। সরকারকে যেমন আয়কর দিতে হয়, তেমনি উপার্জিত ও উৎপন্ন দ্রব্য থেকে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারিত অংশ তথা ‘যাকাত’ প্রদান করতে হয়। সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার কারণে যেমন সাময়িক হ’লেও দুনিয়াবী শাস্তি নেমে আসে, তেমনি আল্লাহর ট্যাক্স তথা ‘যাকাত’ ফাঁকি দিলেও দুনিয়াবী এবং পারলৌকিক উভয় শাস্তি নেমে আসে। যাকাত হকদারদের প্রতি কোন অনুগ্রহ নয় (বাক্বারাহ ২৬৪), বরং তা তাদের প্রাপ্য অংশ। যা অতি দ্রুততার সাথে তাদেরকে দিয়ে নিজেকে দায়মুক্ত করা আবশ্যক। এটা ‘ইবাদতে মালী’ বা অর্থনৈতিক ইবাদত। যা অন্যান্য ফরয ইবাদতের ন্যায় আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত।

সুতরাং যাকাত আদায়ের কোন বিকল্প নেই। ইসলামের সোনালী যুগে ছাহাবায়ে কেরাম যাকাতের প্রতি সর্বাধিক যতœবান ছিলেন। হযরত আবুবকর (রাঃ) যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।[৬] আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ছালাত কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর। আর যা কিছু ভাল আমল নিজের জন্য অগ্রে পাঠাবে বা সঞ্চয় করবে, তা আল্লাহর নিকটে পাবে। তোমরা যা আমল কর আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন’ (বাক্বারাহ ১১০)। অন্যত্র হে ঈমানদারগণ তোমরা তোমাদের উপার্জিত হালাল মালের কিছু অংশ এবং আমি যা তোমাদের জন্য যমীন হ’তে বের করেছি তার অংশ খরচ কর’ (বাক্বারাহ ২৬৭)। আল্লাহ আরো বলেন,‘এবং তোমরা আদায় কর এর হক্ব (ওশর) শস্য কাটার সময়’ (আন‘আম ১৪১)।

আরও পড়তে পারেন-

সূদ সমাজের অর্থ-সম্পদকে শোষণ করে এক বা একাধিক স্থানে জমা করে রাখে। কিন্তু যাকাত ও ছাদাক্বা তা জনসাধারণ্যে ছড়িয়ে দেয় ও হকদারগণকে ক্রয়ক্ষমতার অধিকারী বানায়। এর ফলে সম্পদ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। আল্লাহ বলেন,আল্লাহ সূদকে নিশ্চিহ্ন করেন ও ছাদাক্বাকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কাফের ও পাপীকে ভালবাসেন না’ (বাক্বারাহ ২৭৬)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ছাদাক্বাহ বা যাকাত সম্পদ হ্রাস করে না’।

সুতরাং যাকাত প্রদানে দৃশ্যত সম্পদ কমে যায় মনে হ’লেও বাস্তবে সম্পদ বেড়ে যায়। আর তা দু’ভাবে হ’তে পারে। এক- সমাজের অনাথ-গরীবরা যাকাত দাতার যাকাত পেয়ে তারই কারখানার উৎপাদিত পণ্য ক্রয়ে সামর্থ্যবান হয়ে ওঠে। এভাবে যাকাত প্রদানের ফলে যাকাতদাতার উৎপাদন বেড়ে যায়। ফলতঃ তার সম্পদ বেড়ে যায়। দুই- আল্লাহ তা‘আলা যাকাত প্রদানের পুরস্কার স্বরূপ নিজ অনুগ্রহে তা বাড়িয়ে দেন। অর্থাৎ তাতে বরকত নাযিল করেন। ফলে তার উৎপাদন বেড়ে যায়।

যাকাত আদায়ের উপকারিতা: যাকাত আদায়ের ফলে ব্যক্তির নৈতিক ও মানসিক উন্নতি সাধিত হয়। সমাজে শ্রেণীবৈষম্য বিদূরিত হয়। গড়ে ওঠে অসহায় গরীব ও বিত্তবানদের মধ্যে এক সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক। হ্রাস পায় গাছতলা ও পাঁচতলার ভেদাভেদ। যাকাত ধনী-গরীবের মধ্যে পারষ্পরিক সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করে। যাকাত আদায়ের ফলে অন্তর পরিষ্কার ও পরিশুদ্ধ হয় এবং কৃপণতার মত ঘৃণ্য চরিত্র থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। আল্লাহ বলেন, ‘আপনি তাদের সম্পদ হ’তে ছাদাক্বাহ (যাকাত) আদায় করুন, যা তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে’ (তওবা ১০৩)।

যাকাত ব্যক্তিকে দানশীল, মহানুভব, অভাবে জর্জরিত বঞ্চিত মানবতার প্রতি দয়া পরবশ হ’তে অভ্যস্ত করে। আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকত ও বিনিময় লাভ করা যায়। গোনাহ সমূহ মোচন হয়।যাকাত প্রদানের কারণে অর্থের অন্ধ মোহ হ্রাস পায় ও কৃপণতা হ’তে মুক্ত হওয়া যায়। অপচয় থেকে মুক্ত থাকা যায় ও গরীব-দুঃখীদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব হয়।

যাকাত আদায়ের পুরস্কার: পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে যাকাত আদায়কারীদের জন্য তাদের সম্পদ বৃদ্ধি ও পবিত্রকরণ ছাড়াও মহা পুরস্কারের কথা বিঘোষিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, আর যারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, আমি তাদেরকে মহাপুরস্কার দেব। ‘যারা ছালাত প্রতিষ্ঠাকারী, যাকাত প্রদানকারী হবে, তাদেরকে সত্বর মহান পুরস্কারে ভূষিত করা হবে’ (নিসা ১৬২)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘তোমরা যাকাত দেওয়ার সময় যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে থাক, তাহ’লে তোমরা দ্বিগুণ প্রাপ্ত হবে’ (রূম ৩৯)।

‘আর তোমরা যা ব্যয় করবে আল্লাহ তার প্রতিদান দিবেন, তিনি উত্তম রূযীদাতা’ (সাবা ৩৯)! যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, অতঃপর যা ব্যয় করে তজ্জন্য কৃপা প্রকাশ না করে এবং কষ্ট না দেয়, তাদের জন্য তাদের প্রভুর নিকট পুরস্কার রয়েছে। বস্তুত: তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুর্ভাবনাগ্রস্তও হবে না’ (বাক্বারাহ ২৬২)। তোমরা উত্তম সম্পদ হ’তে যা ব্যয় করবে তার পুরস্কার পুরোপুরি পেয়ে যাবে। আর তোমাদের প্রতি কোন প্রকার যুলুম করা হবে না’ (বাক্বারাহ ২৭২)।

যারা রাতে ও দিনে, গোপনে ও প্রকাশ্যে নিজেদের ধন-সম্পদগুলো ব্যয় করে, তাদের প্রভুর নিকট তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না’ (বাক্বারাহ ২৭৪)। যাকাত প্রদানে সম্পদ বৃদ্ধির দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে তাদের দৃষ্টান্ত একটি শস্যবীজের ন্যায়। যা হ’তে উৎপন্ন হয় সাতটি শীষ এবং প্রত্যেক শীষে একশত করে শস্যদানা। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা আরো বর্ধিত করে দেন। আল্লাহ মহান দাতা ও মহাজ্ঞানী’ (বাক্বারাহ ২৬১)। হাদীছে কুদসীতে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি দান কর, আমি তোমাকে দান করব’।

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর বা তার সমপরিমাণ কিছু দান করল, আর আল্লাহ হালাল ব্যতীত কিছু কবুল করেন না, আল্লাহ তা‘আলা তা নিজ ডান হাতে গ্রহণ করেন। অতঃপর দানকারীর জন্য তা বৃদ্ধি করতে থাকেন, যেভাবে তোমাদের কেউ ঘোড়ার বাচ্চাকে লালন-পালন করে তা বৃদ্ধি করতে থাক, এমনকি তা পাহাড় সমান হয়ে যায়’। অতএব যাকাত আদায়ের ফলে একদিকে যেমন সম্পদ পবিত্র ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, তেমনি যাকাত আদায়কারীর জন্য রয়েছে অফুরন্ত ছওয়াব। যা তার পরকালীন নাজাতকে নিশ্চিত করে। আল্লাহ তা‘আলা যাকাত প্রদানকারীর জন্য সম্পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি মহা পুরস্কারের সুসংবাদ প্রদান করেছেন। অতএব জান্নাতপিয়াসী ভাই-বোনেরা সঠিকভাবে যাকাত আদায়ে যতœবান হবেন কি?

যাকাত আদায় না করার পরিণতি: পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ সমূহে যাকাত আদায়কারীদের জন্য যেমন মহা পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে, তেমনি যাকাত আদায় না করারও ভয়াবহ শাস্তির কথা বিধৃত হয়েছে। নি¤েœাক্ত আয়াত ও হাদীছ থেকে যা পরিস্কারভাবে জানা যায়। আল্লাহ বলেন, যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে, তা থেকে আল্লাহর পথে খরচ করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও। সেদিন ঐগুলোকে জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে এবং তদ্বারা তাদের কপালে, পার্শ্বদেশে ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে (আর বলা হবে) এটা সেই মাল, যা তোমরা নিজেদের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছিলে। অতএব তোমরা এর স্বাদ আস্বাদন কর’ (তওবা ৩৪-৩৫)।

অতএব, সাবধান হে মুসল্লীগণ! যাকাত আদায় না করার এই করুণ পরিণতি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য সময় থাকতেই প্রস্ত্ততি গ্রহণ করুন। মালের মুহাববত চূর্ণ করে আপনার মালের উপর আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত অংশ হকদারদের নিকটে পৌঁছে দিয়ে নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে সার্বিকভাবে চেষ্টিত হউন।

লেখক: শায়খুল হাদিস- তিলপাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা, খিলগাঁও, ঢাকা ও মিফতাহুল উলূম মাদ্রাসা, বাড্ডা, ঢাকা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক- সানমুন ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস, নয়াপল্টন, ঢাকা।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।