Home ফিকহ ও মাসায়েল ঈদ-উল-ফিতর: ফাযায়েল ও মাসায়েল

ঈদ-উল-ফিতর: ফাযায়েল ও মাসায়েল

- মাওলানা কবীর আহমদ (দা.বা.)।

।। আল্লামা কবীর আহমদ ।।

প্রতি বছরের মতো আমাদের মাঝে আবারও ফিরে আসছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় আনন্দ উৎসবের দিন পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। এই ঈদ ফিরে আসে কল্যাণের এক অমিয় সওগাত নিয়ে। সাম্য-মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের মহামিলনের অমিয় সওগাত নিয়ে। এই তাৎপর্যময় ঈদ-উল-ফিতর আবারো মুসলিম উম্মাহর দোরগোড়ায় উপস্থিত হয়েছে।

ঈদ মুসলমানদের জন্য আল্লাহর দেওয়া এক অফূরন্ত নিয়ামত। এ দিনে সবার মুখেই থাকে হাসি। চতুর্দিকে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। সবার মন থাকে প্রফুল্ল। ঈদের নামায পড়তে যাই আমরা ঈদগাহে স্ব-স্ব সামর্থ্য অনুযায়ী সুন্দর সুন্দর পোশাক পরে, আতর মেখে আর টুপি মাথায় দিয়ে। কতই না সুন্দর দেখায় এ দিনে মুসলমানদের। গরিব-ধনী, মুনিব-দাসের মধ্যে এ সময় কোন পার্থক্য থাকে না।

পূর্ণ একমাস রোযা রেখে আমরা নিজেদেরকে খাঁটি মানব হিসেবে গড়ে তুলি। রোযা শেষে ঈদের দিন থেকেই আমরা রোযার আদর্শে গঠিত জীবন বাস্তবে রূপায়িত করতে সচেষ্ট হই। তাই ঈদ আমাদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। ঈদের মর্যাদা ও আনন্দ দীর্ঘ একমাস রোযা পালনকারী মুসলমানরাই কেবল বাস্তবিক অনুভব করতে পারেন। সুস্থ থেকেও যে ব্যক্তি রোযা পালন করল না, ঈদের আনন্দ তার জন্য নয়। ঈদের মর্যাদাও সে দিতে পারে না।

ঈদের দিনে আমরা অসহায়, গরিব-দুঃখীদের মাঝে ফিতরা বিতরণ করা ছাড়া আরও অনেক দান-খয়রাত করি। ধনীরা এ সময় অসহায়দের মাঝে যাকাত আদায় করে। ফলে গরিব-দুঃখিরাও এই আনন্দে শামিল হতে পারে।

ঈদের রাত:

ইসলামে দুই ঈদের রাত সেসব রাতসমূহের মধ্যে পরিগণিত, যেসব রাতে বিশেষভাবে ইবাদতের জন্যে জাগ্রত থাকার উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে ইবাদতের মাধ্যমে জাগ্রত থাকবে তার ক্বলব সেদিনেও মরবে না যেদিন অন্যান্য সকলের কলব মরে যাবে। অর্থাৎ কিয়ামত দিবসে যখন সকল মানব ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় মূহ্যমান হয়ে পড়বে, তখন ঐ ব্যক্তির কোন অস্থিরতা থাকবে না। কাজেই ঈদুল ফিতরের মর্যাদাপূর্ণ রাতটির প্রতি আমাদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

ঈদুল ফিতরের দিনের সুন্নাত

* শরীয়ত অনুযায়ী নিজেকে সজ্জিত করা, * গোসল করা, * মিসওয়াক করা, * ব্যক্তিগত সামর্থ্যানুযায়ী সর্বোত্তম পোষাক পরিধান করা, * সুগন্ধি ব্যবহার করা, * খুব ভোরে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া, * ঈদগাহে প্রত্যুষে গমন করা, * ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে মিষ্টিমুখ করা, * ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সাদকায়ে ফিতর আদায় করা, * ঈদের নামায ঈদগাহে আদায় করা অর্থাৎ কোন ওযর ব্যতীত মসজিদে ঈদের নামায না পড়া, * এক রাস্তায় ঈদগাহে গমন করা অন্য রাস্তায় প্রত্যাবর্তন করা, * পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া, * নিরবে তাকবির পড়তে পড়তে ঈদগাহে যাওয়া।

তাকবিরে তাশরীক-

اَللّٰہُ اَکْبَرُ اَللّٰہُ اَکْبَرُ اَللّٰہُ اَکْبَرُ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا اللّٰہُ وَاللّٰہُ اَکْبَرُ اَللّٰہُ اَکْبَرُ وَ لِلّٰہِ الْحَمْدُ.

উচ্চারণ- “আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ”। (বাহরুর রায়েক-২/১৫৮, হিন্দিয়্যা)।

ঈদুল ফিতরের নামাযের নিয়ম

উভয় ঈদের দিনের বেলায় দুই রাকআত নামায শুকরিয়া হিসেবে আদায় করা ওয়াজিব। (আলমগিরিয়্যা, হিদায়া, বাহরুর রায়েক)। ঈদুল ফিতরের নামাযের নিয়ম নিম্নরূপ-

কাতার সোজা করে দাঁড়িয়ে প্রথমে এভাবে নিয়্যাত করতে হবে- আমি ঈদুল ফিতরের দুই রাকআত ওয়াজিব নামায ছয় তাকবিরের সাথে এই ইমামের পিছনে কিবলামুখী হয়ে আদায় করছি। এভাবে নিয়্যাত করে দুই হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে হাত বাঁধতে হবে। অতঃপর সানা (সুবহানাকাল্লাহুম্মা..) পড়তে হবে। অতঃপর তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে হবে এবং প্রত্যেক বার কান পর্যন্ত হাত উঠাতে হবে। এই অতিরিক্ত তাকবিরগুলো বলার সময় হাত ছেড়ে দিতে হবে। প্রত্যেক তাকবিরের পর এতটুকু সময় দেরি করতে হবে যে, তিনবার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলা যায়।

আরও পড়তে পারেন-

তৃতীয় তাকবিরের পরে হাত বেঁধে নিতে হবে এবং ইমাম সাহেব ‘আঊযুবিল্লাহ’ ও ‘বিসমিল্লাহ’সহ সূরায়ে ফাতিহা এবং তার সাথে একটি সূরা পাঠ করবেন। এ সময় মুক্তাদীদেরকে নীরবে কিরাত পাঠ শ্রবণ করতে হবে। তারপর নিয়ম অনুযায়ী রুকু-সিজদা করে দ্বিতীয় রাকআতের জন্যে দাঁড়াতে হবে।

দ্বিতীয় রাকআতে প্রথমে ইমাম সাহেব সূরায়ে ফাতিহা এবং তার সাথে একটি সূরা পাঠ করার পর পূর্বের নিয়ম অনুযায়ী ইমাম-মুক্তাদি সকলকে তিনবার তাকবির বলতে হবে এবং প্রত্যেক বার কান পর্যন্ত হাত উত্তোলন করে ছেড়ে দিতে হবে।

অতঃপর হাত উত্তোলন ব্যতীত চতুর্থ তাকবির বলে রুকুতে চলে যেতে হবে। অবশিষ্ট নামায দৈনন্দিন নামাযের নিয়মে শেষ করতে হবে। ইমাম সাহেব নামাযের পর মিম্বারে দাঁড়িয়ে দু’টি খুতবা পাঠ করবেন। উভয় খুতবার মাঝখানে এতটুকু সময় বসবেন, যেন তিনবার ‘সুবহানাল্লাহ’ পাঠ করা যায়।

ঈদুল আযহার নামাযের তরীকাও একই রূপ। তাতেও সেসব কাজ সুন্নাত যেসব কাজ ঈদুল ফিতরে সুন্নাত। শুধুমাত্র পার্থক্য এই যে, নিয়্যাতের ক্ষেত্রে ঈদুল ফিতরের স্থলে ঈদুল আযহা বলতে হবে। ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে কিছু খাওয়া সুন্নাত এবং ঈদুল আযহায় ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে কিছু না খাওয়া উত্তম। ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার সময় তাকবীর চুপে চুপে পড়া সুন্নাত। কিন্তু ঈদুল আযহায় উচ্চস্বরে পড়া সুন্নাত। ঈদুল আযহার নামায যথাসম্ভব সকালে পড়া সুন্নাত। ঈদুল আযহায় সাদকায়ে ফিতর নেই, বরং সামর্থবান ব্যক্তির উপর নামাযের পর কুরবানী করা ওয়াজিব।

ঈদুল ফিতরের যথাযথ আমল পরিপূর্ণভাবে পালন করে ঈদ আনন্দে আমরা সকলে যেন শামিল হতে পারি, এই দোয়া করি। ঈদের আনন্দ, সাম্য ও পারস্পরিক আন্তরিকতা, হৃদ্যতা, শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা আমাদের জীবনে বাস্তবায়িত করে এই ধরাধামকে শান্তির নীড়ে পরিণত করতে সকলকে সচেষ্ট হতে হবে। মহান দয়ালুর দরবারে দোয়া করি, যেন আল্লাহ্ আমাদেরকে তেমন ঈদ পালনের তাওফীক দান করেন, যেদিন সমগ্র পৃথিবীর মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি সদস্য এ উৎসবে মুখর হয়ে উঠতে পারবে।

সমাজ থেকে যাবতীয় জুলুম-অত্যাচার, নিপীড়ন, অসঙ্গতি দূর হোক। হাইজ্যাক, খুনাখুনি, মারামারি, হিংসা-বিদ্বেষ, সন্ত্রাস, বিবাদ-বিসংবাদ এবং অনৈক্যের অবসান হোক। সকল অনৈতিকতা, বেহায়াপনা, অপরাধ, বৈষম্য হারিয়ে যাক। এটাই এবারের ঈদে হোক ঐকান্তিক মুনাজাত। আমীন।

লেখক: মুহাদ্দিস ও শিক্ষাসচিব- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।