Home ইতিহাস ও জীবনী ধর্মহীন রাষ্ট্রের গোড়ার কথা

ধর্মহীন রাষ্ট্রের গোড়ার কথা

।। ড. মো. কামরুজ্জামান ।।

ইংরেজি Atheist শব্দটি ফরাসি শব্দ থেকে উদ্ভূত। শব্দটি ঈশ্বরবিহীন অর্থে ব্যবহৃত হয় সর্বপ্রথম ১৫৭৭ সালে। শুরুর দিকে শব্দটি একটি অপমানজনক শব্দ হিসেবে পরিচিত ছিল। তাই যে কেউই নিজেকে নাস্তিক হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করতো। সমাজে এখনও অনেকে বিশ্বাসগতভাবে স্রষ্টা ও ধর্মে অবিশ্বাসী। কিন্তু ধর্মীয় প্রভাবের কারণে তারা নিজদের নাস্তিক বলতে সাহস করে না। নাস্তিক হিসেবে পরিচয় দেয়ার সূত্রপাত হয় সর্বপ্রথম অষ্টাদশ শতকে ইউরোপ থেকে। (উইকিপিডিয়া)। আধুনিক যুগে বিশ্বময় সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান দর্শন হলো গণতন্ত্র। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, নাস্তিক্যবাদ, সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ একে অপরের সহায়ক ও পরিপূরক শক্তি।

এ মতবাদগুলো বর্তমানে গোটা বিশ্বকে দাপটের সাথে শাসন করে চলেছে। তথাপিও সমাজ জীবন থেকে ধর্মীয় প্রভাব দূর করা যায়নি। গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও পুঁজিবাদী অনেক রাজনৈতিক নেতা আছেন যারা ও পারিবারিক জীবনে ধর্মের নির্দেশ মান্য করে থাকেন। একথা সত্য যে, আধুনিক মতবাদগুলো মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। আবার এটাও সত্য যে, পরিবার, সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে প্রচলিত মতবাদগুলোর চেয়ে ধর্মীয় চেতনার প্রভাবই বেশি লক্ষ্যণীয়। এ প্রভাব মানুষকে আত্মিক ও সামাজিকভাবে উন্নীত ও উজ্জীবিত করছে। এ বিশ^াস বিশ্বাসীদের জীবনাচার ও মানবসত্ত্বাকে উন্নত ও পরিশীলিত করছে। ধর্মীয় অনুশীলন মানবজাতিকে উদারতা, রুচিশীলতা, ভদ্রতা ও উন্নত সুশাসন উপহার দিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ধর্মের বিধান মতে দাউদ (আ.) ও সুলায়মান (আ.) বিশাল এ পৃথিবী পরিচালনা করেছিলেন। অন্যান্য ধর্ম প্রবর্তকগণও তাদের ব্যক্তি জীবনকে ধর্মের বাণীর কাছে দ্বিধাহীন চিত্তে সমর্পণ করেছিলেন। ধর্মের নির্দেশ মোতাবেক তাঁরা তাদের পরিবার ও সমাজজীবনকে সাজিয়েছিলেন। তাদের ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনের প্রভাব রাজনৈতিক জীবনকেও ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করেছিল। ফলে রাষ্ট্রে বসবাসরত নাগরিকদের মন-মানস ধর্মের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারেনি।

ধর্মের এ ব্যাপক অনুশীলন করতে গিয়ে ধর্মবেত্তারা জাগতিক সকল সুযোগ-সুবিধা বিসর্জন দিয়েছিলেন। তারা জীবনের সকল মায়া ত্যাগ করেছিলেন। সুখ-শান্তি ও ঐশ্বর্য জলাঞ্জলি দিয়ে পৃথিবীতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। ধর্মহীন পুঁজিবাদী স্বার্থান্বেষী শাসকগোষ্ঠি সবসময় তাদেরকে কোনঠাসা করে মিথ্যা ও ঠুনকো অজুহাতে তাদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করলেও তারা তাদের বিশ্বাস ও দায়িত্ব থেকে এতটুকুও পিছপা হন নি! মহানবী (সা.) এর আগমনের মাধ্যমে ধর্মপ্রবর্তকদের আগমনের এ ধারার সমাপ্তি ঘটেছে। ৬১০ সালে নবুয়তপ্রাপ্ত হয়ে তিনি মাত্র ২৩ বছর বেঁচে ছিলেন। এ অল্প সময়ের ব্যবধানে তাঁর প্রচারিত ধর্মের শাশ্বত আবেদন আরববাসীর কঠোর হৃদয়কে জয় করতে সক্ষম হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি গোটা আরব রাষ্ট্রের অধিপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

পৃথিবীর সকল ইতিহাস এ সাক্ষ্য দেয় যে, রাসূল (সা.) হিসেবেই তিনি রাষ্ট্রপতির পদটি অলঙ্কৃত করেছিলেন। নির্বাচিত হয়ে তিনি আরবে বসবাসরত সকল জাতি ও ধর্মের নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। অথচ তাঁর এ রাষ্ট্রের সংবিধান ছিল আল কোরআন। আল-হাদীস ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার গঠনতন্ত্র। আর মসজিদে নববী ছিল সংসদসচিবালয়। তাঁর মৃত্যুর পর খোলাফায়ে রাশেদীন সুদীর্ঘ ৩০ বছর তাঁরই অনুসৃত ফর্মুলায় রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তাঁরা সবাই অতি নির্ভুলভাবে ধর্মতাত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন এই কোরআন ও হাদিস দিয়েই। তৎপরবর্তী উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে রাষ্ট্র পরিচালনার ধারা কিছুটা পরিবর্তিত হলেও শাসকগণ ধর্মবিশ^াসের আলোকেই তাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। একই দর্শনে তারা শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি রচনা করেন।

একথা মিথ্যা নয় যে, খোলাফায়ে রাশেদীন এবং পরবর্তী সকল মুসলিম শাসনামলে নিজেদের মধ্যে অনেক ফিতনা-ফাসাদ, হাঙ্গামা ও যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এক মুসলিমের হাতে অন্য মুসলিমের নিহত হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছিল অনেকবার। কিন্তÍু সেখানে ধর্মের কোনো দোষ ছিল না। দোষ ছিলনা আল্লাহর নাযিলকৃত ইসলামের। এটা মানতে দ্বিধা নেই যে, তখন অনেক মুসলিম ব্যক্তি ও মুসলিম শাসকের দোষ ছিল। এটা স্বাভাবিক যে, প্রবৃত্তিতাড়িত হয়ে যে কোনো মুসলিম নেতাই ভুল করতে পারেন। সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েও ভুল হয়ে যেতে পারে যেকোনো ধর্মীয় নেতা ও গোষ্ঠির। তাই ধর্মকে আর ধার্মিককে এক করে দেখা ঠিক হবে না।

বর্তমানের গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদগুলোতে রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রেও যুদ্ধ ও রক্তপাত কম ঘটেনি। ১৯১৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৪০ কোটি মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল। এ যুদ্ধের সাথে ধর্মের কোনোই সং¯্রব ছিল না। এ যুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যা ছিল এক কোটির উপরে। ১৯৩৯ সালে সংঘটিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ যুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮কোটি। এছাড়া গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে ২০০৩ সালে আমেরিকা কর্তৃক ইরাক আক্রমণ বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষভাবে অবলোকন করেছে। ২০০৩ সালে শুরু হওয়া আক্রমণটি শেষ হলেও তার রেশ এখনও শেষ হয়নি। এ আক্রমণে নিহত হয়েছে এক কোটি ২০ লাখ নির্দোষ, নিরীহ শিশু, কিশোর, যুবক এবং বৃদ্ধ বনি আদম। আর এ আলোচনার বাইরের যুদ্ধগুলোতো আছেই।

মূলত আদম (আ.) থেকে শুরু হওয়া ধর্ম তার মৌলিকত্ব ঠিক রেখে সময় এবং যুগের চাহিদা মতো বিভিন্ন সময়ে আল্লাহ তা‘আলা নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। তিনি পঠিয়েছেন সময়োপযোগী কিতাব ও বিধিবিধান। আর মুহম্মদ (সা.) সেই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ প্রবর্তক। তাঁর আগমনের মাধ্যমে ধর্ম আগমনের ধারার সমাপ্তি ঘটেছে। ৬৩২ সালে মহানবীর (সা.) মৃত্যুর পর পৃথিবীতে আর কোনো নবী আসেননি এবং আসবেনও না। এ ধর্মই সর্বকালীন, সার্বজনীন এবং সামগ্রিক আধুনিকতার পরিপূরক একটি পূর্ণাঙ্গ আদর্শ।

তাঁর অন্তর্ধানের আজ ১৩৯১ বছর পরেও মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। তাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল ধর্মের বিধান দ্বারাই পরিচালিত। তাদের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি পরিচালিত হচ্ছে বিধিবদ্ধ ধর্মীয় বিধানের আলোকেই। প্রচলিত গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের তুলনায় সেসকল ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণশৃঙ্খলা কোনোদিক দিয়েই দুর্বল পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বরং তাদের উন্নতি, অগ্রগতি ও সংহতি অনেকাংশেই বেশি কার্যকর বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তারা গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী ও অন্যান্যের মতো বিশ্বদরবারে যুদ্ধবাজ ও দাঙ্গাবাজ হিসেবে পরিচিত নয়। প্রতাপশালী গণতন্ত্রী নেতাদের মতো তাদের কেউই সন্ত্রাসী, আগ্রাসী ও দখলবাজ মনে করে না। সচেতন মহল তাদের শুধু অতিমাত্রায় বিলাসী বলে অভিযোগ করে। এ অভিযোগ হয়তো বা সত্য, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে বিশ^বাসীর কেউই এ পর্যন্ত যুদ্ধবাজ বা দখলবাজ বলে অভিযোগ করেনি।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ২.৩% মানুষ আছে যারা ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেন। তারা ধর্মহীন বিভিন্ন মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত। তারা তাদের জীবনের সামগ্রিক বিষয়াদি ঐ মতাদর্শ দ্বারাই পরিচালনা করতে চান এবং করেন। লক্ষযোগ্য হলো, তারা ধর্মে অবিশ^াসী হলেও তাদের কর্মকান্ড সততা, নিষ্ঠা, নৈতিকতা ইত্যাদি নীতিকথায় ভরপুর। অথচ একথাগুলো ধর্মীয় বিভিন্ন গ্রন্থ থেকেই উৎসারিত। তারা তাদের আদর্শ প্রচার করতে জীবনবাজি রাখার নীতিকথা বলেন। এ জীবনবাজি রাখার নীতিকথাটাও সর্বপ্রথম ধর্ম থেকেই এসেছে। এসব মতাদর্শের লোকেরা আদর্শিক যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করলে তাদের শহীদ বলে আখ্যায়িত করেন। তাদের ভাষায় ব্যবহৃত এ শহীদ শব্দটিও ধর্মীয় পরিভাষারই অন্তর্গত।

আরও পড়তে পারেন-

গবেষণা করলে দেখা যায়, ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করার প্রবণতাটা সৃষ্টি হয়েছে মুক্তমনা দর্শন চর্চার মানসিকতা থেকে। আর সেই চিন্তাটা শুরু হয়েছিল ক্ষুদ্রসংখ্যক অবিশ^াসীদের মাধ্যমে। অথচ, দর্শনের ইতিহাস চর্চা করলে দেখা যাবে যে, দর্শনের সাথে ধর্মের কোনো বিরোধ কখনোই ছিল না। ষষ্ঠ শতাব্দীতে ব্যাপকভাবে দর্শনের চর্চা শুরু হয়। আর দর্শন চর্চার প্রাণপুরুষ ছিলেন সক্রেটিস, প্লেটো এবং এরিস্টটল। তারা সকলেই একেশ্বরবাদী ছিলেন। তারা কখনও ধর্মের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন না, নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টিও করতেন না। তারা কখনও ধর্মের নেতিবাচক ব্যাখ্যা প্রদান করেননি। তাদের জীবনী পাঠ করলে দেখা যায়, সামগ্রিক জীবনে তারা ধর্ম পালনের যৌক্তিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

সক্রেটিসের ছাত্র প্লেটো, প্লেটোর ছাত্র ছিলেন এরিস্টটল আর এরিস্টটলের ছাত্র ছিলেন আলেকজান্ডার। দিগ¦জয়ী মহাবীর আলেকজান্ডার বহুঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী হলেও ধর্মের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। তার সময়ে রাষ্ট্র চলেছে স্বাধীনভাবে আর ধর্মও চলেছে তার নিজস্ব গতিতে। এটা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিরোধ নিয়ে যত তর্ক-বিতর্ক, সেটা আধুনিক অসার নাস্তিক্যবাদী ধ্যান-ধারণারই কুফল। ধর্ম সম্পর্কে একচোখা নীতি অবলম্বনকারী গুটিকতক অবিশ^াসীর মুক্তচিন্তাকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে ধর্ম ও রাষ্ট্রের সংঘাত। তাদের মুক্তচিন্তার পিছনে কাজ করছে অনৈতিক ভোগবাদিতা। এ অনৈতিক ভোগবাদিতাই তাদের ধর্মহীন হতে প্ররোচণা যুগিয়েছে। অন্যদিকে ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে অপর্যাপ্ত ও অগভীর পা-িত্য তাদেরকে সংশয়ে ফেলে দিয়েছে। আর এর সবকিছুর মূলে রয়েছে ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ।

আগেই বলা হয়েছে, পৃথিবীতে দর্শন চর্চার সূচনালগ্নে ধর্মের সাথে তার কোনো বিরোধ ছিল না। দর্শন চর্চার নিমিত্তে ষষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রিকরা অসংখ্য স্কুল তৈরি করেছিল। সেসব স্কুলগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দর্শনের অনুশীলন হতো। আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দর্শন চর্চা ছিল স্বাধীনতার অন্যতম অধিকার। সেখানে ধর্ম কোনো প্রতিতবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি এবং ধর্ম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণাও ঐ প্রতিতষ্ঠানগুলো থেকে তখন তৈরি হয়নি। তখন একদিকে চার্চকে কেন্দ্র করে পরিবার ও সমাজ জীবনে ধর্মের ব্যাপক অনুশীলন হতো। অন্যদিকে স্কুলগুলোতে মুক্তমনের দর্শন চর্চার কাজ ভালোভাবেই চলতো। কিন্তু এই উন্মুক্ত দর্শন চর্চায় এবং মুক্ত মনের মত প্রকাশে বাধ সাধল তৎকালীন বাইজান্টাইন (রোমান) সম্রাট জাস্টিনিয়ান।

জাস্টিনিয়ান ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। নিজের ক্ষমতাকে দীর্ঘ ও পোক্ত করতে ফন্দি-ফিকির করতে থাকেন। ৫২৯ সালে জাস্টিনিয়ান সকল গ্রিক স্কুল ভেঙে দেন! জাস্টিনিয়ান নিজের ক্ষমতাকে দীর্ঘ এবং পোক্ত করতেই এধরনের হটকারী সিদ্ধান্ত নেন। জাস্টিনিয়ানের উদ্দেশ্য ছিল সকলকে মূর্খ বানিয়ে ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করা। জাস্টিনিয়ান প্রজাদের উপর শাসনের নামে শোষণের স্টিম রুলার চালাতে থাকেন। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে চললো জাস্টিনিয়ানের এ শাসন। এতে মানুষের মুক্ত মনের ভাবনার পথ রুদ্ধ ও শৃঙ্খলিত হয়ে গেলো। শোষিত জনগণ জাস্টিনিয়ানের জুলুম এবং শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। মনের গভীরে তারা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। কিন্তু তাদের কিছুই করার ছিল না। এ সময়ে চার্চও আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। এভাবে চার্চ তথা ধর্মের সাথে রাষ্ট্র তথা শাসকগোষ্ঠির সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে।

চতুর্দিক থেকে জাস্টিনিয়ানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘনীভূত হতে থাকে। ধূর্ত জাস্টিনিয়ান গদি রক্ষার্থে ধার্মিক সাজার ভান করেন। তিনি চার্চের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন। ক্ষুব্ধ জনতার ক্ষোভ প্রশোমন করতেই জাস্টিনিয়ান চার্চের দ্বারস্থ হন। সে নতুনভাবে ধান্ধাবাজিতে লিপ্ত হয়। এ ধান্ধাবাজিতে ধূর্ত জাস্টিনিয়ান সফলতা লাভ করে। জাস্টিসিয়ন ধর্মের লিবাস ও মুখোশ পরিধান করেন। তিনি তার ধূর্ততা আর ক্ষমতাকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। দাবার ঘুঁটি চালিয়ে জাস্টিনিয়ান ধর্মীয় নেতাদের বশ করে নেন। এরই এক পর্যায়ে ধর্মগুরুদের শাসকগণ দরবারী ধর্মজাযকে পরিণত করেন। ধর্মজাযকগণ রাষ্ট্রের অনুচর ও সেবাদাসে পরিণত হন। অত্যাচারী শাসক আর দরবারী ধর্মজাযক একে অপরের সহায়ক শক্তিতে পরিণত হয়। ধর্মজাযকদের সহায়তায় জাস্টিনিয়ান নতুনভাবে শক্তি ও ক্ষমতা সঞ্চয় করেন।

ক্ষমতার জোরে শাসকগণ ইচ্ছামত ধর্মীয় নেতাদের ব্যবহার করতে শুরু করেন। রাষ্ট্রনেতা এবং ধর্মনেতা এ দুইয়ের যোগসাজশে শুরু হয় ইচ্ছামত রীতি এবং বিধান তৈরির ফর্মুলা। ক্ষমতাধর জাস্টিনিয়ান জোর প্রতাপের সাথে উত্তর আফ্রিকা, সিসিলি এবং ইতালির একটি অংশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তার রাজত্বকাল ছিলো ৫২৭ সাল থেকে ৫৬৫ সাল পর্যন্ত। জাস্টিনিয়ানের ধারাবাহিকতায় চলতে থাকা এই রাজত্বে ধর্মযাজকরা পরিপূর্ণ ধর্মব্যবসায়ীতে পরিণত হন। চতুরতার সাথে তাদের রচিত আইনের অনৈতিক ব্যবহার জনগণের উপর চাপাতে থাকে। স্বৈরতান্ত্রিক সরকার আর ধর্মযাজকদের ধর্মব্যবসা একই ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। কিন্তু জনগণ মন থেকে সেটা মেনে নিতে পারেনি। তারা ঘৃণাভরে সেটি প্রত্যাখ্যান করে।

উল্লেখ্য যে, ধার্মিকদের দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে জনগণের সমর্থন বেশি না থাকলেও সাধারণ জনগণ তাদেরই সাধারণত সৎ মনে করে থাকে। কারণ, রাষ্ট্রপরিচালনায় এমন কিছু নীতির প্রয়োজন হয়, যার উপর ভিত্তি করেই কোনো রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। আর জনগণ সেই নীতিকে কোনো ধরনের যুক্তি ছাড়াই অকপটে বিশ্বাস এবং স্বীকার করে নিয়ে থাকে। তার মধ্যে ধর্মই হলো প্রধান। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত ধর্মকে লালন এবং পালনের জন্য রাজনীতি করে থাকে। অপরপক্ষে গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষ ও পুঁজিবাদীরা জনসমর্থন পেতে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করে থাকেন।

লেখক: অধ্যাপক, দা’ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া। ইমেইল- dr.knzaman@gmail.com

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।