Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ তীব্র গরমে বিস্মৃতি থেকে তালপাখার সদর্প প্রত্যাবর্তন

তীব্র গরমে বিস্মৃতি থেকে তালপাখার সদর্প প্রত্যাবর্তন

ছবি- সংগৃহীত।

মাসুম বিল্লাহ: সূর্য ডুবেছে আরও ঘণ্টাখানেক আগে। তাপমাত্রা এখন ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না। কিন্তু তখনও গরমে হাঁসফাঁস করছি, বাতাস উত্তপ্ত। দিনের মতোই গরম লাগছে অনেকটা।

একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছেন রাজবাড়ী বাজার এলাকার পালপটরির দিকে। ভদ্রলোকের শরীর ঘামে জবজবে হয়ে গেছে। তিনি খুঁজছেন তালপাতা দিয়ে হাতে বানানো তালপাখার দোকান। তাপপ্রবাহের মধ্যে বিদ্যুৎবিহীন রাত দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। বাজারে যেসব চার্জার ফ্যান পাওয়া যায়, সেগুলো কেনার সামর্থ্য খুব কম মানুষেরই আছে।

এ কারণেই তালপাখার চাহিদা গগনচুম্বী হয়ে গেছে। অথচ গত কয়েক বছরে এই তালপাখা একপ্রকার বিলুপ্তই হয়ে গিয়েছিল। আসলে তালপাখার চাহিদা এতই বেড়েছে যে পালপটরির সব দোকানের তালপাখাই ফুরিয়ে গেছে।

একটি দোকানের মালিক লিটন জানালেন, ‘চাহিদা ১৪ গুণ বেড়েছে। এত বেড়েছে যে কেষ্টপুরের পাখা প্রস্তুতকারকরা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না।’

রাজবাড়ী সদরের একটি গ্রাম কেষ্টপুর। এই পল্লিটি ঐতিহ্যবাহী তালপাখা তৈরির জন্য বিখ্যাত। এ গ্রামের বাসিন্দারা বংশ পরম্পরায় পাখা তৈরি করেন। শুধু রাজবাড়ী নয়, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, মাদারীপুর, ঢাকাসহ আরও কয়েকটি জেলায় এসব তালপাখা সরবরাহ করেন তারা।

সোমবার দুপুরে আমরা এই গ্রামে যাই। খানখানাপুর রেলস্টেশনগামী রাস্তার ধারে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে গ্রামবাসীরা তালপাতা দিয়ে পাখা তৈরি করছিলেন। চারিদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তালপাতা। নারী-পুরুষ প্রাণপণে পাখা বানাচ্ছেন। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বেপারীরা ঘুরঘুর করছেন তাদের আশপাশে; ১০০ পিস পাখা বানানো হলেই সেগুলো সংগ্রহ করবেন তারা।

জেসমিন নামের এক গৃহবধূ রঙিন বাঁশ দিয়ে পাখা বাঁধছিলেন। এটি তালপাখা তৈরির চূড়ান্ত পর্যায়। জেসমিন বলেন, ‘এখানে বিয়ে হওয়ার পর থেকে গত প্রায় ১০-১৫ বছর ধরে আমি তালপাখা বানাচ্ছি।’

তাদের বাড়ির পেছনে একটি বড় পুকুরের পাড়ে কয়েক ডজন তালপাতা ফেলে রাখা হয়েছে রোদে শুকানোর জন্য। বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসব পাতা সংগ্রহ করেছেন তারা। প্রত্যেক পাতার দাম ৮ থেকে ১০ টাকা।

পাতা শুকানোর পর সেগুলোকে শিশিরে ভেজার জন্য ফেলে রাখা হয়। এরপরই কেবল পাতাগুলো ফ্রেমে বসানোর জন্য প্রস্তুত হবে, পরবর্তীতে অন্যান্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে।

জেসমিন আরও বলেন, ‘অনেক কাজ করতে হয়। পাতা প্রস্তুত করা, কাঠামো বানানো এবং ফ্রেম সোজা করা থেকে শুরু করে এটি বাঁধানো পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। আমাদের পরিবারের সবাই মিলে কাজ করছে।’

নিকবর তার বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে বসে কাজ করছিলেন। লুঙ্গি পরা, খালি গায়ের মানুষটি দরদর ঘামছেন। নিকবর বললেন, ‘আমি ১৫ বছর ধরে পাখা বানাচ্ছি। প্রতি বছর ছয় মাস এই ব্যবসা হয়। প্রতিদিন আমি প্রায় ২০০ পিস পাখা সরবরাহ করি।’

তিনি আরও বলেন, ‘গরম আর লোডশেডিংয়ের কারণে এ বছর আমাদের পাখার চাহিদা অনেক বেশি। আগে আমরা ১০০ পিস ভালো মানের তালপাখা প্রায় ১,৫০০ টাকায় বিক্রি করতাম—এবারের মৌসুমে আমরা এই পরিমাণ তালপাখা ৪,৫০০ টাকায় বিক্রি করছি।’

রাস্তার অপরপাশে গাছের নিচে বসে দ্রুত হাতে পাখা বানাচ্ছিলেন মালেকা। তিনি বললেন, ‘১০০ পিস “বেতের” পাখার জন্য ১০০ টাকা দেয়। আমি প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০টি পাখা বানাতে পারি।’

এলাকাবাসী জানান, কেষ্টপুরের প্রায় ৫০টি পরিবার তালপাখা তৈরির সঙ্গে যুক্ত। আকাশচুম্বী চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছিল বলে শুধু স্বামী-স্ত্রী-ই নয়, বাচ্চারাও পাখা বানানোর কাজ করছিল।

মিজান শেখ তার বাড়ির সামনে দশম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে কাজ করছিলেন।

আমরা এগিয়ে যেতেই মিজান একগাল হেসে বললেন, ‘আমাদের আয় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। এজন্য আমরা মনের আনন্দে কাজ করছি। গরম আর লোডশেডিং দুটোই আমাদের অনেক উপকার করেছে।’

আরও পড়তে পারেন-

মিজান তাদের বানানো দুই ধরনের মানের পাখা সম্পর্কে বললেন। ‘ভালো মানের পাখাগুলো তালপাতার সাথে পাওয়া তালকাঠি দিয়ে বানানো হয়। বাকিগুলো বানানো হয় বাঁশের লাঠি দিয়ে। প্রথমটি বেশি শক্ত হয়, কারণ তালপাতা ফ্রেমের সাথে স্বাভাবিকভাবে যুক্ত থাকে। তাই এগুলোর দামও হয় বেশি—লএখন প্রতি ১০০ পিস বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৪,৫০০ টাকায়।’

গত মৌসুমে বাঁশের লাঠি দিয়ে বানানো প্রতি ১০০ পিস পাখার দাম ছিল ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। মিজান বলেন, গত কয়েক বছর লোডশেডিং কমে যাওয়ায় তাদের ব্যবসাও কমে গিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘যে বিক্রি হতো, তা দিয়ে পরিবার চালানোও কঠিন হয়ে পড়েছিল।’

রাস্তায় সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা এক ডজন বেপারীর দলে ছিলেন জব্বার শেখ। তিনি কেষ্টপুর থেকে তালপাখা সংগ্রহ করে রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করেন। বর্তমানে তিনি দিনে প্রায় ৫০০ পিস তালপাখা সরবরাহ করেন।

‘চাহিদা কম থাকায় গত কয়েক বছর পাখার দাম খুব কম ছিল। আগে আমি ১০০ থেকে ৩০০ পিসের মতো পাখা সরবরাহ করতাম। এমনও দিন গেছে, যেদিন অবিক্রিত পাখা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে।’

আব্দুল খালেক নামে আরেক বেপারীকে দেখলাম একটি বাড়ি থেকে ১০০টি বাঁশ-লাঠির পাখা সংগ্রহ করছেন। তিনি বললেন, ‘এগুলো মাত্র ২,৫০০ টাকায় কিনেছি। প্রতি পিসের দাম প্রায় ২৫ টাকা। আগে এগুলোর প্রতি ইউনিটের দাম ছিল ৮ টাকা। আগে প্রতি পিস তালের হাতলওয়ালার পাখার দাম ছিল ১৫ টাকা, এখন ৪৫ টাকা। বাজারে ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’

খালেক অবশ্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তিনি স্থানীয় হলেও গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের বেপারীরা প্রতি ইউনিট পাখা ৫০ টাকায় কিনে নিয়ে প্রতিযোগিতায় তাকে পিছনে ফেলে দিচ্ছেন।

‘ওদের সাথে প্রতিযোগিতায় আমরা কুলিয়ে উঠতে পারছি না,’ বলেন তিনি। তার পাশে শাহজাহান নামে আরেক বেপারীকে দেখতে পেলাম। তিনি ঢাকায় তালপাখা সরবরাহ করেন। শাহজাহান বলেন, ‘ঢাকায় ১০০ টাকা দিয়েও এক পিস তালপাখা পাবেন না। চাহিদা অনেক বেশি।’

গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে লোডশেডিংয়ের পরিমাণও কমেছে। কিন্তু গত বছর দেশে যে জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে, চলতি বছরের জুন থেকে তা বেড়েছে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকায় গ্রামগুলো মাত্র কয়েক ঘন্টা বিদ্যুৎ পায়—তাই লোডশেডিং অনেক বেড়েছে। শহরগুলোতেও লোডশেডিং কিছুটা বেড়েছে।

এর ফলে বাংলাদেশের ঘরোয়া পণ্য তালপাখা—যা কয়েক বছর ধরে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছিল—তার আগের গৌরব ফিরে পেয়েছে। লোডশেডিং তাহলে আপনার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে?—প্রশ্ন রাখলাম মিজান শেখের কাছে। মিজান বিস্তৃত হাসি দিয়ে বললেন, ‘সত্যিই কি এটাকে আশীর্বাদ বলতে পারি?’

সূত্র- টিবিএস।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।