Home শিক্ষা ও সাহিত্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোর খাবার সরবরাহের অবস্থা কেমন?

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোর খাবার সরবরাহের অবস্থা কেমন?

- প্রতিকী ছবি।

।। কাজী আশরাফ উদ্দিন ।।

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে খাবার সরবরাহের অবস্থা কেমন? আগে আমরা সবসময় হল গুলোতে ভয়াবহ খাবারের মানের কথা শুনতাম। ডাল নাকি পানি বোঝা যায়না কিংবা মুরগীর মাংসের টুকরো খুঁজে পাওয়া যায়না কিংবা আলু ভাজির সাথে তেলাপোকাও ভাজি হয়ে যায়– এ জাতীয় গল্প এবং ফ্যাক্ট আমাদের সকলের শোনা কিংবা জানা। দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হলের খাবারের মানে হতাশ হয়ে একটু ‘ভালো’ খাবারের জন্য আমাদের শিক্ষার্থীরা ‘বট’, ‘ঝুপড়ি’, ‘ঢাল’ কিংবা ‘টং’– এ জাতীয় ক্যাম্পাস-সংলগ্ন জায়গাগুলোতে যায় কিছু সুস্বাদু কিংবা মুখরোচক খাবারের আশায়। শুধু তিনবেলার খাবার নয়, যেকোনো স্ন্যাক্সের জন্য ক্যাম্পাসগুলোতে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন অসংখ্য ভ্রাম্যমান এবং স্থায়ী খাবার দোকান।

ফুচকা, আচার, ভাজাপোড়া, ভর্তা, স্যাকারিন– দেওয়া আইসক্রিম, পুরোনো তেলে ভাজা পিঠা-পুলি, হাওয়াই মিঠা, ফলের চাটনি– কী নেই ক্যাম্পাসে! না, আমি শিশুপার্কের কথা বলছিনা, আমি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কথা বলছি যেখান থেকে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের জ্ঞানগত, মানসিক এবং দৈহিক পুষ্টি আহরণ করার কথা! ফুচকা আমাদের রোমান্টিক রসনার সাথে সম্পর্ক থাকাতে প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানোর সময় শিক্ষার্থীদের এবং বহিরাগত দর্শনার্থীদের কাছে ফুচকার ডিমান্ড অনেক বেশি এবং তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুচকার ভ্যান ব্যাঙের ছাতার মতো গজাচ্ছে প্রতিদিন।

কিন্তু আমি যেই খাবারগুলোর নাম বললাম উপরে তার একটিও কি স্বাস্থ্যসম্মত? কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ (প্রক্টরিয়াল বডি) যখন এই খাবারের স্টলগুলোকে অনুমতি প্রদান করেন তারা কি একবারও খাবারের মান যাচাই করে নেন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা খাবারের দোকান চালায় তাদেরকে কি খাবারের মানদণ্ডের ব্যাপারে কোনো লিখিত ডকুমেন্ট দেওয়া হয়? এ নিয়ে কোনো পলিসি কি আছে? প্রক্টররা কি ভোক্তা অধীদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতো ক্যাম্পাসের খাবারের দোকানগুলোর খাবারের মান যাচাই করেন? একজন শিক্ষার্থী যখন পেটের ব্যথার কারণে ক্লাসে উপস্থিত না থাকায় তাকে মনের সুখে ‘অ্যাবসেন্ট’ দেখাচ্ছি, আমরা কি জানি তার পেটের ব্যাথার কারণ হয়তো ফুচকার বেশি টক-তেতুল কিংবা বাসি তেলে ভাঁজা বেগুন? এই প্রশ্নগুলোর বেশিরভাগ উত্তরই ‘না’।

ক্যাম্পাসের খাবারের দোকানগুলোর অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে শিক্ষার্থীদের অসুস্থ হওয়া খুবই নিয়মিত ঘটনা। এবং খাবারের ক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে নিয়মিত শিক্ষাকার্যক্রমে অংশ গ্রহণ করতে না পারাও নতুন কিছু নয়। তবে কি জেনে-শুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ‘শিক্ষিত’ প্রতিষ্ঠানগুলো মানহীন, অস্বাস্থ্যসম্মত, পুষ্টিগুণহীন খাবারের বিপণনে সাহায্য করছেন এবং শিক্ষার্থীদের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলছেন?

অ্যারিস্টট্ল ও প্লাটো উভয়েই জ্ঞান-অর্জনের অন্যতম আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে জিমনাসিয়ামের কথা তথা দৈহিক এবং স্বাস্থগত উৎকর্ষের কথা বলে গেছেন। একটি অপরটির সাথে সম্পর্কিত। সাথে তারা উভয়েই জ্ঞানার্জনের সাথে নৈতিকতার ধারণার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

আরও পড়তে পারেন-

অ্যারিস্টট্ল তাঁর নিকোম্যাকিয়ান এথিক্স এ নৈতিকতার সাথে ন্যায়বিচারের ধারণার বিকাশের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলে গেছেন। আমরা যখন আমাদের শিক্ষার্থীদের দৈহিক পুষ্টিকে অবহেলা করি এবং তাদেরকে সিস্টেমেটিক্যালি দৈহিক এবং সেইসাথে মানসিক অসুস্থতার দিকে থেকে ঠেলে দিচ্ছি, আমরা তাদের প্রতি এক ধরনের অন্যায় করছি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়– একদিকে আমরা যখন লাঞ্চের জন্য সময় সীমিত করে দিয়েছি, আবার ওই সীমিত সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের নিশ্চয়তা দিতে পারছিনা– আমরা এভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রতি কাঠামোগত অন্যায় করছি।

বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন খাদ্যাভ্যাস থাকতে পারে, কেউ মাংসাশী, কেউ ভিগান, কেউ ভেজেটেরিয়ান, কেউ গোমাংস খান না, কারো এলার্জি আছে ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে, কারো কারো খাদ্যাভ্যাসের ওপর তাদের সুস্থতা নির্ভর করে; নির্ভর করে তাদের একাডেমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মান। কোনো শিক্ষার্থী বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসলে তার খাবার গরম করে খাবার কোনো ব্যবস্থা কি আমরা করেছি? আমরা কতটুকু শিক্ষার্থীদের খাদ্যাভ্যাসের এই বৈচিত্রকে অ্যাড্রেস করতে পেরেছি। খাদ্য বৈচিত্রের সাথে সাথে, খাদ্যের মান এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণও আমাদের মতো নিম্ন আয়ের এবং আয়-বৈষম্যের দেশগুলোতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ক্যাম্পাসের খাবারের মূল্য কি শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কি-না সেটিও ভাবতে হবে। অনেক শিক্ষার্থীই নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে আসেন এবং সীমিত অর্থ দিয়ে মাস চালান।

ক্যাম্পাসে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং খাদ্যের-ন্যায়বিচার (ফুড জাস্টিস) আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। একইসাথে খাবারের বর্জ্য নিষ্কাশনের যে সামাজিক এবং পরিবেশগত দায়িত্ব আছে, সে ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের খাদ্য-নিরাপত্তা এবং খাদ্যের ন্যায়-বিচার ইত্যাদি বিষয়ে সামাজিক গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আমরা ইদানিং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের সাথে তাল মেলানোর কথা বলছি, সাথে সাথে বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে র‍্যাঙ্কিংয়ে পাল্লা দেবার কথাও ভাবছি, অথচ শিক্ষার্থী-গবেষকদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জৈবিক চাহিদা- খাদ্যগ্রহণ- সেটার ব্যাপারে আমাদের অনীহা লক্ষণীয়। আমাদের ক্যাম্পাসের চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে যে শিক্ষার্থীরা চিকিৎসা সেবা পেতে যান, তাদের কতভাগ খাদ্য-সংক্রান্ত শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে যান, এই বিষয়ে আমাদের পাবলিক হেলথ বিভাগগুলো কি কোনো গবেষণা করেছে?

নয়া-উদারনৈতিকতার এই যুগে এসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধীরে ধীরে সরকাররি ফান্ডিং কমে যাচ্ছে এবং ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাই প্রাইভেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের দৌরাত্ম। ক্যাম্পাসের খাবার সরবরাহ, মূল্যনির্ধারণ এবং বণ্টনে এসব বেসরকারি আউটসোর্স করা প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে এবং অনেক সময় তারা খাদ্যের মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠানের পার্থক্য হলো এখানে কেবল শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়েই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়না, তাদের মনন, দেহ এবং মনের বিকাশের দায়িত্বও আমাদের।

আর সেখানেই আসে যত্ন (care) এবং নৈতিকতার (ethics) ধারণা। বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যত্ন নেওয়াকে (নিজের এবং অন্যের) প্রতিষ্ঠানের একটি নৈতিক দায়িত্ব (care ethics) হিসেবে ভাবা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম ও বিভিন্ন পলিসিতে শিক্ষার্থীদের ওয়েলফেয়ার, ওয়েলবিং এবং কেয়ার– এ জাতীয় বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কেয়ার এথিক্সের ধারণার মধ্যে দায়িত্ব, শিক্ষার্থীদের মনো-দৈহিক প্রয়োজনের প্রতি মনোযোগ এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা– এই ধারণাগুলো অন্তর্ভুক্ত।

বিশ্ববিদ্যালয় একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান। তাই খাদ্য-ন্যায়বিচার (food justice), নৈতিক খাদ্যগ্রহণ (ethical eating) এবং খাদ্য নিরাপত্তা (food security)– এই ধারণাগুলো বিকাশের শুরুটাও বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুরু হোক। আমরা যেন ভুলে না যাই ছাত্রজীবনে পরিমিত এবং পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণের সুযোগ না থাকায় আমাদের অনেক শিক্ষার্থীই আমার মতো অল্প বয়স থেকেই আলসারে ভুগছেন এবং এখনো সেই ক্ষত বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাই এখনই সময় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শোনা ক্যাম্পাসের খাবার নিয়ে তাদের বিভিন্ন গল্প, বিভিন্ন কষ্টের কথা।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথ ওয়েলস (অস্ট্রেলিয়া)।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।