Home ইসলাম ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক যেমন হওয়া উচিত

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক যেমন হওয়া উচিত

প্রতীকী ছবি

।।  মো. আবদুল মজিদ মোল্লা ।।

ইসলাম শ্রমিকের মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দেয়। শ্রমিকের স্বার্থ সুরক্ষায় ইসলাম মৌলিকভাবে কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়। তা হলো, ক. শ্রমিক-মালিকের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক, খ. যথাযথ মজুরি নির্ধারণ, গ. ইহকালীন ও পরকালীন জবাবদিহি। নিম্নে উল্লিখিত তিনটি বিষয়ে আলোচনা করা হলো।

শ্রমিক-মালিকের সুসম্পর্ক

ইসলাম শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ককে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক হিসেবে ঘোষণা করেছে, যা সৌহার্দ্য ও কল্যাণকামিতার বার্তা বহন করে। ইসলাম শ্রমিক ও মালিক উভয়কে দায়িত্বশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। মালিকের উদ্দেশে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন।

সুতরাং যার ভাইকে তার অধীন করেছেন সে যেন তাকে তা-ই খাওয়ায় যা সে খায়, সেই কাপড় পরিধান করায়, যা সে পরিধান করে। তাকে সামর্থ্যের অধিক কোনো কাজের দায়িত্ব দেবে না। যদি এমনটা করতেই হয়, তাহলে সে যেন তাকে সাহায্য করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৬১৭)

অন্যদিকে শ্রমিককে বলেছে, ‘আল্লাহ পছন্দ করেন যে তোমাদের কেউ যখন কোনো কাজ করবে সে তা যথাযথভাবে করবে। ’ (সহিহুল জামে,হাদিস : ১৮৮০)

যথাযথ মজুরি নির্ধারণ

ইসলাম শ্রমিকের উপযুক্ত মজুরি নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছে। কেননা মজুরি যথাযথ না হলে শ্রমিকের পূর্ণ মনোযোগ ও আন্তরিকতা আশা করা যায় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যথোপযুক্ত খাদ্য ও পরিধেয় মালিকানাধীন (বা অধীন) ব্যক্তির প্রাপ্য।’ (মুয়াত্তায়ে মালিক, হাদিস : ৪১)

হাদিসে ব্যবহৃত ‘মারুফ’ বা যথোপযুক্ত শব্দটি তাৎপর্যবহ। কেননা কোনো পারিশ্রমিককে তখনই যথোপযুক্ত বলা যাবে, যখন তা শ্রমিকের মানবিক অধিকার, সামাজিক মর্যাদা ও সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা দেবে।

মজুরি নির্ধারণের মূলনীতি

রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত একটি ঐতিহাসিক হাদিসকে ইসলামী শ্রম আইনে পারিশ্রমিক নির্ধারণের মাপকাঠি বিবেচনা করা হয়। তিনি বলেন, ‘তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং যার ভাইকে আল্লাহ তার অধীন করেছেন সে যেন তাকে তাই খাওয়ায়, যা সে নিজে খায়, তাই পরিধান করায়, যা সে পরিধান করে এবং তার ওপর এমন কোনো কাজের বোঝা চাপাবে না, যা তার সাধ্যাতীত। আর যদি এমন কাজের বোঝা চাপাতে বাধ্য হয়, তবে সে যেন তাকে এই বিষয়ে তাকে সাহায্য করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৫০)

উল্লিখিত হাদিসের আলোকে মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম (রহ.) চারটি মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন। তা হলো–

১. মালিক ও পুঁজিদার শ্রমিককে নিজের ভাইয়ের মতো মনে করবে। দুই সহোদর ভাইয়ের মধ্যে যেমন কোনো মৌলিক পার্থক্য থাকে না এবং যেরূপ সম্পর্ক বর্তমান থাকে, তাদের ভেতরও তেমন সম্পর্ক থাকবে।

২. খাওয়া-পরা-থাকা প্রভৃতি মৌলিক প্রয়োজন পূরণের মান মালিক ও শ্রমিকের উভয়ের সমান হবে। মালিক ও পুঁজিদার নিজে যা খাবে ও পরবে মজুর-শ্রমিককে তাই খেতে-পরতে দেবে; কিংবা অনুরূপ মানের পরিমাণ অর্থ মজুরিস্বরূপ দান করবে।

৩. সময় ও কাজ উভয় দিকে দিয়ে সাধ্যাতীত এমন কোনো কাজ মজুরের ওপর চাপানো যাবে না, যাতে সে সীমাহীন ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।

৪. কোনো কাজ সাধ্যাতীত হলে মজুরকে অতিরিক্ত সময় বা লোকবল দিয়ে সাহায্য করতে হবে। (ইসলামী অর্থনীতি, পৃষ্ঠা ১১০-১১১)

আরও পড়তে পারেন-

ইহকালীন ও পরকালীন জবাবদিহি

শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্র মালিকপক্ষকে আইনি জবাবদিহিতে বাধ্য করবে আর আইনের দৃষ্টি ফাঁকি দিতে পারলেও মালিক পরকালীন জবাবদিহিকে ভয় করবে। কেননা ইসলামের আদর্শ হলো শ্রমিক তার প্রাপ্য সম্পর্কে ওয়াকিফহাল না হলেও মালিক তাকে প্রাপ্য বুঝিয়ে দেবে। যেমন শোআইব (আ.) মুসা (আ.)-কে ডেকে এনে পারিশ্রমিক দিয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তখন নারীদ্বয়ের একজন সলজ্জ পায়ে তার কাছে এলো এবং বলল, আমার পিতা আপনাকে আমন্ত্রণ করেছেন আমাদের পশুগুলোকে পানি পান করানোর বিনিময় প্রদানের জন্য।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ২৫)

আর মহানবী (সা.) এই ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘যে জাতির দুর্বল লোকেরা জোরজবরদস্তি ছাড়া তাদের পাওনা আদায় করতে পারে না সেই জাতি কখনো পবিত্র হতে পারে না।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪২৬)

ইসলাম শুধু মালিককেই জবাবদিহির আওতায় আনেনি, বরং শ্রমিককেও জবাবদিহির আওতায় নিয়ে এসেছে। দায়িত্ব পালন ও বিশ্বস্ততাকে তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আপনার মজুর হিসেবে সেই উত্তম যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ২৬)

শ্রমিকের স্বার্থ সুরক্ষা কেন প্রয়োজন

মুসলিম সমাজবিজ্ঞানী আল্লামা ইবনে খালদুন বলেন, ‘শ্রমের মূল্য হ্রাস করা শ্রমিকের প্রতি অবিচার। যে ব্যক্তি উপযুক্ত পারিশ্রমিকের চেয়ে কম মূল্যে শ্রমিক নিয়োগ দিল, সে শ্রমিকের অধিকার লুণ্ঠন করল। শ্রমিক তার পরিশ্রমের সমান পারিশ্রমিক পাবে। কেউ যদি তার চেয়ে কম পারিশ্রমিক দেয়, তবে সে জুলুম করল। আর জুলুম ব্যক্তির জন্য ধ্বংসাত্মক, সভ্যতাকে দুর্বলকারী এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্টকারী।’ (মুকাদিমায়ে ইবনে খালদুন, পৃষ্ঠা ৫১২)

তিনি আরো বলেন, ‘কোনো ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ছাড়া মানবসভ্যতার সঠিক বিকাশ সম্ভব নয়। কেননা জুলুম মানবপ্রকৃতিতে মন্দ প্রভাব ফেলে। তা মনোবৃত্তিকে দুর্বল করে, প্রকৃতিকে অসুস্থ করে এবং তার সুকুমারবৃত্তি ধ্বংস করে। ফলে মানুষ হতাশ হয়ে যায়, জীবিকা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা হারিয়ে ফেলে। তখন তাদের কর্মস্পৃহা বিলুপ্ত হয় এবং সমাজের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়। এভাবে ক্রমেই মানবসভ্যতার বিপদ বাড়তে থাকে।’ (মুকাদিমায়ে ইবনে খালদুন, পৃষ্ঠা ৩৩৩)

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।