Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ মুসলিম উম্মাহর বিপর্যয়ের কারণ ও প্রতিকার

মুসলিম উম্মাহর বিপর্যয়ের কারণ ও প্রতিকার

অংকরণ: উম্মাহ গ্রাফিক্স।

।। শায়খুল হাদীস আল্লামা শেখ আহমদ ।।

বর্তমান যুগের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ ও বিপর্যয়গ্রস্ত। সর্বত্র রোগ-ব্যাধির প্রকোপ, নানা প্রকার আপদ-বিপদের ভীড় এবং হরেক রকম দুর্যোগ ও দুর্দশা ছড়িয়ে পড়ছে। সংকীর্ণতা ও দুর্মূল্য নিত্য দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। সুখ-শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির উপকরণ হ্রাস পাচ্ছে এবং অশান্তি ও অস্থিতিশীলতার উপকরণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বপ্রকার দুর্দশা ও দুর্গতির প্রসার ঘটছে এবং তা দিন দিন বেড়েই চলছে।

এর কারণ কী? কুরআনের আয়াত ও নবীর হাদিস থেকে পরিষ্কার ও স্পষ্ট জানা যায় এবং সুস্থ বিবেকও এর সাক্ষ্য প্রদান করে যে, এর একমাত্র কারণ পাপ ও অবাধ্যতার ছড়াছড়ি।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- “জলে ও স্থলে মানুষের কৃতকর্মের দরুণ বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে”। (সূরা রূম- ৪১)।

অন্যত্র ইরশাদ করেন- “এবং যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব। সে বলবে, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে কেন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলেন? আমি তো চক্ষুষ্মান ছিলাম। আল্লাহ বলবেন, এমনিভাবে তোমার কাছে আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, অতঃপর তুমি সেগুলো ভুলে গিয়েছিলে। তেমনিভাবে আজ তোমাকে ভুলে যাব”। (সূরা ত্বা-হা- ১২৪-২৭)।

হাদিস শরীফে ইরশাদ হয়েছে- হযরত যাইনাব বিনতে জাহাশ (রাযি.) বর্ণনা করেন, একদা হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় তাঁর কাছে এলেন। অন্য একটি রিওয়ায়াতে আছে, হুযুর (সা.) ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন। তখন তাঁর চেহারা মুবারক লাল বর্ণের দেখাচ্ছিল। আর তিনি বলছিলেন- আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই। আরববাসীর জন্য ধ্বংস ঐ পাপের কারণে যা অতি সন্নিকটে যে, আজ ইয়াজুয ও মাজুযের প্রাচীর এই পরিমাণ খুলে গেছে বলে স্বীয় বৃদ্ধাঙ্গুলী ও শাহাদত অঙুলি দ্বারা গোলাকৃতি বানিয়ে দেখালেন। হযরত যাইনাব (রাযি.) বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! আমাদের মাঝে সৎ, নেককার মানুষ থাকা সত্ত্বেও কি আমরা ধ্বংস হয়ে যাব? হুযূর (সা.) প্রতি উত্তরে বললেন, হ্যাঁ! যখন পাপ-পঙ্কিলতা বৃদ্ধি পাবে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত শরীফ-৪৫৬ পৃষ্ঠা)।

এ হাদিস দ্বারা পরিষ্কার বুঝা গেল যে, যখন গুনাহ, নাফরমানী ও মন্দ কাজের ব্যাপক প্রসার ঘটবে এবং গুনাহগার ও বদকার বা অসৎ-পাপী লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, তখন নেককার, সৎ ও সালিহীন লোক থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীতে আল্লাহর গযব প্রকাশ পাবে এবং তা মানুষের ধ্বংসের কারণ হবে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযি.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করলেন, হে মুহাজির সম্প্রদায়! যখন তোমরা পাঁচটি ব্যাপারে লিপ্ত হয়ে পড়বে (জানি না, তখন তোমাদের কী অবস্থা হয়) আমি আল্লাহ তাআলার আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যেন এগুলো তোমরা না পাও।

(১) কোন সম্প্রদায়ে যখন প্রাকাশ্যে অশ্লীলতা হতে থাকবে, তখন তাদের মাঝে মহামারী ও এমন রোগ প্রকাশ পেতে থাকবে, যা তাদের পূর্ববর্তীদের মাঝে কখনও দেখা যায়নি।
(২) যারা মাপে কম দেবে তারা দুর্ভিক্ষ, কঠোর পরিশ্রম ও শাসকদলের অত্যাচারের শিকার হবে।
(৩) যারা যাকাত আদায় করবে না, তাদের থেকে বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেওয়া হবে। যদি জীব-জন্তুর অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে কখনোই বৃষ্টিপাত হতো না।
(৪) যে সম্প্রদায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করবে, আল্লাহ তাআলা শত্রুদেরকে তাদের উপর চড়াও করে দেবেন, যারা তাদের সাথে ছিতানইকর্ম করবে।
(৫) যাদের শাসকগোষ্ঠী আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করবে না, আল্লাহ তাআলা তাদের মাঝে পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ ও আত্মকলহ সৃষ্টি করে দেবেন। (ইবনে মাজাহ শরীফ)।

হযরত আমর ইবনুল আস (রাযি.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি, যে সম্প্রদায়ে যিনা-ব্যভিচার প্রকাশ পাবে, তারা দুর্ভিক্ষ ও অভাব অনটনের শিকার হবে এবং যে সম্প্রদায়ে ঘুষের আদান-প্রদান হবে তারা শত্রু কাফিরদের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকবে। (আহমদ, মিশকাত শরীফ- ৩১৩ পৃষ্ঠা)।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, যখন কোন সম্প্রদায়ে খিয়ানত বা আত্মসাত প্রকাশ পাবে, তখন আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তর শত্রুর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত করে দেবেন। যে সম্প্রদায়ে যিনা-ব্যাভিচারের ব্যাপক প্রসার ঘটবে সেখানে অপমৃত্যু অধিক হারে দেখা দেবে। যে সম্প্রদায় মাপে কম দেবে, তাদের রিযিক বন্ধ হয়ে যাবে। যে সম্প্রদায় অন্যায় বিচার করবে তাদের মাঝে রক্তপাত বেশি হবে। আর যে সম্প্রদায় অঙ্গীকার ভঙ্গ করবে, আল্লাহ তাআলা তাদের উপর শত্রুকে চাপিয়ে দেবেন। (মুয়াত্তা মালিক, মিশকাত শরীফ- ৪৫৯ পৃষ্ঠা)।

হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- যখন রাষ্ট্রীয় সম্পদকে নিজ সম্পদ, আমানতকে গনীমত এবং যাকাতকে দণ্ড-জরিমানা মনে করা হবে, ধর্ম ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে ইলম শিক্ষা করা হবে, নিজের স্ত্রীকে মান্য করা হবে আর মায়ের অবাধ্যতা করা হবে, বন্ধু-বান্ধবকে নিকটবর্তী ও পিতাকে দূরে রাখা হবে, মসজিদ সমূহে উচ্চস্বরে আওয়াজ, শোরগোল ও ফিতনা-ফাসাদ বেড়ে যাবে, জাতির নেতা হবে পাপীষ্ঠ-নরাধম লোক, দলের নেতা হবে সর্বনিকৃষ্ট লোক, মানুষকে ইজ্জত-সম্মান করা হবে তার অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য, গায়িকা ও গান-বাজনার যন্ত্রপাতি প্রকাশ হবে, মদ্যপান করা হবে, জাতির পরবর্তীগণ পূর্ববর্তীগণকে মন্দ বলবে এবং রেশমী কাপড় ব্যবহার করা হবে; তখন তোমরা অগ্নি বর্ণের বাতাস, ভূমিকম্প, ভূমিধস, আকৃতি ও অন্তর বিকৃতি এবং উপর থেকে পাথর বা গোলাবর্ষণ হওয়ার অপেক্ষায় থাকো। অনুরূপভাবে অন্যান্য নিদর্শনাবলি উপর্যুপরি প্রকাশ পাবে, যেরূপ কোন মালার সুতা ছিঁড়ে গেলে তার দানা একের পর এক পড়তে থাকে। (তিরমিযী, মিশকাত শরীফ-৪৭০)।

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যখন আমার উম্মতের মাঝে গায়িকা ও গান-বাজনার যন্ত্রপাতি প্রকাশ পাবে, তখন ভূমিধস ও আকৃতি পরিবর্তনের আযাব আসবে। (তিরমিযী শরীফ)।

অন্য এক রিওয়ায়াতে আছে- হযরত ইব্নে উমর (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি, তাকদীর অমান্যকারীদের উপর ভূমিধস, আকৃতি বিকৃতি ও পাথর বা গোলা বর্ষণের আযাব আসবে। (মিশকাত শরীফ-২২ পৃষ্ঠা)।

মিশকাত শরীফে বর্ণিত হয়েছে- হযরত হুযাইফা (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ঐ আল্লাহর শপথ! যাঁর হাতে আমার জীবন, তোমরা “আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকার” করতে থাকো। নতুবা অচিরেই আল্লাহ তোমাদের প্রতি আযাব নাযিল করবেন। তখন তোমরা দোয়া করবে, কিন্তু তোমাদের দোয়া কবুল করা হবে না। (তিরমিযী, মিশকাত শরীফ- ৪৩৬ পৃষ্ঠা)।

হযরত আমীরায়ে কিন্দী (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাআলা বিশিষ্ট লোকদের পাপের কারণে সাধারণ লোকদেরকে ঐ পর্যন্ত শাস্তি প্রদান করেন না, যে পর্যন্ত তারা নিজেদের মাঝে কোন শরীয়ত বিরোধী কার্য অবলোকন করে এবং তা সংশোধন করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সংশোধন করে না। তখন আল্লাহ তাআলার শাস্তি বিশিষ্ট-সাধারণ সবাইকে পরিবেষ্টন করে ফেলে। (মিশকাত শরীফ- ৪৩৮)।

হযরত জাবির (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- একবার হযরত জিব্রাঈল (আ.)এর প্রতি আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিলেন যে, অমুক শহরটিকে তার অধিবাসীসহ উল্টিয়ে দাও। জিব্রাঈল (আ.) আরয করলেন, হে আমার প্রভু! তাদের মাঝেতো আপনার অমুক বান্দা আছেন, যিনি সামান্যতম সময়ের জন্যও আপনার নাফরমানী করেননি। আল্লাহ তাআলা বললেন, তাকেও শহরবাসীদের সঙ্গে উল্টিয়ে দাও। কেননা, আমার ব্যাপারে তার মুখমণ্ডল পর্যন্ত কখনোও বিবর্ণ হয়নি। (বাইহাকী, মিশকাত শরীফ- ৪৩৮ পৃষ্ঠা)।

উল্লিখিত হাদিস সমূহে বিভিন্ন ধরনের গুনাহর আলোচনা করা হয়েছে। তন্মধ্যে এমন কোন গুনাহটি বাদ রয়েছে, যাতে মুসলমানরা আজ লিপ্ত নয়? বরং বলা যায়, বর্তমানে মুসলমানরা অত্যন্ত দাম্ভিকতা ও অহংকারের সাথেই গুনাহগুলো করে যাচ্ছে। গুনাহকে গুনাহ মনে করছে না। উপরন্তু বর্তমান সমাজের অনেকেই গুনাহের কাজকে উত্তম কাজ এবং উত্তম কাজকে গুনাহের কাজ মনে করছে।

মুসলমানদের স্বভাব সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান, আদেশ-নিষেধ মানুষ ত্যাগ করছে বরং অনেক সময় অস্বীকারও করে বসছে। শরয়ী বিধানাবলির সাথে উপহাস করছে।

যারা গুনাহ ও অন্যায় কর্ম থেকে বাধা দিতে চান এবং সৎকর্মের দিকে আহ্বান করেন, তাদেরকে মানুষ শত্রু মনে করে এবং গালমন্দ করে। আলেম-উলামা ও ইলমে দ্বীন তথা ইসলামী শিক্ষার প্রতি অবমাননা করে। তাঁদেরকে সর্বদা গালিগালাজ, ভর্ৎসনা, তিরস্কার করেই চলছে। পাপিষ্ঠ, পথভ্রষ্ট, লুটপার, বাটপার ও দুষ্টু প্রকৃতির লোকদের প্রেম-ভালোবাসায় তাদের অন্তর টইটুম্বুর। তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। হাদিস শরীফে এসেছে- “যখন পাপিষ্ঠ ফাসিকদের প্রশংসা করা হয়, তখন আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে এবং আল্লাহ তাআলা খুবই রাগান্বিত হন”। আমানত-দিয়ানত বা সততা, নিষ্ঠা ও সংযম লোপ পেয়েছে। দুনিয়ার মুহাব্বত ও খিয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতা শিরা-উপশিরায় অনুপ্রবেশ করেছে।

নাস্তিকতা, সংশয়তা ও ধর্মহীনতা তাদের মন-মস্তিষ্কে প্রবেশ করেছে। আবু দাঊদ শরীফের নিম্নোক্ত হাদিসটি তার প্রমাণ বহন করে।

হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোকের উদ্ভব ঘটবে, যাদের শিরা-উপশিরায় এমনভাবে কু-প্রবৃত্তির অনুপ্রবেশ ঘটবে, যেমন পাগলা কুকুরের দংশিত ব্যক্তির শিরা-উপশিরা ও জোড়ায়-জোড়ায় উন্মাদনা বা পাগলামী প্রবিষ্ট হয়। (আহমদ, আবু দাঊদ, মিশকাত শরীফ- ৩০ পৃষ্ঠা)।

মুসলিম শরীফে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতিফলনও লক্ষ করা যাচ্ছে। ঐ দীর্ঘ হাদিসটির অংশ বিশেষের ভাবার্থ নিম্নরূপ-

এমন এক সময় আসবে, যখন আমার উম্মতের মধ্যে আমানত, সততা, নিষ্ঠা এমনভাবে লোপ পাবে, মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য তো করবে কিন্তু তাদের মধ্যে আমানতদারী খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি বলা হবে অমুক গোত্রে একজন আমানতদার মানুষ আছে। আর মানুষের উপর্যুপরি প্রশংসা করা হবে- কেমন বীর, কেমন বুদ্ধিমান, কেমন জ্ঞানী! অথচ তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান নেই। মুসলিম শরীফে বর্ণিত অন্য একটি হাদিস নিম্নরূপ-

হযরত হুযাইফা (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি, অন্তর সমূহে ফিতনা একের পর এক এমনভাবে প্রকাশ পেতে থাকবে যেমন মাদুরের এক একটি সেলাই। যেসব অন্তর সে ফিতনা সমূহের সাথে সংমিশ্রিত হবে, সেগুলোতে একটি কালো দাগ পড়ে যাবে।

আরও পড়তে পারেন-

আর যেসব অন্তর সে ফিতনাসমূহকে মন্দ মনে করবে, সেগুলোতে একটি সাদা দাগ পড়বে। এভাবে মানুষের অন্তর দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। একটি শ্বেতপাথরের ন্যায় নিখুঁত সাদা। সেসব অন্তরগুলোকে জমিন ও আসমান বহাল থাকা পর্যন্ত কোন ফিতনা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না। অপরটি হবে অত্যন্ত কালো বর্ণের। যেমন- উপুড় করে রাখা মাটির কোন পাত্র। ভালকে ভাল এবং মন্দকে মন্দ বুঝে না; বরং তাকেই ভালো মনে করে, যা তার মনের কু-প্রবৃত্তির সাথে মিলে যায়। (মুসলিম, মিশকাত- ৪৬১)।

অন্য এক হাদিসে বর্ণিত আছে যে, হুযুর আকরাম (সা.) ইরশাদ করেছেন, কিয়ামতের আলামতসমূহের মধ্যে একটি হচ্ছে, পাপিষ্ঠ ফাসিকদেরকে সম্মানিত এবং দ্বীনদার-পরহেযগার লোকদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হবে। আরেকটি হচ্ছে, কথার খৈ ফুটবে মুখে কিন্তু আমলের বেলায় শূন্য।

মুসনাদে ইমাম আযমে বর্ণিত আছে, হযরত হুযাইফা (রাযি.) বলেন, এক সময় ইসলাম এভাবে মিটে যাবে যেভাবে কাপড়ের রং বা ছাপা উঠে যায়। পৃথিবীতে  কিছু  বুড়োবুড়ি থাকবে যারা বলবে, আমাদের পূর্বে পৃথিবীতে কিছু লোক ছিল যারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলত। কিন্তু স্বয়ং সেসব বুড়োবুড়িরা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে না। (শরহে মুসনাদে ইমাম আযম- ২৭৬ পৃষ্ঠা)।

বর্তমান যুগের মানুষদের অবস্থার দিকে তাকালে মনে হয় যেন অতিশীঘ্রই উক্ত হাদীসের সত্যতা প্রকাশ পাবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হিফাযত করুন।

মুসলিম শরীফের এক রিওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে, অন্ধকারাচ্ছন্ন, কৃষ্ণ রজনীর ন্যায় ফিতনার আগমনের পূর্বেই নেককাজ করে নাও। সে সকল ফিতনায় মানুষ সকালে মু’মিন থাকলে বিকেলে কাফির এবং বিকেলে মু’মিন থাকলে সকালে কাফির হয়ে যাবে। তারা পার্থিব হীন স্বার্থের বিনিময়ে স্বীয় দ্বীন-ধর্ম পর্যন্ত বিকিয়ে দেবে।

বুখারী শরীফের এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- ‘অতি শীঘ্র এমন একটি সময় আসবে, যে সময় মুসলমানের উত্তম সম্পদ ঐ বকরী হবে, যাকে নিয়ে গিরিপথে ঝড়বাদলের মধ্যে ফিতনাসমূহ হতে পৃথক থেকে স্বীয় দ্বীন-ধর্মকে বাঁচানোর চিন্তা ফিকির করা হবে’।

মুজাহিরুল উলূম সাহারানপুর মাদরাসার শাইখুল হাদিস মাওলানা মুহাম্মদ যাকারিয়া (রাহ.) কর্তৃক রচিত ‘আল-ই’তিদাল ফী মারাতিবির রিজাল’ নামক গ্রন্থে ‘আল-ইশাআত’-এর বরাত দিয়ে কয়েকটি হাদিস উদ্ধৃত করা হয়েছে। যেমন একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- এমন একটি সময় আসছে, যখন আলেমগণকে অনুসরণ করা হবে না, সহনশীলগণকে লজ্জা করা হবে না, বড়দেরকে সম্মান করা হবে না, ছোটদেরকে স্নেহ করা হবে না, দুনিয়ার হীন স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যুদ্ধ-বিগ্রহ বা মারামারি, কাটাকাটি করা হবে, জায়েয বা বৈধকে বৈধ মনে করা হবে না, নাজায়েয বা অবৈধকে অবৈধ মনে করা হবে না এবং সৎলোকেরা আত্মগোপন করে চলবে, সে সময়ের মানুষ সৃষ্টির নিকৃষ্টতম প্রাণী বলে গণ্য হবে। আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না।

অন্য এক হাদিসে আছে- এমন সময় আসবে, যখন আলেম-উলামাগণ খাঁটি গিনি সোনার চেয়েও মৃত্যুকে বেশি প্রিয় মনে করবে। অন্য এক হাদিসে আছে- এমন সময় আসবে, যখন আলেম-উলামাগণকে কুকুরের ন্যায় হত্যা করা হবে। আরেকটি হাদিসে আছে- মু’মিন যদি গুঁই সাপের গর্তেও প্রবেশ করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা সেখানেও তার উপর কোন মুনাফিক বা এমন কোন লোককে চড়াও করে দেবেন, যে তাকে কষ্ট দেবে।

বর্তমানে নিঃসন্দেহে এসকল হাদিসের সত্যতা চাক্ষুস প্রতীয়মান হচ্ছে। এক কথায় বলতে গেলে বর্তমান ফিতনাপূর্ণ এই যামানায় মানুষ বিপর্যয়গ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে মুসলমানদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। মুসলমানদের দুর্দশা দিন দিন বেড়েই চলছে।

মুসলমানরা বিপর্যয়গ্রস্ত হবে না কেন? মুসলমানরা পাপের উপকরণ খুব বেশি অবলম্বন করছে। সকল বিপর্যয় ও ধ্বংসের মূল কারণ হল পাপ-পঙ্কিলতা। পাপ বড় জঘন্য বিষয়।

মাজালিসুল আবরার নামক গ্রন্থে ফকীহ আবুল-লাইস (রহ.) থেকে বর্ণিত আছে, প্রত্যেকটি পাপে বড় বড় দশটি ক্ষতি রয়েছে। যথা- (১) আল্লাহ তাআলাকে অসন্তুষ্ট করা। (২) অভিশপ্ত ইবলিশের মতো শত্রুকে সন্তুষ্ট করা। (৩) নিজের আত্মার উপর অত্যাচার করা। (৪) নিজেকে বেহেশত থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া। (৫) নিজেকে দোযখের নিকটবর্তী করা। (৬) স্বীয় পবিত্র আত্মাকে অপবিত্র করা। (৭) হিফাযতকারী ফিরেশতাগণকে কষ্ট প্রদান করা। (৮) হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)কে পেরেশান করা ও কষ্ট দেওয়া।

(৯) দিবানিশি আসমান-যমীনকে স্বীয় পাপের সাক্ষী বানানো এবং (১০) গোটা জগতের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা। কেননা, পাপের কারণেই পুরো বিশ্বে বিপদ-আপদ ছড়িয়ে পড়ে।

মিশকাত শরীফে একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) এক ব্যক্তিকে বলতে শুনলেন যে, অত্যাচারী তার অত্যাচার দ্বারা বা যালিম তার যুলুম দ্বারা শুধু নিজেরই ক্ষতি সাধন করে থাকে। হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) বললেন- হ্যাঁ, (সে অন্যেরও ক্ষতি সাধন করে) আল্লাহর কসম! ‘তগদরী’ পাখীও (যে পাখী দূর দুরান্ত থেকে আহার সংগ্রহ করে এবং দুর্ভিক্ষের প্রভাব তার উপর পড়ে না। সেও) যালিমের শনির কারণে নিজ বাসায় অনাহারে দুর্বল হয়ে প্রাণ হারায়। (বাইহাকী, মিশকাত- ৪৩৬ পৃষ্ঠা)।

আরেক হাদিসে আছে, পাপিষ্ঠদেরকে সব কিছুই অভিসম্পাত করে। এমনকি স্ব-স্ব বাসার পাখীরাও।

মোদ্দাকথা, ধর্মীয় ও পার্থিব বিপর্যয়ের আসল কারণ হলো এই পাপাচার। আর সর্ব প্রকার মঙ্গল, কল্যাণ, উন্নতি, অগ্রগতি এবং ধর্মীয় ও পার্থিব শান্তি, স্থিতিশীলতা একমাত্র আল্লাহর নিরঙ্কুশ আনুগত্য ও ইবাদত-বন্দেগীতেই নিহিত।

ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গল, শান্তি-প্রশান্তি, স্থিতিশীলতা ও বাস্তবিক সম্মান যদি চাও, তাহলে আল্লাহ তাআলার নিরঙ্কুশ গোলামী করো, ইবাদত-বন্দেগী করো, ইসলামী শরীয়তের বিধি-বিধান অনুযায়ী চলো, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণকে নিজের অভ্যাসে পরিণত করো এবং পাপাচার পরিত্যাগ কর। ইনশাআল্লাহ, পৃথিবীতেও স্থিতিশীল ও শান্তিময় জীবন পেয়ে যাবে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং পরহেযগারী অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের প্রতি আসমানী ও পার্থিব নিয়ামতসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি তাদের কৃত- কর্মের বদলাতে। (সূরা আ’রাফ- ৯৬)।

অন্যত্র ইরশাদ করেন, যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং যে ঈমানদার, সে পুরুষ হোক কিংবা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরস্কার দেব, যা তারা করত। (সূরা নাহল- ৯৭ আয়াত)।

হুযুর (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যদি আমার বান্দারা আমার আনুগত্য করত, তাহলে আমি তাদের প্রতি রজনীতে বৃষ্টি বর্ষণ করতাম, দিবসে সূর্যোদিত করতাম এবং তাদেরকে কখনো বজ্রধ্বনি শোনাতাম না। (আহমদ, মিশকাত- ৪৫৪ পৃষ্ঠা)।

হযরত আবু যর গিফারী (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- কুরআন শরীফের একটি আয়াত আমার জানা আছে। মানুষ যদি তার উপর আমল করত, তাহলে তাদের জন্য এই একটি আয়াতই যথেষ্ট হয়ে যেত। আয়াতটি হলো, অর্থাৎ- যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য পথ খুলে দেন এবং তাকে এমনভাবে রিযিক বা জীবিকা প্রদান করেন, যা তার কল্পনাতীত। (ইবনে মাজাহ, দারমী, মিশকাত- ৪৫৩ পৃষ্ঠা)।

হযরত আবু দারদা (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “(হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন) আমিই আল্লাহ। আমি ছাড়া অন্য কোন উপাস্য বা মাবুদ নেই। আমি সকল বাদশাহর মালিক। আমি রাজাধিরাজ। সকল রাজা-বাদশাহর অন্তর আমার হাতে। যদি আমার বান্দারা আমার আনুগত্য করে, তাহলে আমি তাদের শাসকদের অন্তর তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে দেবো। আর যদি তারা আমার নাফরমানী-অবাধ্যতা করে, তাহলে আমি তাদের শাসকদের অন্তর তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট, ক্ষীপ্র ও হিংস্র করে দেবো। তারা তাদেরকে লাঞ্ছনাময় শাস্তি ভোগ করাবে। সুতরাং তোমরা তখন নিজেদেরকে শাসকদের প্রতি বদ-দোয়া ও অভিসম্পাত দানে মশগুল রেখ না। বরং আমার স্মরণ এবং আমার দরবারে রোনাযারী ও আহাযারীতে মশগুল হয়ে পড়। তবেই আমি তোমাদের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাব”। (মিশকাত শরীফ- ৩২৩ পৃষ্ঠা)।

প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! স্বীয় আত্মার উপর দয়া করুন, পাপাচার পরিত্যাগ করুন, পরওয়ারদিগারে আলম, মালিকে হাকীকী মহান প্রভুর ইবাদত বা তাঁর নিরঙ্কুশ আনুগত্য করুন, কুরআন-হাদিস অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করুন এবং ইসলামী শরীয়তের বিধি-বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন। নতুবা ইহকাল ও পরকাল উভয় জায়গাতেই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

প্রিয় ভাইয়েরা! বেশি বেশি রোনাযারী করে আল্লাহর নিকট দোয়া করতে থাকুন। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা স্বীয় প্রভুকে রোনাযারী করে অনুনয় বিনয়ের সাথে চুপে চুপে ডাক। তিনি আরও বলেন, তোমরা আমাকে ডাক। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো। আমার কাছে প্রার্থনা করো। আমি তোমাদের প্রার্থনা কবুল করব।

দোয়ায়ে ইউনূসের বরকতে হযরত ইউনূস (আ.) কত বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। যদি এই মুবারক দোয়াটি পাঠ না করতেন, তাহলে মাছের পেট থেকে মুক্তি লাভ করতেন না।

যেমন- কুরআন শরীফের একটি আয়াত এর প্রমাণ বহন করে। বলা হয়েছে, যদি তিনি আল্লাহর তাসবীহ পাঠ না করতেন, তবে তাঁকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত মাছের  পেটেই থাকতে হতো। (সাফফাত- ১৪৩, ১৪৪)।

ইস্তিগফার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি সর্বদা ইস্তিগফার করতে থাকবে, আল্লাহ তাআলা তাকে সর্বপ্রকার সংকীর্ণতা থেকে প্রশস্ততা দান করবেন। তার প্রত্যেক পেরেশানী-দুশ্চিন্তা দূরীভূত করে দেবেন এবং তাকে এমনভাবে রিযিক বা জীবিকা প্রদান করবেন, যা তার কল্পনাতীত। (আহমদ, আবু দাঊদ, মিশকাত শরীফ-২০৪ পৃষ্ঠা)। আর দরূদ শরীফের ফযীলত ও বরকত তো বে-শুমার। যার কোন শেষ নেই। ওয়ামা আলাইনা ইল্লাল বালাগ।

লেখক: প্রবীণ আলেম, সদরুল মুদাররেসীন ও শায়খুল হাদীস, জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।