Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ বর্বর লুপারক্যালিয়া থেকে ভালোবাসা দিবস!

বর্বর লুপারক্যালিয়া থেকে ভালোবাসা দিবস!

।। ত্বরিকুল ইসলাম ।।

ভ্যালেন্টাইন’স ডে বা আজকের ভালোবাসা দিবসের উৎপত্তি ও ইতিহাস নিয়ে নানান গুজব, মিথ ও রহস্য আজঅব্দি বিদ্যমান। এর ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কেচ্ছা প্রচলিত। তবে, এতে সন্দেহ নাই যে- ভ্যালেন্টাইন’স ডে ক্যাথলিক খ্রিস্টান চার্চ কর্তৃক প্রবর্তিত! ভ্যালেন্টাইন নামে একজন ধার্মিক খ্রিস্টানের স্মরণে এই দিবস চালু করা হয়।

এর নেপথ্য ইতিহাস হলো- তৃতীয় শতাব্দীতে প্রাচীন রোমের তৎকালীন সম্রাট দ্বিতীয় ক্যালুডিয়াস সিদ্ধান্ত নেন যে, যেহেতু তার মতে, সিঙ্গেল যুবকরা যোদ্ধা হিসেবে বিবাহিত পুরুষদের চেয়েও অনেক শক্তসমর্থ, সেহেতু তিনি আইন করে বিবাহপ্রথাকে নিষিদ্ধ করে দেন।

তখন রোমে প্যাগানিজম বা পৌত্তলিকতার জয়জয়কার অবস্থা ছিল। খ্রিস্টধর্মকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। যাই হোক, ধার্মিক খ্রিস্টান ভ্যালেন্টাইন সেটা মানতে পারলেন না, বরং রাজার এই আইনকে অন্যায় মনে করলেন।

তাই তিনি গোপনে যুবক-যুবতী তথা প্রেমিক-প্রেমিকাদের বিয়ের জন্য উৎসাহ ও প্রেরণা দিতেন। এমনকি রাজার আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়েতে সহায়তা, সমর্থন ও অবদান রাখতেন। যখন তার এই আইনবিরুদ্ধ কাজের কথা প্রকাশ পায়, তখন তাকে গ্রেপ্তার করে পৌত্তলিক রাজা ক্যালুডিয়াস মৃত্যুদণ্ড দেন।

এরপর এই আত্মত্যাগের জন্য ভ্যালেন্টাইনকে Martyr বা খ্রিস্টধর্মের স্বার্থে প্রাণোৎসর্গকারী হিসেবে স্মরণে রাখার উদ্দেশ্যে আনুমানিক ২৭০ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখকে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন’স ডে হিসেবে নির্ধারিত করে ক্যাথলিক খ্রিস্টান চার্চ। এছাড়া চার্চ কর্তৃক ভ্যালেন্টাইনকে Saint বা সাধুসন্ত বলেও অভিহিত করা হয়।

পরবর্তীতে পঞ্চম শতাব্দীতে রোমে খ্রিস্টধর্ম আধিপত্য লাভ করলে প্রাচীন রোমানদের ’লুপারক্যালিয়া’ নামক একটা বর্বর পৌত্তলিক আচারকে খ্রিস্টানাইজ করার উদ্দেশ্যে ক্যাথলিক পোপ প্রথম গেলাসিয়াস ভ্যালেন্টাইন’স ডে-কে ‘লুপারক্যালিয়া’র সাথে সমন্বয় করেন—যাতে করে প্রাচীন রোমানদের প্যাগান বা পৌত্তলিক ধর্মব্যবস্থাকে ঠেকিয়ে রোমে খ্রিস্টধর্মের আরো প্রাধান্য ও সম্প্রসারণ লাভ করা সম্ভব হয়।

যাই হোক, লুপারক্যালিয়া হলো রোমানদের একটা প্রাচীন পৌত্তলিক রিচুয়াল। এই লুপারক্যালিয়া উৎসব প্রাচীন রোমানরা পালন করতো ফেব্রুয়ারির ১৩-১৫ তারিখ পর্যন্ত। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিটাই ছিল নির্ধারিত। উৎসব চলাকালীন সিঙ্গেল যুবতীদের লাইন ধরে দাঁড় করানো হতো। আর সিঙ্গেল যুবকরা রোমান রাজ্যের প্রতিষ্ঠাদেবতা রোমুলাস ও রিমুসকে উৎসর্গ করে একটা ছাগল এবং একটা কুকুর বলি দিতো।

তারপর উৎসর্গকৃত সেই ছাগল ও কুকুরের চামড়া দিয়ে চাবুক বানিয়ে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই যুবতীদের চাবুক দিয়ে প্রহার করা হতো। এতে করে সেই যুবতীরা আরো উর্বর বা স্বাস্থ্যবতী হবে বলে তাদের কুসংস্কার ছিল।

এরপর একটা লটারি করা হতো। লটারি অনুসারে চাবুকের প্রহারপ্রাপ্ত যুবতীদের ভাগাভাগি করে নিতো ঐ যুবকরা। যতদিন উৎসব চলতো, ততদিন যুগলবন্দি কাপলরা ইচ্ছামতো প্রেম ও যৌনাচার করতো। সুতরাং, ভ্যালেন্টাইনস ডে’র সাথে এহেন বর্বর লুপারক্যালিয়া উৎসবের সম্পর্ক ঐতিহাসিক!

কলোরাডো ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক নোয়েল ল্যাংস্কি ভ্যালেন্টাইনস ডে’র উৎসবকে ‘a little more of drunken revel’ অর্থাৎ বেশ মাতলামির উৎসব বলেছেন। এবং বলেছেন, খ্রিস্টানরা এখনো এটা উদযাপন করে থাকে।

দুঃখের বিষয়, আজকে মুসলিম ছেলেমেয়েরা অজ্ঞতাবশত এবং কর্পোরেট বিজ্ঞাপণ ও প্রচারণার ফাঁদে পড়ে পশ্চিমা খ্রিস্টানদের নগ্ন ও অশ্লীল উৎসব ’ভ্যালেন্টাইন’স ডে বা ভালোবাসা দিবস’ সোৎসাহে পালন করছে! এই দিনে ব্যভিচার ও অবাধ যৌনাচার ব্যাপ্তি পায়। আবাসিক হোটেলগুলোতে সব রুম জোড়ায় জোড়ায় অগ্রিম বুকিং হয়ে যায়। এই দিবসকে কেন্দ্র করে কনডম, পিল ইত্যাদির বিক্রি অনেক বেড়ে যায়!

এছাড়া ফেব্রুয়ারির কয়েক মাস পর থেকে ক্লিনিকগুলোতে এবরশনের হারও বেড়ে যায়। ভ্রুণহত্যার মতো জঘন্য অমানবিক কর্মকাণ্ড ও চারিত্রিক অবক্ষয় ছাড়াও ভ্যালেন্টাইন’স ডে সর্বোপরি তথাকথিত ভালোবাসার একটা কর্পোরেট বাণিজ্যিক দিবসে পরিণত হয়েছে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইংরেজি পত্রপত্রিকার কলামিস্ট।