।। মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী ।।
প্রায় সত্তর বছর আগের কথা। আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ.-এর প্রিয় ছাত্র, খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও কবি আল্লামা নজির আহমদ আনোয়ারী (রহ.) হাটহাজারী মাদরাসার শাইখুল আদব তথা আরবী ও উর্দূ সাহিত্য বিভাগের প্রধান ছিলেন। তখন বাংলাদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান এবং স্বাভাবিকভাবেই উর্দূ ভাষার চর্চা ছিল অধিক প্রচলিত।
সেসময় ‘তারিখে বেনা’ (ভিত্তি স্থাপনের তারিখ), ‘তারিখে বেলাদত’ (জন্ম তারিখ) এবং ‘তারিখে ওফাত’ (মৃত্যুর তারিখ) হরফে আবজাদ পদ্ধতিতে নির্ণয় করা একপ্রকার সাহিত্যিক কৃতিত্ব হিসেবে বিবেচিত হতো। এই নিয়ে সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রায়ই প্রতিযোগিতা চলত। আজ সে ধারা বিলুপ্ত। বর্তমান প্রজন্মের অনেকে তো এসব বিষয়ে ভাবেই না, এমনকি হাটহাজারী মাদরাসার শাহী তোরণে খোদিত “تسر الناظرين ۱۹۰۱”—এই লিখনীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যও হয়তো দু-চারজন ছাড়া কেউ বলতে পারবে না।
আল্লামা নজির আহমদ আনোয়ারী (রহ.) সমকালীন সময়ের শুধু একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিকই ছিলেন না, বরং ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম। আরবী, ফার্সি ও উর্দূ ভাষায় তাঁর কবিতার সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবে। দুঃখজনক হলো—এই বিপুল সাহিত্যভাণ্ডার সংরক্ষিত হয়নি। কেন সংরক্ষিত হয়নি, তা আমি জানি, কিন্তু এখানে তা লিখছি না। কারণ, আমি আমাদের আকাবিরদের আদর্শকে শ্রদ্ধা করি এবং তাঁদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তকে মান্য করি।
আফওয়ান! অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিলাম। মাওলানা নজির আহমদ আনোয়ারী (রহ.) শুধুমাত্র একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক ছিলেন—এ কথা বললে তাঁর পরিচয় অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনি ছিলেন বড় মাপের একজন বুযুর্গ ও আল্লাহর একজন খাছ ওলী।
হাটহাজারী মাদরাসার প্রথম দারুল হাদীসে ছাত্রসংখ্যা আশাতীত হারে বৃদ্ধি পাওয়ার পর কর্তৃপক্ষ হাদীসের দারস নতুন স্থানে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৩৭৬ হিজরিতে (১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে) নতুন দারুল হাদীসের নির্মাণ সম্পন্ন হয়। সেই সময়কার মুহতামিম আল্লামা শাহ আবদুল ওয়াহ্হাব (রহ.) প্রথম দারুল হাদীসের দরজায় খোদিত “تسر الناظرين ۱۹۰۱”-এর ন্যায় নতুন দারুল হাদীসের তারীখে সনে তাসিস (ভিত্তি স্থাপনের সাল) হরফে আবজাদ অনুযায়ী নির্ধারণ করার জন্য শিক্ষকমণ্ডলীর ওপর দায়িত্ব অর্পণ করেন।
দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন সম্ভব হচ্ছিল না। এক বৈঠকে সকল শিক্ষক একবাক্যে বললেন—তারা এ দায়িত্ব পালন করতে অক্ষম। অতঃপর মুহতামিম সাহেব আল্লামা নজির আহমদ আনোয়ারী (রহ.)কে সরাসরি দায়িত্ব দেন এবং কঠোরভাবে বলেন, “আগামীকাল আমার হাতে দারুল হাদীসের তারীখে সনে তাসিস জমা চাই। এ কাজ আপনার দ্বারাই সম্ভব।”
আল্লামা আনোয়ারী (রহ.) এবার রীতিমতো চাপে পড়ে গেলেন। মনে মনে সংকল্প করলেন—যেভাবেই হোক, আজ রাতেই নির্ভুলভাবে হরফে আবজাদের হিসেব অনুযায়ী সেই নির্দিষ্ট সাল (১৩৭৬ হি.) বের করতে হবে।
মাগরিবের পর তিনি কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়লেন। রাতভর—শুধু ইশার নামায ও রাতের আহারের বিরতি ছাড়া—একনাগাড়ে চেষ্টা চালাতে থাকলেন। কিন্তু রাত তিনটা পর্যন্ত কোনোভাবেই নির্ভুল সংখ্যাটা মিলে না। হয় দু-তিন সংখ্যা বেশি হয়ে যায়, নয়তো কম। বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও সঠিকভাবে ‘১৩৭৬ হি.’ মেলানো যাচ্ছিল না।
হরফে আবজাদের হিসাব যারা জানেন অথবা অন্তত কিছুটা বোঝেন, তারা বুঝতে পারবেন—এ ধরনের একটি নির্দিষ্ট সনে মিলিয়ে বাক্য গঠন করা কতটা চিন্তাশক্তি, ধৈর্য ও গভীর জ্ঞানের দাবি রাখে। আমি নিজেও একবার একটি নামের সন্নে বেলাদত (জন্ম-সাল) হরফে আবজাদ অনুযায়ী নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছিলাম। টানা তিন মাস ধরে চেষ্টা চালিয়ে শেষে খাতা-কলম রেখে দিয়েছি। আজও তা আর সম্ভব হয়নি, জন্মতারিখটিও নির্ধারিত হয়নি।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
আল্লামা নজির আহমদ আনোয়ারী (রহ.) সেই রাতে, রাত তিনটা পর্যন্ত একনাগাড়ে চেষ্টা করে যখন কোনোভাবে ‘১৩৭৬’ সাল নির্ধারণ করতে পারলেন না, তখন হতাশাগ্রস্ত ও আত্মভগ্ন হৃদয়ে নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়লেন। অন্যদিনের মতোই ঘুমের পূর্বে তিনি ঘুমের দোআ ও দুরুদ শরীফ পাঠ করেছিলেন।
তাহাজ্জুদের পূর্ব মুহূর্তে—সে ঘুমঘোর অবস্থায়—রহমতে দু’আলম হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ঘুমঘরে তাশরীফ আনলেন। স্বপ্নযোগে নবীজি (সা.) আল্লামা নজির আহমদ আনোয়ারী (রহ.)কে জাগিয়ে বললেন- قم يا نذير! أنا ببابك حاضر. “হে নজির! উঠে বসো, আমি তোমার দরজায় উপস্থিত।”
রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন- “তুমি যখন বারবার চেষ্টা করে হাটহাজারী মাদরাসার দারুল হাদীসের—যেখানে আমার হাদীসের দরস প্রদান করা হবে—সন্নে তাসিস নির্ধারণে ব্যর্থ হচ্ছিলে, আমি তা পেছন থেকে নিরবভাবে প্রত্যক্ষ করছিলাম। এখন উঠে বসো, কলম ও খাতা হাতে নাও এবং লিখো— فَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ (‘আর আপনার প্রতিপালকের নিয়ামতের কথা প্রকাশ করুন’ — সূরা আদ্-দুহা- ১১)। এবার এই আয়াতের হরফে আবজাদ হিসাব করো। ইনশাআল্লাহ, যোগফল ‘১৩৭৬’ হবে।”
আল্লামা নজির আহমদ আনোয়ারী (রহ.) সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে জেগে উঠে বসলেন, কলম ও খাতা নিয়ে আয়াতটি লিখলেন- فَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ
হিসাব করে দেখলেন—আশ্চর্য হলেও সত্য—এই আয়াতের হরফে আবজাদ যোগফল ১৩৭৬ হিজরি। এভাবেই নবীজি (সা.)এর ইশারায় হাটহাজারী মাদরাসার দ্বিতীয় দারুল হাদীসের সন্নে তাসিস নির্ধারিত হলো।
প্রিয় পাঠক! হাটহাজারী মাদরাসার শাহী গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই পশ্চিম দিকে তাকাবেন—চোখ আটকে যাবে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে। সেখানে সুবর্ণ হরফে উৎকীর্ণ— فَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ (“আর আপনার প্রতিপালকের নিয়ামতের কথা প্রকাশ করুন।”)। এই আয়াতের নিচেই লেখা—১৩৭৬ হিজরি।
এটিই সেই সাবেক দারুল হাদীস, যার সাথে জড়িয়ে আছে হাজারো হৃদয়ের স্মৃতি ও শ্রদ্ধা। আমরা এখানেই শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আবদুল আযীয সাহেব (রহ.)এর কাছে হাদীসের দরস গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম। এই নয়নাভিরাম দৃশ্য কি আপনারা কখনো প্রত্যক্ষ করেছেন?!
আমি নিজে কত শত, কত হাজারবার এই চিত্র অবলোকন করেছি—তবুও কেন জানি চোখ তৃপ্ত হয় না, অন্তর প্রশান্ত হয় না। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলেও ক্লান্তি আসে না, বরং হৃদয়ের গভীরে ভালো লাগা ও ভালোবাসার এক শুদ্ধ, মমতাময় অনুভূতি প্রবাহিত হতে থাকে।
এই মাদরাসাই তো আমার চেতনার বাতিঘর, ঈমান-ইসলাম রক্ষার দুর্গ। আমার অস্তিত্বের প্রতিটি বিন্দুতে এর অবদানের ছাপ বিদ্যমান।
লেখক: ফাযেলে দারুল উলূম দেওবন্দ এবং মুহাদ্দিস, জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ