Home ইতিহাস ও জীবনী কারবালা ট্র‍্যাজেডিঃ অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীনতার এক নির্মম অধ্যায়

কারবালা ট্র‍্যাজেডিঃ অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীনতার এক নির্মম অধ্যায়

।। মাওলানা নিজাম সাইয়্যিদ ।।

৬১ হিজরির ১০ মুহাররম।ইসলামের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়।যেদিন কারবালা প্রান্তরে নির্মমভাবে শহিদ করা হয় মহানবী (সাঃ) এর দৌহিত্র হযরত হোসাইন (রাঃ) কে।তাই এই দিনটি ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমণ্ডিত।

মর্মান্তিক এই ঘটনার সূত্রপাত:

হজরত মুয়াবিয়া (রা.) ২০ বছর খলিফা হিসাবে রাষ্ট্র পরিচালনার পর হিজরি ৬০ সালে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর ইয়াজিদ অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে।তখন হযরত হোসাইন (রাঃ) ইরাকে অবস্থান করছিলেন।ক্ষমতায় গ্রহণ করেই ইয়াযিদ হযরত হোসাইন (রাঃ)তার হাতে বাইআত গ্রহণের জন্য চাপ দিতে থাকে এবং নানা ধরনের অত্যাচার চালাতে থাকে।এক পর্যায়ে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে মদিনা মুনাওয়ারায় চলে যান।

ইয়াজিদ ছিল নিষ্ঠুর, মদ্যপ ও দুষ্ট প্রকৃতির লোক। এ কারণে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ তাকে ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি।পক্ষান্তরে মক্কা-মদিনা ও কুফার জনগণ হযরত হোসাইন (রা.)-কে খলিফা হিসাবে দেখতে চেয়েছে। এরই মধ্যে এক সময় কুফার লক্ষাধিক মানুষ হযরত হোসাইন (রা.)-কে পত্র প্রেরণ করেন। এ পত্রে তারা দাবি জানান, সুন্নাহ পুনর্জীবিত এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে অবিলম্বে তার দায়িত্ব গ্রহণ করা প্রয়োজন।মদিনায় অবস্থানরত সাহাবিরা এবং তাঁর আপনজনরা এ সময় তাঁকে কুফায় যেতে বারণ করেন। কারণ তারা আশঙ্কা করছিলেন, ইয়াজিদের পক্ষ থেকে বাধা এলে ইরাকবাসী হোসাইন (রাঃ) এর পক্ষ ত্যাগ করবে।তখন হজরত হোসাইন (রা.) তার চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে ইরাকের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠান। আর বলে দেন, যদি সে পরিস্থিতি অনুকূল দেখে এবং ইরাকবাসীর অন্তর সুদৃঢ় ও সুসংহত মনে হয়, তাহলে যেন তার কাছে দূত প্রেরণ করে।মুসলিম ইবনে আকিল কুফায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে ১৮ হাজার কুফাবাসী তার কাছে এসে হযরত হোসাইন(রাঃ)এর পক্ষে বাইয়াত গ্রহণ করে এবং তারা শপথ করে বলে, অবশ্যই আমরা জানমাল দিয়ে হযরত হোসাইন (রাঃ)কে সাহায্য করব। তখন মুসলিম ইবনে আকিল হযরত হোসাইন (রা.)-এর কাছে পত্র পাঠিয়ে জানান যে, কুফার পরিস্থিতি সন্তোষজনক।তিনি যেন আগমন করেন।

হযরত হোসাইন (রাঃ) এর কুফায় গমণঃ

ইয়াজিদের বিরুদ্ধে কুফাবাসীর সাহায্যের প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হয়ে হজরত হোসাইন (রা.) তার পরিবারের ১৯ জন সদস্যসহ প্রায় ২০০ অনুচর নিয়ে কুফার উদ্দেশে রওনা হন। জিলহজ মাসের ৮ তারিখে হযরত হোসাইন (রা.) কুফার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন।এ খবরে ইয়াজিদ উত্তেজিত হয়ে কুফার গভর্নর নোমান ইবনে বশির (রা.)-কে পদচ্যুত করে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে কুফার দায়িত্ব প্রদান করে।হযরত হোসাইন (রা.) যেন কোনোভাবেই কুফায় প্রবেশ করতে না পারে সে নির্দেশও দেয় পাপিষ্ঠ ইয়াজিদ।

হয় আপোষ নয়তো শাহাদাতঃ

ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ কুফায় পৌঁছে সেখানকার জনগণকে কঠোর হস্তে দমন করে এবং মুসলিম বিন আকিলকে হত্যা করে। এরপর ইমাম হোসাইন (রা.)-কে প্রতিরোধ করতে চার হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী প্রেরণ করে। পরিবার ও সঙ্গীদের নিয়ে হযরত হোসাইন (রা.) ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে পৌঁছলে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের বাহিনী তাঁদের অবরোধ করে ফেলে এবং ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয়। হযরত হোসাইন (রা.)-এর শিবিরে পানির হাহাকার শুরু হয়ে যায়।

আরও পড়তে পারেন-

এ সময় হযরত হোসাইন (রা.) কুফাবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন,তোমরা আমাকে ডেকেছ বলেই আমি এসেছি। এখন তোমরাই তোমাদের বাইয়াত পরিত্যাগ করছ। ইয়াযিদের অনুসারীদের উদ্দেশ্যে ৩টি প্রস্তাব পেশ করেন, ১. আমাদের মদিনায় ফিরে যেতে দাও। ২.সীমান্তে যুদ্ধ করি। ৩. আমাকে ইয়াজিদের কাছে নিয়ে চল,আমি তার সঙ্গে বোঝাপড়া করি।

কিন্তু ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ হযরত হোসাইন (রা.)-কে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে ইয়াযিদের হাতে বাইআত গ্রহণের শর্তারোপ করলে হযরত হোসাইন (রাঃ) তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন।

কুখ্যাত ইয়াযিদ বাহিনীর নির্মমতা,যা পাষাণ হৃদয়কেও বিগলিত করেঃ

১০ই মহররম সকাল থেকে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের নেতৃত্বে প্রায় ৪ হাজার ইয়াজিদ বাহিনী হোসাইন (রা.)-এর ওপর আক্রমণ চালাতে শুরু করে।হযরত হোসাইন (রা.) সাথিদের নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকেন। এ যুদ্ধে একমাত্র ছেলে হজরত জয়নুল আবেদিন (রহ.) ছাড়া পরিবারের শিশু, কিশোরসহ অন্য সদস্যগণ একে একে শাহাদতবরণ করেন।

মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত হযরত হোসাইন (রাঃ) একাই লড়াই চালিয়ে যান।এক পর্যায়ে সিনান ইবনে আবি আনাস নাখায়ি হত্যা করে।এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে তাকে সহযোগিতা করে খাওলি ইবনে ইয়াজিদ আসবাহি হিময়ারি।সে হযরত হোসাইন (রাঃ) এর মাথা মোবারক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে তা ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের দরবারে নিয়ে যায়।পরে সেই মাথা মোবারক বর্শা ফলকে বিদ্ধ করে দামেস্কে ইয়াজিদের কাছে প্রেরণ করা হয়। হযরত হোসাইন (রাঃ) এর খণ্ডিত মাথা মোবারক দেখে ইয়াজিদ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পড়ে।

সেদিন কারবালার প্রান্তরে এই পাপিষ্ঠরা যে নির্মমতা দেখিয়েছে,তা পাষণ হৃদয়েও ব্যথা ও যাতনার সৃষ্টি করে।শাহাদাতের পর হজরত হোসাইন (রা.)-এর দেহ মোবারকে মোট ৩৩টি বর্শা ও ৩৪টি তরবারির আঘাত দেখা যায়। শরীরে ছিল অসংখ্য তীরের জখমের চিহ্ন।এ অসম যুদ্ধে একমাত্র ছেলে হজরত জয়নুল আবেদিন (র.) ছাড়া ৭০ থেকে ৭২ জন শহিদ হন।

ইয়াযিদের পরিণতিঃ

ইয়াজিদের এ জয়লাভ বেশি দিন টিকে থাকেনি। মাত্র চার বছরের মধ্যে ইয়াজিদের মৃত্যু হয়। এর কয়েকদিনের মধ্যে মৃত্যু হয় তার পুত্রের। কারবালার এ মর্মান্তিক হত্যায় জড়িত প্রতিটি ব্যক্তি কয়েক বছরের মধ্যেই মুখতার সাকাফির বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। এরপর ইয়াজিদের বংশের কেউ শাসন ক্ষমতা লাভ করেনি।

লেখক: শিক্ষক,আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।