।। জমির উদ্দিন আমিনী ।।
জুলাই মাস। ক্যালেন্ডারের পাতায় এটি কেবল একটি তারিখ নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি এক জীবন্ত অধ্যায়। এটি একই সাথে এক ইতিহাস, এক কান্না এবং একটি জাতির জেগে ওঠার গল্প। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একটি প্রজন্ম তাদের বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল, কীভাবে সত্যের জন্য আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র এবং সাধারণ মানুষ অধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা রক্ষার আকাশসম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অকাতরে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিল।
২০২৪ সালের জুলাই মাস। শেখ হাসিনার ১৬ বছরের দুঃশাসন, দুর্নীতি আর দমন-পীড়নে যখন দেশের মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসছিল, তখনই সেই বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। হাটহাজারী, লালবাগ, শোলাকিয়া থেকে শুরু করে দেশের আনাচে-কানাচে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। তাদের হাতে ছিল কালেমার পতাকা, অন্তরে ছিল শহীদি তামান্না। আমি নিজে ছিলাম সেই ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী। কুমিল্লার রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখেছি, কীভাবে ছাত্ররা পুলিশের গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাবার বুলেটের সামনে তাদের প্রতিরোধের ঢাল ছিল কেবল তাদের বুক। আমি দেখেছি একেকজন শহীদ হয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু কেউই পিছু হটছেন না।
সেই জুলাই মাসের রক্তাক্ত বিকেলগুলো আজও আমার চোখে ভাসে। সেই আত্মত্যাগ, সেই সাহস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জালিমের পতন অবশ্যম্ভাবী। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম, এবার সত্যের বিজয় হবে এবং একটি মুক্ত জাতি মুক্তির স্বাদ পাবে।
ভুলের পুনরাবৃত্তি: ২০২৫ সালের জুলাই
আমরা ভেবেছিলাম ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছি। কিন্তু ২০২৫ সালের এই জুলাই মাস আবার সেই পুরোনো দুঃস্বপ্ন ফিরিয়ে এনেছে। ১৬ বছরের জালেম হাসিনা বিদায় নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমরা দেখছি আরেক গোষ্ঠী কীভাবে রক্তের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছে। ক্ষমতায় আসার আগেই তারা খুন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি আর ভয়ভীতির রাজত্ব কায়েম করেছে।
এই জুলাই মাসেই আমার এক পরিচিত, সৎ ব্যবসায়ী ভাইকে চাঁদা দিতে না চাওয়ার ‘অপরাধে’ পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়েছে। তিনি শহীদ হয়েছেন, কারণ তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। ক্ষমতা না পেয়েই যারা এমন রক্তপিপাসু হয়ে উঠেছে, তারা ক্ষমতায় গেলে কী করবে? যারা চাঁদার জন্য একজন সৎ মানুষকে হত্যা করতে পারে, তারা জনগণের শান্তি রক্ষা করবে কীভাবে?
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
ছত্রিশে জুলাইয়ের বার্তা
যারা ইতিহাস ভুলে যায়, তাদের ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিণতি হয়। যারা ভাবছে আল্লাহর জমিনে অন্যায় করে পার পেয়ে যাবে, তারা ভুল করছে। ছত্রিশে জুলাই শুধু একটি অতীত নয়, এটি আমাদের জন্য একটি সজাগ বার্তা। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়:
- জালিম পরিবর্তন হলেই জাতির মুক্তি আসে না, যদি ব্যবস্থার পরিবর্তন না হয়।
- ইতিহাস যাদের শিক্ষা দেয় না, ইতিহাসই তাদের ধ্বংস করে।
- চাঁদাবাজি, খুন, টেন্ডারবাজি দিয়ে কেউ কখনো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
- সত্য বলার কণ্ঠরোধ করলে, সেই কণ্ঠ একদিন ইতিহাসের আগ্নেয়গিরি হয়ে ফিরে আসে।
এই দেশ শহীদদের রক্তে গড়া, এই মাটি মাদ্রাসার ছাত্রদের কান্নায় ভেজা। এই পতাকা কেবল একদল দুর্নীতিবাজের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নয়। ছত্রিশে জুলাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্য কখনো চুপ থাকে না। এটি কেবল একদিনের নয়, আজীবনের এক জাগরণী বার্তা।
লেখক: শিক্ষার্থী, জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।