Home অন্যান্য খবর মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল: ৫.৫ কোটি গাছ কাটা, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে বিপর্যয়

মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল: ৫.৫ কোটি গাছ কাটা, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে বিপর্যয়

চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গড়ে ওঠা মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল—বর্তমানে জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (NSSEZ)—এর জন্য ইতিমধ্যে কাটা হয়েছে প্রায় ৫.৫ কোটি গাছ। এর মধ্যে ৮৫৩ একর উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রকল্প এলাকা থেকে ১৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি এলেও এর চরম মূল্য দিতে হচ্ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে।

এই অঞ্চলটি এক সময় গেওয়া, কেওড়া, ঝাউ, বাইন ও গরান গাছে পূর্ণ ছিল। বন বিভাগ কর্তৃক ১৯৬৭ সাল থেকে সৃষ্ট সবুজ বেষ্টনীটি ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং সর্বোচ্চ ৫ কিমি পর্যন্ত প্রশস্ত ছিল। এটি উপকূলের পাঁচ লক্ষাধিক বাসিন্দাকে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করত।

আজ তা এক ধূলিময় শিল্পাঞ্চলে পরিণত। প্রকৃতির আশ্রয় হারিয়ে প্রায় ৫ হাজার চিত্রা হরিণ, অগণিত উভচর, সরীসৃপ ও ১০০টির বেশি পাখি প্রজাতি হয়তো এলাকা ছেড়ে চলে গেছে অথবা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ খুঁটি এখন পাখির বাসা, আর গ্রামে ঢুকে পড়া বন্যপ্রাণীরা মারাও পড়ছে।

উপেক্ষিত বন আইন ও প্রাকৃতিক অধিকার

২০১৩ সালে এই বনাঞ্চলকে আইনত সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হলেও, পরের বছর সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়। ২০১৬ সাল থেকে শুরু হয় বন উচ্ছেদ। বুলডোজার চলে, রাস্তা ও শিল্প স্থাপনা গড়ে ওঠে।

তথ্য অধিকার আইনে পাওয়া নথি অনুসারে, তৎকালীন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আরএসএম মনিরুল ইসলাম এবং প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুস আলী লিখিতভাবে বারবার প্রকল্পের বিরোধিতা করেছিলেন, এবং ২০১৩ সালের সুপ্রিম কোর্টের আদেশের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন—যা সংরক্ষিত বন ভাড়ায় না দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু এইসব সতর্কতা উপেক্ষা করে প্রকল্পটি “প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ” হিসেবে বাস্তবায়ন করা হয়।

আজ পর্যন্ত ১৮,২৩৫ একর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে, বন বিভাগকে প্রতিশ্রুত ৮.৮৮ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ এখনও বকেয়া।

জীববৈচিত্র্য ও জীবিকার চূড়ান্ত বিপর্যয়

২০২২ সালে সাহেরখালীতে পণ্যবাহী ট্রাকের ধাক্কায় দুইটি চিত্রা হরিণ মারা পড়ে। বন হারানোয় হরিণ, অজগর, বানর ও অন্যান্য প্রাণী আশেপাশের গ্রামে ঢুকে পড়ছে। শিকারিরা প্রকাশ্যে হরিণ শিকার করছে, গবাদিপশুর চারণভূমি বিলীন হয়েছে।

এক সময়কার পশু পালকদের জীবিকা আজ ধ্বংসপ্রায়। এক কৃষক জানান, তার ৭০০টি ভেড়া এখন কমে দাঁড়িয়েছে ১৮০টিতে। মহিষের দুধ দিয়ে দই ও মিষ্টি বানানো প্রায় ২০০টি পরিবার এখন আয়হীন।

নতুন বাঁধের কারণে উপকূলে লবণাক্ততা ঢুকেছে। মাছ ও কাঁকড়ার ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। বড়ুয়া পাড়ার শাহাদাত হোসেন বলেন, “আগে কাঁকড়া ধরে বেঁচে থাকতাম, এখন বেশিরভাগই দিনমজুর বা শহরে চলে গেছে।”

দ্বিতীয় ধাক্কা: সন্দ্বীপ চ্যানেল থেকে বালু উত্তোলন

NSSEZ-এর প্রকল্প পরিচালক জানিয়েছেন, এক হাজার একর জমি ১০ ফুট উঁচু করতে ১০ মিলিয়ন ঘনমিটার বালুর প্রয়োজন—যা বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ চ্যানেল থেকে তোলা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি দ্বিতীয় পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনবে।

আরও পড়তে পারেন-

বন বিভাগের সতর্কতা ও প্রত্যাশা

বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন বলেন, বেজা (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ) চাইলে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ করে অঞ্চলটি তৈরি করতে পারত।

তিনি আরও জানান, ২০২৫ সালের ৮ এপ্রিল বেজাকে ৪,১০৪ একর বনভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে, যেগুলো এখনও নির্মাণাধীন নয়।

কার্বন বাজারের ক্ষতি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. কামাল হোসেনের মতে, ধ্বংসপ্রাপ্ত ম্যানগ্রোভ বন প্রতিবছর পরিবেশগত সেবা হিসেবে ৫৩.৬ মিলিয়ন ডলারের সমমূল্য প্রদান করত। শুধু কার্বন ক্রেডিট থেকেই বাংলাদেশ ১৬ মিলিয়ন ডলার আয় করতে পারত।

বেজার অবস্থান

বেজা এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, তারা মহাপরিকল্পনায় বাফার জোন ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়নের ব্যবস্থা রেখেছে এবং ১৫–২০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়, ১৪ লাখ কর্মসংস্থান, এবং জাতীয় জিডিপি ১–১.৫% বৃদ্ধির প্রত্যাশা করছে।

কিন্তু বন ধ্বংস ও জীববৈচিত্র্যের বিষয়ে তারা সরাসরি কোনো ব্যাখ্যা দিতে রাজি হয়নি।

উপসংহার

NSSEZ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও, এর প্রকৃত খরচ হয়েছে সংরক্ষিত বন, জীববৈচিত্র্য ও শত শত পরিবারের জীবিকার বিনিময়ে। আর এই বিনাশের দায় এখনো সুনির্দিষ্টভাবে কেউ নিচ্ছে না।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।