সরদার আনিছ: আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কমলেও দেশের বাজারে ঊর্ধ্বগতিতে কিছুতেই লাগাম পরানো যাচ্ছে না। অথচ চলতি বছর দেশে উৎপাদন ও মজুতে রেকর্ড গড়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দামও নিম্নমুখী। গত বছরের শেষ ভাগের তুলনায় পণ্যটির দাম কমেছে ২৬ শতাংশ, যা ২০১৭ সালের পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমোদন, নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ওএমএস এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণসহ সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়ছে না। তবে এটিকে অস্বাভাবিক বলছেন বাজারবিশ্লেষক ও ক্রেতা-বিক্রেতারা।
ট্রেডিং ইকোনমিকস বলছে, বিশ্ববাজারে চালের দাম এক মাসে কমেছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি বছরের সাত মাসে কমেছে ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। আর এক বছরে একই সময়ের তুলনায় কমেছে ১৪ দশমিক ১৬ শতাংশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ীও চলতি বছরে সব ধরনের চালের মূল্যসূচক ১৩ শতাংশ কমেছে।
সংস্থাটির মতে, সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ ভারতের রেকর্ড উৎপাদন ও রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা ধাপে ধাপে তুলে নেওয়ায় বাজারে সরবরাহ বাড়ায় কমেছে চালের দাম। এর পাশাপাশি উৎপাদন বেড়েছে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশগুলোতেও।
বিশ্ববাজারে ক্রমেই নিম্নমুখী হলেও বাংলাদেশের বাজারে চালের দাম উল্টোপথে হাঁটছে। রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর গতকাল সোমবারের বাজার দরের তথ্য অনুযায়ী গত একমাসে নতুন করে চালের দাম না বাড়লেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সরুজাতের নাজিরশাইল ও মিনিকেট ১৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ, মাঝারিজাতের পাইজাম ও আটাশ ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং মোটাজাতের স্বর্ণা ও চায়না ইরি চালের দাম ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেড়েছে।
গতকাল টিসিবির ঢাকা মহানগরীর দৈনিক খুচরা বাজার দরের তথ্য অনুযায়ী, সরু চাল ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৬০ থেকে ৭০ টাকা এবং মোটা চাল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
চলতি বছরের বোরো মৌসুমের শুরুতে চালের দাম কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা কমলেও ঈদুল আজহার পর জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ফের বাড়তে থাকে, বর্তমানে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে। জুলাই মাসেও বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে পাঁচ-ছয় টাকা বেড়েছে।
এদিকে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে অন্যান্য পণ্যের দাম কমায় মূল্যস্ফীতি কমে এলেও চালের দাম কমেনি, বাড়তি চাপ যোগ করছে মূল্যস্ফীতিতে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে কমে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির পর প্রথমবারের মতো গত জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে এবং খাদ্যে মূল্যস্ফীতি কমে ৮ শতাংশের নিচে নেমেছে। এতে সাধারণ ভোক্তারা কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও চালের দামে অস্বস্তি রয়েছে।
খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে চালের অবদান মে মাসের ৪০ শতাংশ থেকে বেড়ে জুনে ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে। জুনে সব ধরনের চালেই মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশে পৌঁছে। শুধু মাঝারি মানের চালই খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে ২৫ শতাংশ অবদান রেখেছে। আর মোটা চালের অবদান ছিল ১৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। জুলাই মাসে মাঝারি চালের দাম আরো বেড়েছে, যা বড় উদ্বেগের কারণ সংশ্লিষ্টদের।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার বাবুবাজারের ইসলাম রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী আমজাদ হোসেন বলেন, দেশের চালের বাজার এখন আর দিনাজপুর, নওগাঁ ও কুষ্টিয়ার চাতাল ব্যবসায়ীদের হাতে নেই। চালের বাজার করপোরেট হাউসগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এ কোম্পানিগুলো চালের ভরা মৌসুমেও চালের দাম বাড়ালে সরকার অজ্ঞাত কারণে নীরব ভূমিকা পালন করে।
তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো গত কোরবানি ঈদের তিন-চারদিন আগে থেকে হঠাৎ আমাদের অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দেয়। ঈদের পর বস্তায় ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে বাজারে চাল সরবরাহ করে। এটা খুবই রহস্যজনক। তিনি আরো বলেন, করপোরেট হাউসগুলোর রহস্যময় ভূমিকা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকার যতই উদ্যোগ গ্রহণ করুক না কেন, বাজার স্থিতিশীল হবে না।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন আমার দেশকে বলেন, চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও বেশির ভাগ ব্যবসায়ী চাল আমদানি করেন না। এর মানে ব্যবসায়ীদের হাতে পর্যাপ্ত চাল মজুত আছে, তা উচ্চমূল্যে বিক্রি করতেই সরবরাহে সংকট তৈরি করে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে।
তবে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ করপোরেট কোম্পানিগুলোর মালিকরা। তাদের মতে, চাল উৎপাদনে দেশ এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। ফলে সময়মতো আমদানির অনুমতি না দেওয়ায় চাহিদা বেড়ে চালের বাজারে আলাদা সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম স্বপন আমার দেশকে বলেন, করপোরেট কোম্পানিগুলোর ওপর দায় চাপানোর অভিযোগগুলো মোটেও সত্য নয়। চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য না থাকলে সংকট তৈরি হবেই। তিনি বলেন, যেখানে আরো দুই মাস আগে ব্যবসায়ীদের চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া উচিত ছিল, তা দেওয়া হয়নি। এছাড়াও বিভিন্ন কারণে ব্যবসায়ীরা চাপের মধ্যে রয়েছেন, এতে অনেকেই বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে দেশের চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে বেসরকারিভাবে পাঁচ লাখ টন সিদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির জন্য ২৪২টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিতে অনুরোধ জানিয়ে ১০ আগস্ট খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে সিদ্ধ চাল চার লাখ ৬১ হাজার টন এবং আতপ চাল ৩৯ হাজার টন। আমদানি শর্তে বলা হয়েছে, বরাদ্দ পাওয়া আমদানিকারকদের আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুরো চাল বাংলাদেশে বাজারজাত করতে হবে।
এছাড়াও ওএমএস ট্রাকসেলের মাধ্যমে নিম্নআয়ের মানুষের কাছে স্বল্পমূল্যে চাল ও আটা বিক্রি করছে খাদ্য অধিদপ্তর। আগামী ১৫ আগস্ট থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সংস্থাটি। এতে দেশের ৫৫ লাখ পরিবার ১৫ টাকা করে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল পাবে ছয় মাস ধরে। এর পাশাপাশি টিসিবির স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে সারা দেশে পণ্য বিক্রির নিয়মিত কার্যক্রম চলছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৬৫ লাখ পরিবারের কাছে স্মার্ট কার্ড সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে সক্রিয় হয়েছে ৫৪ লাখ স্মার্ট কার্ড। অর্থাৎ এ ৫৪ লাখ পরিবার বর্তমানে টিসিবির পণ্য কিনতে পারছে। টিসিবির মোট এক কোটি পরিবারের কাছে স্মার্ট কার্ড সরবরাহের কথা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংগ্রহ বিভাগ) মনিরুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, রেকর্ড পরিমাণ বোরো সংগ্রহ এবং মজুতও ভালো। বেসরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবেও চাল আমদানি করা হচ্ছে। এছাড়া ১৫ আগস্ট থেকে ওএমএস এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি শুরু হচ্ছে, যা চার মাস চলবে। এতে আশা করা যায়, চালের বাজার স্থিতিশীল থাকবে।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ