।। সাদিয়া আহমদ (আনিকা) ।।
বিবাহ শুধু দু’জন মানুষের মিলন নয়, বরং দুটি পরিবারের বন্ধন এবং একটি নতুন প্রজন্মের ভিত্তি। ইসলামে বিবাহকে একটি পবিত্র ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়, যা মানুষের অর্ধেক ঈমানকে পূর্ণ করে। এই মহিমান্বিত সম্পর্কের স্থায়িত্ব ও সফলতার জন্য ইসলামে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ‘কুফু’ বা সমতা অন্যতম। বিয়ের ক্ষেত্রে ‘কুফু’র গুরুত্ব এতটাই বেশি যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) মুসলিম উম্মাহকে এ বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: «قال رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم تَخَيَّرُوا لِنُطَفِكُمْ وَانْكِحُوا الْأَكْفَاءَ وَأَنْكِحُوا إِلَيْهِمْ» “তোমরা ভবিষ্যত বংশধরদের স্বার্থে উত্তম নারী গ্রহণ করো এবং ‘কুফু’ বিবেচনায় বিবাহ করো, আর বিবাহ দিতেও ‘কুফু’র প্রতি লক্ষ্য রাখো।” [১]
‘কুফু‘ আসলে কী?
‘কুফু’ (كُفُو) একটি আরবি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ সমান, সমতুল্য, সমতা বা সমকক্ষ। ইসলামী পরিভাষায়, বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে যাওয়া বর ও কনের মধ্যে দ্বীন-দুনিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমতা বা পারস্পরিক সামঞ্জস্যতাকে ‘কুফু’ বলা হয়। এই সমতা শুধু আর্থিক বা সামাজিক মর্যাদার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং দ্বীনদারী, পারিবারিক ঐতিহ্য, জ্ঞান এবং চারিত্রিক গুণাবলীর ক্ষেত্রেও এর প্রতিফলন ঘটে।
বিবাহে ‘কুফু‘ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
আসুন একটি বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি।
মনে করুন, ‘A’ একজন দ্বীনদার নারী এবং ‘B’ একজন সাধারণ দ্বীনদারীহীন পুরুষ। তাদের মধ্যে দ্বীনদারীর ক্ষেত্রে কোনো ‘কুফু’ নেই। এই ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও তাদের বিয়ে হলো। একজন দ্বীনদার নারী জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার দ্বীনকে প্রাধান্য দিতে চাইবেন। তিনি চাইবেন তার সংসার, সন্তান ও জীবনযাত্রা শরিয়তের পথে পরিচালিত হোক। অপরদিকে, একজন দ্বীনদারীহীন পুরুষ চাইবেন পার্থিব স্রোতে গা ভাসিয়ে চলতে। তিনি হয়তো দ্বীনের বাঁধন থেকে মুক্ত একটি জীবন কামনা করবেন। এর ফলস্বরূপ, তাদের মাঝে শুরু হবে মতের অমিল ও মানসিক দূরত্ব। একসময় এই মতপার্থক্য এতটাই চরমে পৌঁছাতে পারে যে, তাদের সম্পর্কের শেষ পরিণতি হতে পারে বিচ্ছেদ বা তালাক।
এবার আরেকটি পরিস্থিতি বিবেচনা করুন। ধরুন, আপনার মাসিক আয় সীমিত, কিন্তু আপনি এমন একজনকে বিয়ে করলেন যার পারিবারিক আর্থিক অবস্থা অনেক উন্নত ছিল। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অবস্থানে ‘কুফু’র অভাব দেখা যায়। এমন পরিস্থিতিতে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি আসা খুবই স্বাভাবিক। একটি প্রবাদ আছে, “বড়র পিরীতি বালির বাঁধ, ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণে চাঁদ।” অর্থাৎ, অসম সম্পর্কের ভালোবাসা ক্ষণস্থায়ী হতে পারে। যদি আপনার রোজগার সীমিত হয়, তবে এমন কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়া উচিত, যিনি সেই আর্থিক পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলতে পারবেন। অন্যথায়, বিবাহ পরবর্তী জীবনে আপনি শুনতে পারেন— ‘ভুল করেছি তোমায় বিয়ে করে, দাও এবার আমার হাতটি ছেড়ে।’
সুতরাং, আর্থিক, সামাজিক, এবং দ্বীনী সব দিক দিয়ে নিজেদের চলাফেরা, পোশাক, বাড়িঘর এবং জীবনযাত্রার মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পাত্র বা পাত্রী নির্বাচন করা অপরিহার্য। এতে করে কেউ কারো ওপর অহংকার বা খোঁটা দেওয়ার সুযোগ পাবে না এবং ভালোবাসার গতিও বাধাগ্রস্ত হবে না। প্রায় সব বিষয়ে ‘কুফু’ বিবেচনা করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসা উচিত, অন্যথায় ‘ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালাতে পারে’।
‘কুফু’র মূল ভিত্তি: দ্বীনদারী
যদি সবকিছুতেই ‘কুফু’ মিলে যায়, তবে তো এটি দাম্পত্য জীবনের জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়। তবে যদি অন্যান্য পার্থিব বিষয়ে সামান্য কম-বেশিও হয়, তবুও যদি স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যেই দ্বীনদারী থাকে, তবে সেটাই সুখী দাম্পত্যের জন্য যথেষ্ট। দ্বীনদার মানুষের জীবন খুবই চমৎকার, কারণ তারা জীবনের সর্বাবস্থায় সুখ-শান্তি খুঁজে নিতে পারে। আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল।
অনেকে মনে করেন, “বিয়ে করে সঙ্গীকে দ্বীনদার বানিয়ে নেব।” কিন্তু এটি স্রেফ একটি শয়তানের ধোঁকা। উল্টোটাও তো হতে পারে— দ্বীনদার বানাতে গিয়ে আপনি নিজেই দ্বীন থেকে দূরে সরে গেলেন। এমন ঝুঁকি নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, বিশেষত যেখানে এই জীবন একটি পরীক্ষাকেন্দ্র এবং এতে উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগও একটিই।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
বরং একটি কাজ করা যেতে পারে: বিবাহে দ্বীনদারীকে অবিচল রেখে (এখানে কোনো ছাড় নেই) অন্যান্য জাগতিক বিষয়গুলোতে সামান্য হেরফের হলে তা মানিয়ে নেওয়া যেতে পারে। আসলে সব কিছুই নির্ভর করে ব্যক্তিগত দ্বীনদারীর গভীরতার ওপর। যার দ্বীনদারী যত বেশি, তার কাছে পার্থিব বিষয়গুলোর গুরুত্ব তত কম।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «ليَتَّخذَ أحَدُكُمْ قَلْباً شَاكِراً وَلِسَاناً ذَاكِراً وَزَوْجَةً صَالِحَةً تُعينُهُ عَلَى أَمرِ الآخِرَة». “তোমাদের প্রত্যেকের কৃতজ্ঞ অন্তর ও যিকিরকারী জিহ্বা হওয়া উচিত। আর এমন মুমিনা স্ত্রী গ্রহণ করা উচিত, যে তার আখেরাতের কাজে সহায়তা করবে।” [৩]
আখিরাতের কাজে সহযোগিতা করার জন্য স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ‘কুফু’ থাকতে হবে। স্ত্রীকে অবশ্যই দ্বীনদারীতে স্বামীর সমান বা কাছাকাছি হতে হবে। অন্যথায়, তিনি আখিরাতের কাজে সহায়তার পরিবর্তে বাধা সৃষ্টি করতে পারেন এবং অনেক ক্ষেত্রে শরিয়ত বিরোধী কাজ করে স্বামীকে জাহান্নামের পথেও টানতে পারেন। একই কথা স্বামীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একই সাথে স্বামী পক্ষকে বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হবে, স্ত্রীর পরিবারের সামাজিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক সামর্থ্যকে। কারণ, স্ত্রী যে পরিবেশে বেড়ে ওঠেছেন, তার কাছাকাছি পরিস্থিতি যদি স্বামী বজায় রাখতে না পারেন, এতেও সংসারে সুখ-শান্তি বজায় রাখা অনেক কঠিন হয়ে ওঠতে পারে।
উপসংহার
বিয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক, যা শুধু ইহকালের নয়, পরকালেরও পাথেয়। সুখী ও সফল দাম্পত্যের জন্য ‘কুফু’র গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে দ্বীনদারী এবং সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক সামর্থ্যের ক্ষেত্রে সমতা না থাকলে সম্পর্কটি ভঙ্গুর হয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। তাই জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘কুফু’কে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া প্রতিটি মুসলিমের জন্য অপরিহার্য। আল্লাহ তা’আলা আমাদের প্রত্যেককে এমন জীবনসঙ্গী দান করুন, যারা আমাদের চোখের শীতলতা হবে এবং পরকালের পথে আমাদের সহযোগী হবে।
« رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَاماً». হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করুন, যারা হবে আমাদের চোখের শীতলতা, এবং আমাদেরকে মুত্তাকিদের জন্য আদর্শ করুন। (সূরা ফুরকান- ৭৪)।
তথ্যসূত্র: [১] সুনান ইবনু মাজাহ: ১৯৬৮; সহীহ। [২] আল-ওয়াফি ডিকশনারি। [৩] ইবনে মাজাহ: ১৮৫৬, আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ: ২১৭৬।
– সাদিয়া আহমদ (আনিকা)
লেখক ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ