Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী শ্রমনীতির বিকল্প কিছু নেই

শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী শ্রমনীতির বিকল্প কিছু নেই

।। মাওলানা জয়নুল আবেদীন ।।

মানুষ জীবন ধারণের জন্য যেসব কাজ করে, তাকে শ্রম বলে। মানুষ তার নিজের বেঁচে থাকার, পরিবারকে ভরণ-পোষণের, অপরের কল্যাণে এবং সৃষ্টি জীবির উপকারে যে কাজ করে, তা-ই শ্রম। ধনি-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, নর-নারী নির্বিশেষে সব মানুষই কোনো না কোনো কাজ করে। আর যে কোনো কাজ করতে গেলেই প্রয়োজন হয় শ্রমের।

এ হিসেবে পৃথিবীর সব মানুষকেই শ্রমিক হিসেবে অভিহিত করা যায়। অর্থনীতির পরিভাষায়, যারা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানায় কর্মকর্তার অধীনে শ্রমিক-কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন, তারাই শ্রমিক-শ্রমজীবী মানুষ। আর যারা শ্রমিকদের কাজে নিয়োগ করেন, তাদের নিকট থেকে যথাযথভাবে কাজ আদায় করেন এবং শ্রমের বিনিময়ে মজুরি বা বেতন-ভাতা প্রদান করেন, তারাই মালিক। মানুষের উন্নতির চাবিকাঠি হলো শ্রম। যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী, সে জাতি তত বেশি উন্নত। সব ধরনের শ্রমিককেই মর্যাদা দিতে হবে।

উন্নত দেশগুলোতে যেভাবে শ্রমের মর্যাদা দেয়া হয়, আমাদের দেশে সেভাবে শ্রমের মর্যাদা দেয়া হয় না। একজন দিনমজুরের শ্রম, কৃষকের শ্রম, শিক্ষকের শ্রম, অফিসারের শ্রম, ব্যবসায়ীর শ্রম সবই সমান মর্যাদার অধিকারী। শ্রমের মর্যাদা সমাজের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে। শ্রমের ব্যাপারে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে নির্দেশ দিয়েছেন, “অতঃপর যখন নামায শেষ হবে, তখন তোমরা জমিনের বুকে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (রিযিক) অন্বেষণ কর।” (সূরা: জুমা, আয়াত-১০)।

মানুষের প্রয়োজনীয় কোনো কাজই তুচ্ছ নয়। মুচি জুতা সেলাই করেন, নাপিত চুল কাটেন, দর্জি কাপড় সেলাই করেন, ধোপা কাপড় পরিষ্কার করেন, জেলে মাছ ধরেন, ফেরিওয়ালা জিনিসপত্র বিক্রি করেন, তাঁতী কাপড় বুনেন, কুমার পাতিল বানান, নৌকার মাঝি মানুষ পারাপার করেন। এসব কাজ এতই জরুরি যে, কাউকে না কাউকে অবশ্যই কাজগুলো করতে হবে। কেউ যদি এসব কাজ করতে এগিয়ে না আসতেন, তা হলে মানবজীবন অচল হয়ে পড়ত। কোনো কাজই নগণ্য নয় এবং যারা এসব কাজ করেন, তারাও হীন বা ঘৃণ্য নন।

ইসলামে শ্রমের মর্যাদা অত্যধিক। শ্রম দ্বারা অর্জিত খাদ্যকে ইসলাম সর্বোৎকৃষ্ট খাদ্য হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এবং জীবিকা অন্বেষণকে উত্তম ইবাদত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, “ফরজ ইবাদতের পর হালাল রুজি অর্জন করা একটি ফরজ ইবাদত।” (বায়হাকী)।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে এরশাদ করেছেন, “তিনি তোমাদের জন্য ভূমি সুগম করে দিয়েছেন। কাজেই তোমরা এর দিক-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তার দেয়া রিযিক থেকে আহার কর।” (সূরা: মুলক, আয়াত-১৫)।

কুরআন-হাদিস, ইসলামের ইতিহাস পড়লে জানা যায়, নবী-রাসূলগণ শ্রমিকদের কত মর্যাদা দিয়েছেন। ইসলামের সব নবী ছাগল চরিয়ে নিজে শ্রমিক হয়ে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছেন। মালিক হযরত শোয়াইব (আ.) তাঁর মেয়ের বিয়ে দিয়ে শ্রমিক নবী মূসাকে (আ.) জামাই বানিয়েছেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) শ্রমিক যায়েদ (রাঃ)-এর কাছে আপন ফুফাতো বোন জয়নবের বিয়ে দিয়েছিলেন। বিশ্বনবী (সা.) যায়েদকে (রা.) মুতার যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

ইসলামের প্রথম মোয়াজ্জিন বানানো হয়েছিল শ্রমিক হযরত বিলালকে (রা.)। মক্কা বিজয় করে কাবা ঘরে প্রথম প্রবেশের সময় মহানবী (সা.) শ্রমিক বেলাল (রা.) ও শ্রমিক খাব্বাবকে (রা.) সাথে রেখে ছিলেন। নবীজী কখনো নিজ খাদেম আনাসকে (রা.) ধমক দেননি এবং কখনো কোনো প্রকার কটুবাক্য ও কৈফিয়ত তলব করেননি।

আমাদের প্রিয় নবী (সা.) শ্রমকে ভালোবাসতেন। তিনি নিজ হাতে কাপড়ে তালি লাগিয়েছেন, মাঠে মেষ চরায়েছেন। নবীজী ব্যবসা পরিচালনাও করেছেন। খন্দকের যুদ্ধে নিজ হাতে পরিখা খনন করেছেন। আগত মুসাফির কর্তৃক বিছানায় পায়খানা করে রেখে যাওয়া কাপড় ধৌত করে মানবতা ও শ্রমের মর্যাদা সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

শ্রমিকের মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, “শ্রমজীবী আল্লাহর বন্ধু।” (বায়হাকী) মহানবী এ ব্যাপারে আরো বলেন, “নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য আর নেই। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজের হাতে কাজ করে খেতেন।” (বুখারী)।

নবী (সা.)-এর কন্যা হযরত ফাতিমা (রা.) নিজ হাতে জাঁতা ঘোরাতেন। আর এজন্য তার হাতে জাঁতা ঘোরানোর দাগ পড়েছিল। তিনি নিজেই পানির মশ্ক বয়ে আনতেন, এতে তাঁর বুকে দড়ির দাগ পড়েছিল। কোদাল চালাতে চালাতে একজন সাহাবীর হাতে কালো দাগ পড়ে যায়।

রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর হাত দেখে বললেন, “তোমার হাতের মধ্যে কি কিছু লিখে রেখেছ ? সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) এগুলো কালো দাগ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি আমার পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণের জন্য পাথুরে জমিতে কোদাল চালাতে গিয়ে হাতে এ কালো দাগগুলো পড়েছে। নবীজী (সা.) এ কথা শুনে ওই সাহাবীর হাতের মধ্যে আলতো করে গভীর মমতা ও মর্যাদার সাথে চুমু খেলেন। এভাবে অসংখ্য কর্ম ও ঘটনার মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

ইসলামী র্আদশের কাছে মনিব-গোলাম, বড়-ছোট, আমীর-গরীব সবাই সমান। ইসলামী সমাজে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সমাজপতি, শিল্পপতি, রাজনীতিবিদের আলাদাভাবে মর্যাদার একক অধিকারী হওয়ার সুযোগ নেই। অধীনস্তরা ও ইনসাফের দাবি করার অধিকার রাখে। একমাত্র ইসলামই শ্রমিকদের সর্বাধিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার কথা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে। পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম, অন্য কোনো মানব রচিত মতবাদ বা আদর্শ ইসলামের মতো শ্রমিকদের অধিকার দিতে পারে না।

ইসলামের দাবী অনুযায়ী, গোলামের সাথে ভালো আচরণ করতে হবে এবং তাদের কোনো প্রকার কষ্ট দেয়া যাবে না। রাসূল (সা.) বলেছেন, “তোমাদের অধীন ব্যক্তিরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তায়ালা যে ভাইকে তোমার অধীন করে দিয়েছেন তাকে তা-ই খেতে দাও, যা তুমি নিজে খাও, তাকে তা-ই পরিধান করতে দাও, যা তুমি নিজে পরিধান কর।” (বুখারী, আবু হুরায়রা রা.)।

হযরত আবুবকর (রাঃ) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, “ক্ষমতার বলে অধীন চাকর-চাকরানী বা দাস-দাসীর প্রতি মন্দ আচরণকারী বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (ইবনে মাজাহ) তিনি আরো বলেন, “কেউ তার অধীন ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে এক দোররা মারলেও কেয়ামতের দিন তার থেকে এর বদলা নেয়া হবে।” ইসলাম শ্রমিকদের অধীকারের প্রতি সম্মান প্রর্দশন করে। শ্রমিককে কষ্ট দেয়া জাহেলিয়াতের যুগের মানসিকতা মনে করে।

এ ব্যাপারে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন আমার দাস, আমার দাসী, না বলে। কেননা আমরা সবাই আল্লাহর দাস-দাসী।” ওমর ইবনে হুরাইস (রা.) হতে বর্ণিত নবী করিম (সা.) বলেছেন, “তোমরা তোমাদের কর্মচারীদের থেকে যতটা হালকা কাজ নিবে তোমাদের আমলনামায় ততটা পুরস্কার ও নেকী লেখা হবে। শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে তিল তিল করে গড়ে উঠে শিল্প প্রতিষ্ঠান।

একটি শিল্পের মালিক শ্রমিকদের শ্রম শোষণ করে অল্প সময়েই পাহাড় পরিমাণ অর্থ-বিত্তের মালিক হয়। শ্রমিকদের কম মজুরি দিয়ে, তাদের ঠকিয়ে গড়ে তোলে একাধিক শিল্প-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কারখানায় তাদের কোনো অংশিদারিত্ব থাকে না।

এ ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন, “মজুরকে তার কাজ হতে অংশ দান কর, কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যায় না।” (মুসনাদে আহমাদ) মাসের পর মাস চলে যায় শ্রমিকরা বেতন পায় না। বেতনের দাবিতে শ্রমিককে মালিকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হয়।

শ্রমিকের বেতন-ভাতার ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, “শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তাদের প্রাপ্য মজুরি পরিশোধ কর।” শ্রমজীবী মানুষ বা কোনো শ্রমিক অবসর নেয়ার পর তার বাকি জীবন চলার জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা বা পেনশনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।

এ ব্যাপারেও ইসলাম নীরব নয়। হযরত ওমর (রা.) বলেছেন, “যৌবনকালে যে ব্যক্তি শ্রম দিয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের খেদমত করেছেন বৃদ্ধকালে সরকার তার হাতে ভিক্ষার ঝুলি তুলে দিতে পারে না। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেটে অধিকার বঞ্চিত শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজসহ বিভিন্ন দাবিতে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করে। বিক্ষোভ সমাবেশে নিরীহ শ্রমিকদের ওপর গুলী চালায় পুলিশ। নিহত হন অনেক শ্রমিক। শ্রমজীবী মানুষের আপসহীন মনোভাব ও আত্মত্যাগের ফলে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী, ৮ ঘণ্টা কাজের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১ মে শ্রমিক আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হাদিস, শ্রমিকদের সাধ্যের অতীত কাজে কখনো খাটাবে না এ নির্দেশনামূলক কথাটির কিছু অংশ হলেও ১ মে’র আন্দোলনে প্রতিফলিত হয়। আগামী দিনে বাংলাদেশসহ বিশ্ব শ্রমিকরা নিজেদের প্রয়োজনে ইসলামের দেয়া শ্রমের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসবেন, ইনশাআল্লাহ।

লেখক: শিক্ষক- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা, কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

ইফা ডিজি’র অনিয়ম ও দুর্নীতির ফিরিস্তি