Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন জাতীয় কবির চিন্তাধারা এবং ক্ষয়িষ্ণু বর্তমান সমাজচিত্র

জাতীয় কবির চিন্তাধারা এবং ক্ষয়িষ্ণু বর্তমান সমাজচিত্র

।। মোহাম্মদ আবদুল গফুর ।।

মাত্র কয়েক দিন আগেই অতিক্রান্ত হয়ে গেছে কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মুখেই আমরা তাঁকে জাতীয় কবি বলি, বাস্তবে তাঁকে আমরা খুব কমই গুরুত্ব দেই। একথার প্রমাণ নজরুলকে না পড়েও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ. ডিগ্রী অর্জন সম্ভব।

অথচ জাতীয় জাগরণে নজরুলের কবিতা ও গানের অবদান বিবেচনায় এলে সেই ১৯২৯ সালে যখন রবীন্দ্রনাথের কবি খ্যাতির সূর্য মধ্য গগনে কলকাতা অ্যালবার্ট হলে আমাদের সেকালের নেতৃস্থানীয় হিন্দু মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসাবে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। সে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, এস ওয়াজেদ আলী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগণ। যে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে নেতাজী বলেছিলেন, আমরা যখন রাজপথে থাকব, নজরুলের গান গাইব, আবার আমরা যখন কারাগারে যাব সেখানেও আমরা নজরুলের গান গাইব।

নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি হিসাবেই সমধিক পরিচিত। কিন্তু প্রেমের কবিতা ও গানও তিনি কম লেখেননি। বিদ্রোহের পাশাপাশি প্রেমের কবিতা ও গানের সংখ্যাও তার একেবারে কম নয়। বিদ্রোহ, প্রেম, সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লেখালেখি ও অন্যান্য কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে নজরুলই বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি, যিনি বৃটিশ শাসনামলে কারাবরণ করেন। সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান গ্রহণের কারণে সেই ১৯২৯ সালে কলকাতায় নজরুলকে তৎকালীন নেতৃস্থানীয় হিন্দু-মুসলিম বুদ্ধিজীবিদের উদ্যোগে জাতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়, যে সৌভাগ্য রবীন্দ্রনাথের মতো নোবেল বিজয়ী কবির পক্ষেও সম্ভব হয়নি।

আসলে নজরুল ছিলেন স্বাধীনতার তুর্যবাদক কবি এবং সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যে কোনো ভূমিকা পালনে তিনি ছিলেন সদা প্রস্তুত। যেখানে ‘কালান্তর’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের ‘মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা’র কারণে তাদেরকে সংশোধনের অযোগ্য ভেবেছেন, সেখানে নজরুল সাম্রাজ্যবাদী শাসনের কবল থেকে মুক্তির জন্য হিন্দু-মুসলিম মিলনের আহ্বান জানিয়েছেন।

হিন্দু-মুসলমান মিলন প্রশ্নে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যক শরৎ চন্দ্র একদা বলেছিলেন- মিলন হয় সমানে সমানে। হিন্দুর তুলনায় মুসলমান এত পিছিয়ে যে, হিন্দু-মুসলিম মিলন একটা অসম্ভব ব্যাপার। কবি রবীন্দ্রনাথও হিন্দু মুসলিম মিলন কখনো প্রশ্নে আশাবাদী ছিলেন না। কারণ, তিনি মুসলমানদেরকে মধ্যযুগীয় চিন্তাধারায় আচ্ছান্ন পিছিয়ে পড়া এক জাতি বলে মনে করতেন। হিন্দু কবি-সাহিত্যিকদের মুসলমানদের প্রতি এ ধরনের বিরূপ মনোভাব থাকা সত্ত্বেও কবি নজরুল শুধু হিন্দু মুসলিম মিলন সম্ভব বলেই মনে করতেন না, দেশের স্বাধীনতা ও সামাজিক সম্প্রীতিময় সহাবস্থানের স্বার্থে হিন্দু-মুসলিম মিলনকে অপরিহার্য মনে করতেন।

হিন্দু-মুসলিম মিলনকে দেশের স্বাধীনতা ও সামাজিক সম্প্রীতিময় সহাবস্থানের স্বার্থে অপরিহার্য মনে করলেও পিছিয়ে-পড়া স্বজাতি মুসলমানদের এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে তাদেরকে জাগিয়ে তোলার জন্য তিনি লিখে গেছেন অসংখ্য কবিতা ও গান।

পিছিয়ে-পড়া মুসলমানদের আত্মবিশ্বাস ভরে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়ে তিনি লিখেছেন-
যাত্রীরা রাত্তিরে হতে এলো খেয়া পার,
বজ্রেরি তুর্যে এ গর্জেছে কে আবার?
প্রলয়েরি আহ্বান ধনিল কে বিষাণে
ঝঞ্জা ও ঘন দেয়া স্বনিল রে ঈষাণে

মুসলমানদের নির্ভয়ে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়ে নজরুল লিখেছেন-
লঙ্ঘি এ সিন্ধুরে প্রলয়ের নৃত্যে
ওগো কার তরী ধায় নির্ভীক চিত্তে?
অবহেলি জলধির ভৈরব গর্জন
প্রলয়ের ডঙ্কার ওঙ্কার তর্জন
পূণ্য পথের এ যে যাত্রীরা নিষ্পাপ
ধর্মেরি বর্মে সু-রক্ষিত দিল-সাফ
নহে এরা শঙ্কিত বজ্র নিপাতেও;
কান্ডারী আহমদ, তরী-ভরা পাথেয়!

এরপরই কবি মুসলমানদের শক্তির প্রধান উৎসের সন্ধান দিয়ে বলেছেন-
আবু বকর উসমান উমর আলী হায়দার
দাঁড়ী যে এ তরীর, নাই ওরে নাই ডর।
কান্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা।
দাঁড়ী মুখে সারি গান- লা শরীক আল্লাহ।

ইসলামের সোনালি অতীতের কথা মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে এরপর বর্তমান বিশ্বের পিছিয়ে-পড়া মুসলমানদের নতুন করে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়ে কবি বলেছেন-
বাজিছে দামামা, বাঁধরে আমামা
শির উঁচু করি মুসলমান।
দাওয়াত এসেছে নয়া জামানার
ভাঙ্গা কেল্লায় ওড়ে নিশান
মুখেতে কলেমা হাতে তলোয়ার
বুকে ইসলামী জোশ দুর্বার,
হৃদয়ে লইয়া এশক আল্লাহর
চল আগে চল জাগে বিষাণ!
ভয় নাই তোর গলায় তাবিজ
বাঁধা যে রে তোর পাক কোরআন

এরপরই কবি বর্তমান মুসলিম সমাজে ভোগ-বিলাসের কুপ্রভাব সম্বন্ধে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন-
নহি মোরা জীব ভোগ-বিলাসের
শাহাদাত ছিল কাম্য মোদের
ভিখারির সাজে খলীফা যাদের
শাসন করিল আধা জাহান-
তারা আজ পড়ে ঘুমায় বেহুঁশ
বাহিরে বহিছে ঝড়-তুফান

কবি আজকের মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার কারণ যে তাদের নিজেদের কর্তব্য-সচেতনতার অভাব, তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন-
ঘুমাইয়া কাজা করেছি ফজর,
তখনো জাগিনি যখন যোহর,
হেলা ও খেলায় কেটেছে আসর,
মাগরিবের আজ শুনি আজান।
জামাতে শামিল হওরে এশাতে
এখনো জমাতে আছে স্থান

এরপর মুসলমানরা অতীতে কীভাবে বিশ্ব জয় করেছিল, সেই মহান অতীতের কথা তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে কবি বলেছেন-
শুকনো রুটিকে সম্বল করে
যে ঈমান আর যে প্রাণের জোরে
ফিরেছে জগত মন্থন করে
সে শক্তি আজ ফিরিয়ে আন।
আল্লাহ আকবর রবে পুনঃ
কাঁপুক বিশ্ব দূর বিমান

কবি মুসলমানদের আজকের ঘোর দুর্দিনে তরুণদের এগিয়ে এসে জাতির নেতৃত্ব গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন-
যে দুর্দিনের নেমেছে বাদল তাহারি বজ্র শিরে ধরি
ঝড়ের বন্ধু আঁধার নিশিতে ভাসায়েছি মোরা ভাঙ্গা তরী
যখন জালিম ফেরাউন চাহে মূসা ও সত্যে মারিতে ভাই
নীল দরিয়ার মোরা তরঙ্গ বন্যা আনিয়া তারে ডুবাই
আজো নমরুদ ইবরাহীমেরে মারিতে চাহিছে সর্বদাই
আনন্দ দূত মোরা সে আগুনে ফোটাই পুষ্প-মঞ্জুরি
ভরসার গান শুনাই আমরা ভয়ের ভূতের এই দেশে।
জরা-জীর্ণেরে যৌবন দিয়া সাজাই নবীন-বর-বেশে ।

মানুষের মুক্তির পথে যতরকম বাধা সৃষ্টি করা হয় কবি তাকে কারাগারের সাথে তুলনা করে সেই কারাগারকে ভেঙ্গে ফেলার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন-
কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল কররে লোপাট
রক্ত-জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান।
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ
ধ্বংস নিশান
উড়–ক প্রাচীর প্রাচীর বেদি।

ইসলামের মহানবী যে সাম্য-ভ্রাতৃত্বের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য এসেছিলেন তা মুসলমানরা ভুলে গিয়েছে বলে তাদের দুর্দশার অন্ত নেই। তাই কবি প্রিয় নবীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সে আদর্শ পুনরায় ফিরে পেতে-
পাঠাও বেহেশত হতে হজরত পুনঃ সাম্যের বাণী,
(আর) দেখিতে পারি না মানুষের এই হীন হানাহানি।
বলিয়া পাঠাও হে হজরত
যাহারা তোমার প্রিয় উম্মত,

সকল মানুষে যেন বাসে তারা ভালো। তোমার সৃষ্টি জানি।
সবারে খোদারই সৃষ্টি জানি
অর্ধেক পৃথিবী আনিল ঈমান যে উদারতা-গুণে
(তোমার) যে উদারতা গুণে
শিখিনি আমরা সে উদারতা, কেবলি গেলাম শুনে,
কোরানে হাদিসে কেবলি গেলাম শুনে

কবি ইসলামের সাম্যভ্রাতৃত্বের সে আদর্শ দুনিয়ার পুনরায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যের যে আহ্বান জানিয়েছেন তাহলো-
হাতে হাত দিয়ে চলো
হাতে নাই থাক হাতিয়ার
জমায়েত হও, আপনি আসিবে
শক্তি জুলফিকার
আনো আলীর শৌর্য, হোসেনের ত্যাগ
ওমরের মতো কর্মানুরাগ
খালেদের মতো সব অসাম্য
ভেঙ্গে কর একাকার,
ইসলামে নাই ছোট বড় আর
আশরাফ আতরাফ।
এই ভেদ জ্ঞান নিষ্ঠুর হাতে
কর মিসমার সাফ
চাকর সৃজিতে, চাকুরি করিতে
ইসলাম আসে নাই পৃথিবীতে।
মরিবে কেহ ক্ষুধায় কেহ নিরন্ন,
কারো ঘরে রবে অঢেল অন্ন
এ জুলুম সহেনিকো ইসলাম
সহিবে না আজও আর

সর্বশেষ মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর: জীবন ও সাহিত্য