Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ শিক্ষার সর্বস্তরে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা জরুরী

শিক্ষার সর্বস্তরে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা জরুরী

।। মাওলানা জয়নুল আবেদীন ।।

নৈতিকতা বলতে আমরা বুঝি নীতির অনুশীলন, নীতির চর্চা। নৈতিকতার ইংরেজি শব্দ Morality যার উৎপত্তি হয়েছে ল্যাটিন শব্দ Moralitas থেকে। Moralitas অর্থ হলো- ধরন, ভালো আচরণ, চরিত্র প্রভৃতি। কাজেই নৈতিকতা হলো এমন এক বিধান যার আলোকে মানুষ তার বিবেকবোধ ও ন্যায়বোধ ধারণ ও প্রয়োগ করতে পারে। সততা, সদাচার সৌজন্যমূলক আচরণ সুন্দর স্বভাব মিষ্টি কথা ও উন্নত চরিত্র এ সবকিছুর সমন্বয় হলো নৈতিকতা।

একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাল-চলন, ওঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া, আচার-ব্যবহার, লেন-দেন সবকিছুই যখন প্রশংসনীয় ও গ্রহণযোগ্য হয় তখন তাকে নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তি বলে। তাই নৈতিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে রাসুলুল্লাহ (স:) সর্বোত্তম ব্যক্তি বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন ‘‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যার চরিত্র উত্তম” (বুখারী ও মুসলিম)।

রাসুল (সঃ) আরো বলেন- মুমিনের পরিমাপদণ্ডে কিয়ামতের দিন উত্তম নৈতিক চরিত্র অপেক্ষা অধিক ভারী জিনিস আর কিছু নয়।” (তিরমিযী) নৈতিকতা হলো ব্যক্তির মৌলিক মানবীয় গুণ এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। যা অর্জন করলে তার জীবন সুন্দর ও উন্নত হয়। আর এর মাধ্যমে সে অর্জন করে সম্মান ও মর্যাদা। ইসলামি শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- মানুষকে নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া। নীতিহীন মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-তাদের হৃদয় আছে উপলব্ধি করে না, চোখ আছে দেখে না, কান আছে শুনে না। এরা হলো চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়। বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট । আর এরাই হলো গাফিল। (সূরা আরাফ, আয়াত-১৭৯)।

বস্তুত নৈতিকতা হলো মানুষের সবচেয়ে উন্নত গুণ ও বৈশিষ্ট্য। Cambridge International Dictionary of English অনুসারে নৈতিকতা হলো একটি গুণ, যা ভালো আচরণ বা মন্দ আচরণ, স্বচ্ছতা, সততা ইত্যাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত। একে সবাই আইন বা অন্য কোন বিষয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। নৈতিকতার সংকট এবং অবক্ষয়: অবক্ষয় শব্দের অর্থ ‘ক্ষয়প্রাপ্তি’। নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্য, নিষ্ঠা, ধর্ম, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ ,পারস্পরিক মমত্ববোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণ লোপ পাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলে সামাজিক অবক্ষয়।

এটি হলো সামাজিক মূল্যবোধের বিপরীত স্রোতধারা। নৈতিকতা ও আদর্শিক শিক্ষার অভাবই সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ। মানুষ যখন নৈতিকতা ভুলে যায় তখন সে সেচ্ছাচারী হয়ে পড়ে মানুষ নামক প্রভুদের খুশি করতে ও তার স্বার্থকে রক্ষা করতে নানা অন্যায়ের জালে জড়িয়ে যায়।তুলনামুলক দুর্বলদেরকে বঞ্চিত করে সবলদের মনতুষ্ঠির জন্য অধিকার বহির্ভুত সুবিধা পদান করে।

সাম্প্রতিক বছর গুলোতে সামাজিক অবক্ষয়জনিত কারণে সৃষ্ট ও বিস্তৃত সামাজিক অপরাধ বেড়েছে বহু গুণ। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকসহ সকলক্ষেত্রে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে অশনিসংকেত।

নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে মানুষের হৃদয়বৃত্তিতে ঘটছে অনাক্সিক্ষত পরিবর্তন। পরিণতিতে সমাজ ও পরিবারে বেজে উঠছে ভাঙনের সুর। নষ্ট হচ্ছে পবিত্র সম্পর্ক গুলো। চাওয়া পাওয়ার ব্যবধান হয়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। ফলে বেড়ে চলছে আত্মহত্যা, হত্যাসহ অন্যান্য অপরাধ প্রবণতা। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সম্পর্কের এমন নির্ভেজাল জায়গাগুলোতে ফাটল ধরেছে। ঢুকে পড়েছে অবিশ্বাস। আর এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর প্রেমময় সম্পর্কে সৃষ্টি হচ্ছে আস্থার সংকট। ক্ষেত্রবিশেষ বলি হচ্ছে নাড়ি ছেঁড়া বুকের ধন জানের চেয়েও প্রিয় সন্তান-সন্ততি। ফলে সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সুখ-শান্তি।

যদিও পরিবারকে মানবজাতির প্রাথমিক শিক্ষালয় বলা হতো, কিন্তু সে অবস্থানে এখন আর পরিবারগুলো নেই। উপর্যুক্ত জীবন দর্শনের অভাবে পরিবারগুলো এখন ভোগ-বিলাস, অর্থনৈতিক অতি উচ্চাকাক্সক্ষা, পরশ্রীকাতরতার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতার প্রতিযোগিতায় জন্ম নিচ্ছে গা শিউরে ওঠার মতো ঘটনা। ধনবাদী ধ্যান-ধারণায় গড়ে উঠেছে ভারসাম্যহীন সমাজ। অবক্ষয়ী এ সমাজব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে দেশের ভবিষ্যত যুবসমাজ।

নৈতিকতাহীন শিক্ষায় তারা দূরে সরে যাচ্ছে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া থেকে। আর হয়ে যাচ্ছে বখাটে, মাদকাসক্ত, ধর্ষক, ইভটিজার, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, সুদখোর ও ঘুষখোর। এতে সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ন্যায়নীতি ও ন্যায়বিচার। স্যাটেলাইটের সুবাদে উন্মুক্ত অপসংস্কৃতির দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে চিরায়ত দেশীয় সংস্কৃতি।

মোবাইলে ইন্টারনেট চালানো সহজ হওয়ায়ও যুবসমাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এমনকি শিশুরাও ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার কল্যাণের নামে অকল্যাণে বয়ে আনছে। ফলে নৈতিক শিক্ষার অভাবে জাতি আজ এক সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের কবলে পড়ছে। সমাধানের উপায়: দেশে ভয়াবহ ব্যাধির মত দানা বাঁধছে নৈতিক ও সামজিক অবক্ষয়। সমাজ বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এখন থেকে এর লাগাম টেনে ধরতে না পারলে আগামী বছরগুলোতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভয়াবহ রূপ নেবে সামাজিক অবক্ষয়।

প্রতিদিন একটু একটু করে অবক্ষয়ের অতল অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে দেশ। এটা রোধ করতে হলে সবার আগে যেটা করতে হবে তা হল- ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা সর্বক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক অন্তর্ভুক্ত করা। এটা সময়ের অন্যতম জোরালো দাবি হয়ে উঠছে। শিক্ষার সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার না ঘটালে মহামারির মতো রূপ নেওয়া এই অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব হবে না।

লেখক: শিক্ষক- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা এবং কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী শ্রমনীতির বিকল্প কিছু নেই