Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ শিশুদের সুরক্ষায় আমাদের দায়িত্ববান ও মানবিক হতে হবে

শিশুদের সুরক্ষায় আমাদের দায়িত্ববান ও মানবিক হতে হবে

।। কামরুল হাসান দর্পণ ।।

এ কথা এখন বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের মায়া, মমতা, স্নেহ ভালবাসার মতো মানবিক গুণগুলো নিষ্ঠুরতা, হৃদয়হীনতার আড়ালে চলে গেছে। যে কোনো নিষ্ঠুর ও নির্মম ঘটনা দ্বারা কিছু সময় ব্যথিত এবং এ নিয়ে হইচই করলেও স্বল্পতম সময়ে তা ভুলে যাই। মায়া-মমতাকে প্রচ্ছন্নভাবেই কাঠিন্য বা সয়ে যাওয়ার অনুভূতি ঢেকে দেয়। তবে যে নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটে, তা যাতে আর না ঘটে, এ নিয়ে নিজেরাও সচেতন হই না, অন্যকেও সচেতন হতে বলি না।

বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, ঘটনার সাথে সম্পৃক্তরা ধরা পড়লেও এবং তাদের কারো কারো বিচার হলেও ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ হচ্ছে না। এ থেকে বিরত থাকার শিক্ষা নেয়া হচ্ছে না। বরং দেখা যায়, যে পৈশাচিক, হিংস্র ও অভিনব কায়দায় একজনকে খুন করা হয়, তা থেকে কেউ কেউ উৎসাহিত হয়ে অন্যকেও খুন করে।

কয়েক বছর আগে খুলনার এক ছোট্ট শিশু রাকিবকে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে যেভাবে হত্যা করা হয়, তার কিছুদিন পর একইভাবে নারায়ণগঞ্জেও এক শিশুকে হত্যা করা হয়। আবার আশুলিয়ায় বাসে এক তরুণীকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার ঘটনার কিছুদিন পর আরেক তরুণীকেও একইভাবে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলা হয়। অর্থাৎ একেকটি পৈশাচিক ঘটনা যেন কারো কারো জন্য উৎসাহের কারণ হয়ে উঠে।

এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, নৃশংস ও অমানবিক ঘটনাগুলো অনেকের মনে দাগ কাটে না কিংবা সচেতনতা সৃষ্টি করছে না। এর পরিবর্তে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানো হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা, বিচারহীনতার অপসংস্কৃতিকে দায়ী করে থাকেন। হ্যাঁ, আমাদের দেশে বিচারহীনতার এক ধরনের অপসংস্কৃতি রয়েছে। দেখা যায়, যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অপকর্ম বা নিষ্ঠুরতম ঘটনা ঘটিয়ে থাকে, তারা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির মাধ্যমে কোনো না কোনোভাবে পার পেয়ে যায়। এ থেকেই মূলত বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির কথাটি প্রচলিত হয়েছে।

তবে আমাদের দেশের মানুষের যে চিরায়ত বৈশিষ্ট্য তা হচ্ছে, একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসা। মায়া, মমতা নিয়ে বিপন্নর পাশে দাঁড়ানো। কিংবা কেউ অপরাধ প্রবণ হলে বা খারাপ কাজ করলে তাকে সচেতন করা। এখন চিরায়ত মানবিক গুণাবলীর এই ঐতিহ্য আমাদের মধ্য থেকে যেন হারিয়ে গেছে। প্রত্যেকেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছি। কারো বিপদ দেখলে পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে নিজে বিপদে বা ঝামেলায় পড়ার আশঙ্কায় দূরে দাঁড়িয়ে থাকি। এর কারণ যে আমাদের মানবিক মূল্যবোধের জোর কমে যাওয়া এবং বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি ও আইনের শাসনের ঘাটতি, তাতে সন্দেহ নেই। যুগে যুগে যে এই দুই কারণের ঘাটতি ছিল না, তা নয়। তখন এ ঘাটতি মিটিয়ে দিত মানবিক মূল্যবোধ।

এখন আমাদের মধ্যে এই মূল্যবোধের ঘাটতিই চরম আকার ধারণ করেছে। এটা কি ভাবা যায়, একজন পিতা তার প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য নিজ শিশুপুত্রকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করতে পারে! কিংবা নবজাতককে রাস্তায় বা ডাস্টবিনে ফেলে যেতে পারে! আবার কাম চরিতার্থ করার জন্য শিশুদের ধর্ষণও হত্যা করতে পারে! এখন এসব ঘটনা অহরহ ঘটছে। একটি দুটি নয়, হাজার হাজার ঘটনা ঘটছে। যদি এমন হতো, দুই, চার, পাঁচ বছরে একটি ঘটনা ঘটেছে, তাহলে এ ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ বলে সান্ত¦না পাওয়া যেত। যখন প্রায় প্রতিনিয়ত এ ধরনের ঘটনা ঘটে তখন কি আর একে ‘বিচ্ছিন্ন’ বলা যায়? যায় না। তার অর্থ হচ্ছে, আমাদের মধ্য থেকে মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালবাসা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা এক অমানবিক সমাজের অধিবাসী হয়ে উঠছি।

[ দুই ]

যে শিশুকে দেখলে মনের ভেতর স্নেহ, মায়া, মমতা জেগে উঠে, মনের অজান্তেই তার দিকে আদরের হাত বাড়িয়ে দেয়া হয়, সেই শিশুদেরই কিনা অসংখ্য মানুষ অবলীলায় খুন করছে। একটি পরিসংখ্যান দেয়া যাক। গত পাঁচ বছরে সারাদেশে আপনজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিপক্ষসহ অন্যদের হাতে খুন হয়েছে ১৭ হাজারের বেশি মানুষ। এর মধ্যে শিশু রয়েছে ১,৬৩৪টি। আর এ বছরের ৯ মাসে শিশু খুন হয়েছে ৩২০টি।

৯ মাসের হিসেবে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়ে একটির বেশি শিশু খুন হয়েছে। খুনই একটি নৃশংসতম ঘটনা, তার ওপর যদি ফুলের মতো শিশুকে খুন করা হয়, তখন তা কি তা কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যায়, কিংবা প্রাণে সয়? আমরা তো এমন জাতি যে, চেনা হোক বা না হোক, শিশু মানেই নিজের সন্তানের মতো ভালবাসি। শিশুর অনাবিল হাসি প্রাণ ছুঁয়ে যায়। দুঃখের বিষয়, আমাদের মধ্যে অসংখ্য মানুষ যখন অবলীলায় শিশু হত্যা করে, তখন আর ‘নিজের সন্তান’ ভাবার চিরায়ত মানবিক বিষয়টি তাদের মনে আসে না। অথচ আপনার, আমার সন্তানরাই আমাদের বা দেশের ভবিষ্যত টিকিয়ে রাখার ভিত্তিমূল। তাদের আদর-যত্নে মানুষ করে গড়ে তোলা হয় শুধু নিজের কল্যাণের জন্য নয়, অপরের কল্যাণেরও জন্য। সর্বোপরি আমাদের রক্তপ্রবাহ বা মানবজাতিকে এগিয়ে নেয়ার বীজ তো আমাদের সন্তানরা।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার ‘ছাড়পত্র’ কবিতায় লিখেছেন, ‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান; জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ পিঠে, চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ শিশুর প্রতি এমন মায়া-মমতা মিশ্রিত এবং তাদের প্রতি পৃথিবীর নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে শুধু সুকান্তই নন, অনেক কবিই এমন আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের এই পদ্য রচনা না করলেও যে শিশুর প্রতি মানুষের স্নেহ ও ভালবাসা এবং দায়িত্বের কোনো কমতি থাকত, তা মনে করার কারণ নেই। শিশুদের ভালবাসে না, এমন মমতাহীন মানুষ খুব কমই রয়েছে।

তারপরও কবি-সাহিত্যিকরা তাদের লেখায় বারবার শিশু অধিকার ও তাদের প্রতি কী দায়িত্ব পালন করতে হবে, তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। গত কয়েক বছরে দেশে যেভাবে শিশু হত্যা ও নির্যাতন বেড়েছে তাতে মনে হচ্ছে, শিশুদের প্রতি যতœবান হওয়ার জন্য কবি-সাহিত্যিকদের এ আহ্বান চিরঞ্জীব। সাধারণত কবি ও সাহিত্যিকদের অনেকটা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হতে হয়। আজ থেকে একশ’ বছর পর কী হবে বা হতে পারে, তা বর্তমানের উপর দাঁড়িয়ে দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখতে হয়। তাদের এসব লেখাই মানুষকে তার প্রজন্মকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করে। বলা বাহুল্য, মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়াই হচ্ছে, শিশুর জন্ম। শিশুর জন্ম না হওয়া মানে মানবসভ্যতা থেমে যাওয়া।

অথচ এই সভ্যতার ধারাবাহিকতা থামিয়ে দেয়ার জন্য যেন একশ্রেণীর মানুষ উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। নিবন্ধে উল্লেখিত পরিসংখ্যানই তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, নরপশুরূপী কিছু মানুষ মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রার ধারক-বাহক এবং দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে যেন রুখে দিতে চাইছে। এই পশুসদৃশ মানুষকে কোনোভাবেই নিবৃত করা যাচ্ছে না। মাংশাসী পশু যেমন তার চেয়ে দুর্বল প্রজাতিকে আহার হিসেবে শিকার করে, ঠিক তেমনি কিছু নরপশু সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণীর উপর তাদের জিঘাংসা চরিতার্থ করে চলেছে। ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুকে পিঁষে মেরে ফেলছে। ঘাতকরা সমাজের রীতি-নীতি-নৈতিকতা এবং মানবিকতাকে যে পদদলিত করে চলেছে, এ নিয়ে সামাজিক প্রতিরোধ এবং সচেতনতা বা দায়িত্ববোধ যেন আমাদের মধ্যে কাজ করছে না। আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছি, চিলের মতো ছোঁ মেরে মায়ের কোল থেকে শিশুদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

[ তিন ]

শিশু নির্যাতন ও খুন-ধর্ষণের ভয়াবহ চিত্রের পাশাপাশি বাবা-মা কর্তৃক সন্তানের উদাসীনতার আরেকটি চিত্রও বেশ উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল ফোন, টেলিভিশনের আসক্তির কারণে শিশুরা দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে। সময়ের আগেই তাদের চোখে মাইনাস পাওয়ারের চশমা উঠছে। দীর্ঘ সময় চোখের সামনে রেখে শিশুদের কম্পিউটার, ট্যাব বা মোবাইলে গেমস খেলার কারণে তাদের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাচ্ছে।

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হাসপাতালটিতে মাসে কয়েক হাজার শিশু আসে। এদের ৭০ শতাংশ দূরের জিনিস দেখতে পায় না। এর অধিকাংশ কারণ শিশুদের কম্পিউটার, ট্যাব ও মোবাইলে দীর্ঘ সময় ধরে একদৃষ্টিতে গেমস খেলা। চক্ষু বিষেশজ্ঞরা একে অত্যন্ত ‘অ্যালার্মিং’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এমন ধারণা পোষণ অমূলক হবে না, অভিভাবকরা যেন জেনেবুঝে একটি ক্ষীণদৃষ্টি সম্পন্ন ও অন্ধ প্রজন্ম সৃষ্টি করে চলেছে।

শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ এবং সুস্থ্য ও শক্তিশালী প্রজন্ম গড়ে তোলার বিষয়টি উপেক্ষা করে চলেছে। একদিকে দুর্বৃত্ত কর্তৃক শিশুদের নির্যাতন, অন্যদিকে অভিভাবকদের অসচেতনতা-এই উভয় সংকটে পড়ে দেশের ভবিষ্যত শিশু শ্রেণী এক চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, শিশুদের দিকে অভিভাবকসহ সমাজের সচেতন শ্রেণীর তেমন কোনো নজর নেই। এক ধরনের অবহেলা ও উদাসীনতা তাদের মধ্যে কাজ করছে। এই ভবিষ্যত প্রজন্মের যে সঠিক যত্ন নেয়া ও গড়ে তোলা প্রয়োজন, এ বোধ যথাযথভাবে কাজ করছে না। যদি সচেতন হতো, তাহলে শিশুদের প্রতি নির্মম আচরণ হতো না।

শিশু নির্যাতনের পরিসংখ্যানও এতো ভয়াবহ হতো না। বলাবাহুল্য, বাইরের দুর্বৃত্ত শ্রেণীর নিষ্ঠুরতা থেকে অভিভাবকরা যেমন তার সন্তানকে রক্ষা করতে পারছেন না, তেমনি ঘরের ভেতরও তাদের ক্ষতি হয় এমন কাজ থেকে বিরত রাখতে পারছেন না। তবে এ কথা মানতেই হবে, অভিভাবকদের এমন আচরণের অন্যতম কারণ নিরাপত্তা। সন্তানকে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে যে তারা নিরাপদবোধ করবেন, এ নিশ্চয়তা তারা পাচ্ছেন না। খেলাধুলার জন্য ঘরের বাইরে পাঠানোর মতো নিরাপত্তা এখন নেই বললেই চলে। এর উপর পর্যাপ্ত মাঠ এবং উন্মুক্ত জায়গারও প্রচ- অভাব রয়েছে।

বিনোদনের জন্য সন্তানদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে সন্তানদের অনেকটা ঘরবন্দি করে রাখতে হচ্ছে। তাদের হাতে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল তুলে দিতে হচ্ছে। এভাবেই শিশুদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বীজ বপিত হচ্ছে। একনাগাড়ে গেমস খেলতে গিয়ে দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে, আবার কোনো ধরনের নড়াচড়া না করায় শারীরিক সক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শহরের শিশুদের শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ স্থূল হয়ে পড়ছে।

এর মূল কারণ তাদের খেলাধুলার সুযোগ না থাকা। স্থ’ূলাকৃতি হওয়ার এই প্রবণতায় শিশুরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে শহরের কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব ও মোবাইলের মাধ্যমে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি হ্রাসের সমস্যা। চিকিৎসকরা এই সমস্যাকে ‘কম্পিউটার ভিশন সিনড্রম’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। যদি খেলাধুলার যথেষ্ট সুযোগ ও নিরাপত্তা থাকত তবে তাদের জন্য ক্ষতিকর কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব ও মোবাইল থেকে অনেকখানি দূরে রাখা সম্ভব হতো। দুঃখের বিষয়, আমরা কেবল নিরাপত্তাহীনতা ও শিশুর ক্ষতিকর দিকটি অবলোকন করছি, এ থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় ও উদ্যোগ নিচ্ছি না।

এটাও লক্ষ্যণীয়, অভিভাবকের তার সন্তানকে যে পরিমাণ সময় দেয়া প্রয়োজন, তা তারা দিচ্ছেন না। অনেকে সময় দিতে পারলেও সন্তানকে বড় করার যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করেন না। অনেকে আবার প্রযুক্তিকে আভিজাত্যের লক্ষণ মনে করেন। তারা টেলিভিশন ছেড়ে বা সন্তানের হাতে ট্যাব, মোবাইলে গেমস খেলতে দিয়ে খাওয়ান। এটাও দেখা যায়, পড়াশোনায় সন্তানকে প্রথম করার প্রতিযোগিতায় অভিভাবকরা লিপ্ত হয়ে সন্তানের উপর বাড়তি চাপ প্রয়োগ করেন।

অভিভাবক বিশেষ করে মায়েদের এ ধরনের আচরণকে ‘টাইগার মাম অ্যাটিচ্যুড’ বলা হয়। এই আচরণের কারণে সন্তানের মানসিক ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এসবই যে সন্তানের স্বাস্থ্য ও সুষমভাবে বেড়ে উঠার অন্তরায়, তা বিশ্লেষকরা একমত প্রকাশ করেছেন। এ কথাও অস্বীকারের উপায় নেই, পাড়া-মহল্লায় শিশুদের খেলাধুলা করার মতো যথেষ্ট সুযোগ নেই। তারা যে ছুটির দিনে বা বিকেলে দল বেঁধে মাঠে খেলতে যাবে, এ ধরনের মাঠ ও খোলা জায়গা অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়েছে। মাঠ-ময়দানে বাড়ি-ঘর তুলে একদিকে খেলাধুলার সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে দৃষ্টিকে সীমিত করে ফেলা হয়েছে।ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ‘একটি বাসযোগ্য পৃথিবী’ রেখে যাব বলে সুকান্ত যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন, তা না করে দেখা যাচ্ছে, ‘বাঁশডলা’ দিয়ে শিশুদের ধ্বংসের প্রক্রিয়া চলছে। তাদের ঘরবন্দি করে রাখা হচ্ছে এবং শারিরীক ও মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলা হচ্ছে।

ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ‘একটি বাসযোগ্য পৃথিবী’ রেখে যাব বলে সুকান্ত যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন, তা না করে দেখা যাচ্ছে, ‘বাঁশডলা’ দিয়ে শিশুদের ধ্বংসের প্রক্রিয়া চলছে। তাদের ঘরবন্দি করে রাখা হচ্ছে এবং শারিরীক ও মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলা হচ্ছে।

[ চার ]

শিশু নির্যাতন ও হত্যার বিষয়টি আমরা কতজন নিজের সন্তানের দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করি, এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। শিশু নির্যাতন বা হত্যার বিষয়টিকে কেউ বড় করেও দেখছে না। শিশুরা ছোট বলে চোখে পড়ছে না, বা শিশু হত্যা করলে তেমন কোনো ক্ষতি নেই-এমন মানসিকতা প্রতীয়মাণ হচ্ছে। এ ধরনের সিডেটিভ মাইন্ড বা অবশ হয়ে পড়া মানসিকতা খুব বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। যে আরেক জনের সন্তানকে নির্যাতন ও হত্যা করার সময় নিজের সন্তানে বা ছোট ভাই-বোনের কথা একবারের জন্যও মনে করে না, তার মতো নরাধম আর কে হতে পারে! এ ধরনের মানবিক গুণাবলী শূন্য নরপশুদের ধরে যদি দ্রুত শাস্তি এবং একের পর এক শাস্তি দেয়ার নজির সৃষ্টি করা না যায়, তবে শিশু নির্যাতন ও হত্যা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না।

এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সর্বাধিক। কারণ শিশুরাই একদিন রাষ্ট্রের হাল ধরবে। তাদের সুরক্ষা দেয়া এবং ব্যবস্থা করা তারই দায়িত্ব। তবে এক্ষেত্রে সমাজ ও পরিবারের অভিভাবকদের রাষ্ট্রের আগে দায়িত্বশীল হতে হবে। তাদের উপলব্ধি করতে হবে, সন্তানের চেয়ে পৃথিবীতে মূল্যবান আর কিছু নেই। এই মূল্যবান ধন তাদেরকেই যক্ষের মতো আগলে রাখতে হবে। তাদের যথাযথ যত্ন নিতে হবে। সুষমভাবে গড়ে তোলার জন্য পারিবারিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা এবং নিয়মানুবর্তীতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে।

কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব ও মোবাইল, অনেক রাতে ঘুমাতে যাওয়া, খুব সকালে ঘুমকাতুরে চোখে সন্তানকে উঠিয়ে অনেকটা টেনেহিঁচড়ে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জীবন চক্র থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তাদের বুঝতে হবে সন্তানের সাময়িক বিনোদন এবং আধুনিকতার প্রতিযোগিতায় শামিল করতে গিয়ে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে ঠেলা দেয়া হচ্ছে। সবচেয়ে জরুরী শিশুদের সুরক্ষায় আমাদের প্রত্যেকের মানবিকবোধ সদা জাগ্রত রেগে রক্ষাব্যুহ গড়ে তোলা। যেখানেই শিশু নির্যাতন হয়, সেখানেই প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ করতে হবে।

darpan.journalist@gmail.com