Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ জাতি গঠনে ওয়ায়েজীনদের ভূমিকা

জাতি গঠনে ওয়ায়েজীনদের ভূমিকা

ইসলাম একটি প্রচারধর্মী দ্বীন। এই দ্বীনের প্রচার পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত চলবে। নানা আঙ্গিকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এই প্রচার বা দাওয়াতের কাজ চলছে। মসজিদে, মাদ্রাসায়, মাহফিলে, খানকায় এই দ্বীনের দাওয়াতি দায়িত্ব ওলামায়ে কেরামগণ পালন করছেন এবং এর ধারাবাহিকতা পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ।

এই দাওয়াতি কাজ যখন মাদ্রাসায় হয় তখন ইলমে অহী তথা কুরআন হাদীসের জ্ঞানে সমৃদ্ধ একদল আলেম বা ইসলামী স্কলার গড়ার মহান দাওয়াতি কাজই আঞ্জাম দেওয়া হয়। যারা ইসলামী দাওয়াতের সর্বক্ষেত্রে কুরআন, সুন্নাহর সঠিক ব্যাখ্যা দিবেন এবং দ্বীনকে অপব্যাখ্যা থেকে, মিথ্যাচার থেকে হেফাজত করবেন। বাতিলদের সকল অপপ্রচার এবং ইসলামের ভিতর যারা অতিরঞ্জন করবে তথা শিরক, বিদআতের বিরুদ্ধে দলীলভিত্তিক মোকাবিলা করবেন। রাজনৈতিক ময়দানে ইসলামী সমাজ গঠনে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করবেন।

মোটকথা, ইসলামী দাওয়াতের মূল শক্তি কুরআন, হাদীসের জ্ঞানে সমৃদ্ধ একদল দায়ী তৈরী করে ইসলামের হেফাজতের মহান দায়িত্ব পালন করে যাবেন। মসজিদের খতীব, ইমাম, মোয়াজ্জিন, খানকার পীর, ওয়াজ মাহফিলের বক্তা, দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতের মাশওয়ারা, গাশত, তালীম, বয়ান, জামাতের তারতীব, নুজুম, আজায়েম, তাশকিল, খুরুজ, জোড়, ইজতেমা; এই সকল কাজের সঠিক আঞ্জাম দেওয়ার ময়দানে ওলামায়ে কেরামের কোন বিকল্প নেই।

বলার অপেক্ষা রাখে না, দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে যে দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতের এই ধারা শুরু হয়েছে। যা অদ্যাবধি কওমী ওলামায়ে কেরামগণ যথাসময়ে যথাযথ ভূমিকা পালন করে এই তাবলীগি মেহনতের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

আগামী ১০, ১১ ও ১২ জানুয়ারী ২০২০ইং ৫০তম বিশ্ব ইজতেমা টঙ্গির তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব মুসলমানের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। (বাংলাদেশের স্বাধীনতার সিলভার জুবিলি বা ৫০ বছর পুর্তি পালিত হবে বিশ্ব ইজতেমারও সিলভার জুবিলি। যদিও তাবলীগের মধ্যে এই ধরনের কোন পুর্তি পালনের কোন রেওয়াজ কখনও ছিল না, এখনও নেই)।

এই দাওয়াতি কাজের জন্য একদল হক্কানী ওলামায়ে কেরাম দুনিয়ার শেষ দিন পর্যন্ত আল্লাহর দ্বীন প্রচার করতে থাকবেন। পবিত্র কুরআনুল কারীমের সুরা নাহলের ১২৫ নং আয়াতে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.)কে রিসালাতের দায়িত্ব পালনে যে শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে সে শিক্ষার আওতায় সমস্ত মুমিন মুসলমান অন্তর্ভুক্ত।

বলা হয়েছে- ادع الي سبيل ربك بالحكمة والموعظة الحسنة وجادلهم باللتي هي أحسن অর্থাৎ- আপনি আপনার রবের তথা দ্বীন ইসলামের পথে লোকদেরকে জ্ঞানের কথা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে দাওয়াত দিন। এবং তাদের সাথে উত্তম পন্থায় বিতর্ক করুন।

মসজিদের খতীব হোক, তাবলীগের বয়ানকারী হোক, খানকার পীর সাহেব হোক অথবা ওয়াজ মাহফিলের বক্তা হোক কিংবা যে যেভাবেই দাওয়াতি কাজ করবে, এই কুরআনি শিষ্টাচার শিক্ষা অবলম্বন করা আবশ্যকীয়। দাওয়াত ও প্রচারের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম মূলনীতি ও শিষ্টাচারের পূর্ণ বিবরণ এতে অল্প কথায় বলে দেয়া হয়েছে।

তিনটি মূলনীতি দাওয়াতের জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। এক. হিকমাত, দুই, সদুপদেশ এবং তিন. উত্তম পন্থায় তর্ক-বিতর্ক। হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী (রাহ.) বয়ানুল কোরআনে উল্লেখ করছেন যে, দাওয়াতে সর্বপ্রথম হিকমাতের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের অবস্থা যাচাই করে তদনুযায়ী শব্দ চয়ন করতে হবে। এরপর এসব বাক্যে শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির মনোভাব নিয়ে এমন যুক্তি প্রমাণ পেশ করতে হবে, যা দ্বারা প্রতিপক্ষ নিশ্চিত হতে পারে। বর্ণনা ভঙ্গি ও কথাবার্তা সহানুভূতি ও বিনম্র রাখতে হবে, যাতে প্রতিপক্ষ নিশ্চিত রূপে বিশ্বাস করে যে, সে যা কিছু বলছে আমারই উপকারার্থে এবং হিতাকাঙ্খি হয়েই বলছে। আমাকে লজ্জিত করা অথবা আমার মর্যাদাকে আহত করা তার একেবারেই লক্ষ্য নয়।

আমি লেখাটি শুরু করেছি জাতিগঠনে ওয়ায়েজীনদের ভূমিকা নিয়ে। বাংলাদেশের সর্বত্র নভেম্বর মাস থেকে তিন চার মাস ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন হয়। ওয়াজ যারা করেন তারা অনেকে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং তাদের মাহফিলে লোকসমাগম হয়। পীর সাহেবদের মাহফিল হয় তাদের ভক্ত মুরীদরা জমায়েত হয়ে ওয়াজ শুনে। এই ওয়াজ মাহফিল একটা জাতির গঠনে কি ভূমিকা রাখছে, বক্তা ওলামায়ে কেরামগণ শ্রোতাদের কীভাবে তৈরি করছেন একটা আদর্শ সমাজ গঠনের উপযোগী করে- এই বিষয়টা ইদানিং ভাবিয়ে তুলেছে বোদ্ধা মহলকে।

অবাধ তথ্য প্রবাহের এই যুগে কোন কিছুই আর পর্দার আড়ালে নেই। বিশেষ করে কওমী হক্কানী প্রবক্তার দাবীদার ওয়ায়েজগণ তাদের জনপ্রিয়তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন। তাদের ঘরানার বাইরের জনপ্রিয় বক্তাগণের সমালোচনায় কি শব্দ চয়ন করা হচ্ছে। কি অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করা হচ্ছে। কী হুংকার আর তর্জনী উচু করে গর্জন করা হচ্ছে- তার সব কিছুই এখন আর গোপন নেই।

আমাদের শব্দ চয়ন, উচ্চারণ, অঙ্গভঙ্গি, উপস্থাপন, পরিশুদ্ধ না করে অন্যের ভুলের তীর্যক সমালোচনা যে গ্রহণযোগ্য নয়- তা উপলব্ধি করতে আর কতটা জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলে আমাদের বুঝে আসবে!

ওলামায়ে কেরামগণ নায়েবে রাসূল। সুতরাং ওয়াজ, দাওয়াহ্ ও বয়ানের আদব ও রীতিনীতি থেকে যদি বিচ্যুত হয়ে পড়েন, তাহলে দাওয়াতের পরিবর্তে ” আদাওয়াত” অর্থাৎ শত্রুতা এবং কলহ বিবাদের কারণ হয়। অন্যদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করাই যখন লক্ষ্য হয়, তখন পারস্পরিক সম্প্রীতি, ভালবাসা, ও মানবতাবোধ হারিয়ে যায়।

বক্তার চরিত্রে হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার, আড়ম্বরপ্রীতি; এগুলো তো আত্মিক পাপ। একজন মানুষের জন্য এর চাইতে বড় অনিষ্ট আর কি হতে পারে যে, তাকে ঈমানদার ও পরহেযগারের চরিত্র থেকে বঞ্চিত করে মুনাফিকের চরিত্রে রূপান্তরিত করে দেয়।

কারও শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করা, মাসলা মাসায়েলের সমালোচনার আড়ালে অন্যকে হেয়প্রতিপন্ন করা, প্রকাশ্যে জনসম্মুখে তাকে লজ্জা দেওয়া- এটা দ্বীনের দায়িত্বশীলদের কাজ হতে পারে না।

যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের কোন বিকল্প নেই। সাথে দাওয়াত ও ওয়াজের কৌশল অবলম্বন করতে হবে কোরআন সুন্নাহর ভিত্তিতে। মানুষের অন্তর ক্রিয়াশীল হয় সে রকম শুভাকাঙ্খির প্রেরণায় উদ্বুব্ধ হয়ে কথা বলতে হবে। আমাদের দাওয়াতি কাজের সকল মঞ্চসমূহ চাই সে খতীব হোক, মাহফিলের বক্তা হোক, তাবলীগের বয়ানকারী হোক এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের তরুণ আলেম বা তালেব ইলম হোক, তাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে- জাতি তাদের কাছ থেকে কি আকাঙ্খা করে। সুতরাং একটা আদর্শ জাতি বিনির্মাণে, একটা জাতিকে তার মর্যাদায় পৌছাতে ওলামায়ে কেরামগণ, ওয়ায়েজীনদের বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করার সুযোগ আছে।

সমাজ সংস্কারমূলক বক্তব্য, সুশৃঙ্খল একটা জতি কিভাবে একটি আদর্শ সমাজ গড়তে পারে, একটি সফল রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হতে পারে, সমাজের অসঙ্গতি গুলো দুর করার জন্য প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে কোরআন সুন্নাহর আলোকে যুক্তিনির্ভর জ্ঞান ভিত্তিক আলোচনা সময়ের দাবি। মানুষের নৈতিক আধ্যাত্মিক বিষয়ের আলোচনাও সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করা যা মানুষের হৃদয় কে স্পর্শ করবে সে ওয়াজ বর্তমান সচেতন সমাজ আগ্রহের সাথে শুনতে চায়। আমাদের ওয়ায়েজীনদের মাধ্যমে আল্লাহ পাক সেই জন আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার তৌফিক দান করুন। আমীন।।

লেখক: আলেমে-দ্বীন, গবেষক, মুহাদ্দিস- বরিশাল মাহমূদিয়া মাদ্রাসা।

আরও পড়ুন- ‘আধ্যাত্মিকতায় ভরা সেই সোনালী মাহফিল ফিরে আসুক!’