Home ফিকহ ও মাসায়েল বিশ্বব্যাপী একই দিনে ঈদ উদযাপন চিন্তা মনগড়া ও শরয়ী সিদ্ধান্ত বিরোধী

বিশ্বব্যাপী একই দিনে ঈদ উদযাপন চিন্তা মনগড়া ও শরয়ী সিদ্ধান্ত বিরোধী

- উম্মাহ গ্রাফিক্স।

।। মুফতি মাকবুল হোসাইন কাসেমী ।।

বেশ কিছুকাল যাবৎ এ বিষয়টি খুব আলাচিত হচ্ছে যে, সমগ্র বিশ্বে একই দিনে ঈদ উদযাপন করতে বাধা কোথায়? একই দিনে বিশ্বের সর্বত্র ঈদ উদ্‌যাপন করতে অতি ইচ্ছুক গোষ্ঠী এ ব্যাপারে জোর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। মূলত: একই দিনে সমগ্র বিশ্বে ঈদ উদযাপন সিদ্ধ কিনা- এ ব্যাপারে ইমামদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও ঈদ উৎসবের ধারা শুরু হবার পর থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভিন্ন দিনেই রোযার মাস শুরু হচ্ছে এবং বিভিন্ন দিনেই ঈদ উদযাপিত হয়ে আসছে।

এ বিষয়ে অধুনা নতুন করে কিছু করার চেষ্টা, তদবীর ও গবেষণা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ যুগে যুক্তির মারপ্যাঁচ দিয়েই যেন শরঈ অনেক বিধান ইচ্ছেমত পালন করার প্রচেষ্টা চলছে। আমরা এখানে সমগ্র বিশ্বে একইদিনে ঈদ উদযাপনের পক্ষের যুক্তি, এর খণ্ডন এবং বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন রাষ্ট্রে ঈদ উদযাপনের অপরিহার্যতা, সুবিধা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার প্রয়াস পাব।

সমগ্র বিশ্বে একই দিনে ঈদ উদযাপন করার পক্ষে যুক্তিসমূহও তার খণ্ডন

১. যেমনিভাবে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা তাদের উৎসব, অনুষ্ঠান একই দিনে পালন করে থাকেন, তাতে তাদের উৎসব আনন্দমুখর হয়, তেমনিভাবে মুসলিম বিশ্ব একসাথে ধর্মানুষ্ঠান পালন করলে যে আনন্দ তৃপ্তি অনুভব হবে প্রত্যেক দেশে বিভিন্ন সময়ে পৃথক পৃথকভাবে পালনের দ্বারা সে আনন্দ অনুভূত হবে না।

২. দিক-চক্রকালের বিভিন্নতা বা চাঁদ উদয় হওয়ার স্থানের তারতম্য অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে ধর্তব্য নয়। সুতরাং এক স্থানে চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে গোটা বিশ্বে পর দিন ঈদ করা জরুরী।

৩. যেমনিভাবে নামাযের মূল ভিত্তি হলো সূর্যের উদয় ও অস্ত অথবা বস্তুর ছায়ার হিসাব মেনে নেয়া । অথচ আধুনিক যুগে ঘড়ি আবিষ্কার হওয়ার পর সকলেই বিনা মতভেদে ঘড়ির হিসাবে নামায পড়ে থাকেন। রোযার ব্যাপারেও তদ্রুপ কেউই এখন সাহরী কিংবা ইফতারের জন্য সুবহে সাদিক বা সূর্যাস্তকে দেখে না। বরং ঘড়ির উপরই নির্ভর করে থাকেন। সুতরাং বিজ্ঞানের উন্নতির যুগে চাঁদের ব্যাপারে যদি চাক্ষুষ দেখার নীতি পরিহার করে জ্যোতিষী অংকের দ্বারা চন্দ্র উদয় হওয়াতে মীমাংসা নির্ধারণ করা হয়, তবে ক্ষতি কি?

আরও পড়তে পারেন-

কখন জমিনে মহামারি ছড়িয়ে পড়ে এবং মু’মিনদের করণীয়

আদর্শ পরিবার ও সমাজ গঠনে পিতা-মাতার ভূমিকা

ভারতের মতো শ্রীলঙ্কাও মুসলমানদেরকে কলঙ্কিত করতে করোনভাইরাসকে হাতিয়ার করছে

ঘৃণা-বিদ্বেষ নয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট থাকুক

আল্লাহকে ভয় কর এবং কাজে অনড় থাকো, নিন্দুকের নিন্দা শুনিও না: মাওলানা আহমদ লাট

৪. রাসূলুল্লাহ (সা.)এর যুগে দূরবীক্ষণ, আবহাওয়া বিভাগ ইত্যাদি ছিল না। চাঁদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানার জন্য চোখে দেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। তাই হুযুর (সা.) চাঁদের মীমাংসা দিতে চাক্ষুষ দেখার উপর নির্ভর করেছেন। বর্তমান যুগে আকাশের কিনারায় চাঁদের অস্তিত্ব জানার জন্য বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রের আবিষ্কার হয়েছে। এখন শুধু চোখে দেখার নীতি গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই। চাক্ষুষ দেখার নীতি পুরাতন ভাবধারা; যা বর্তমান আধুনিক যুগে বেমানান, বেখাপ্পা, প্রাচীনত্ব, বর্জন যোগ্য।

প্রথম যুক্তির উত্তর

ইসলাম কারও মন মস্তিষ্ক নিঃসৃত ধর্ম নয়। আল্লাহ প্রদত্ত রাসূল (সা.) প্রদর্শিত শরী’আতের নামই ইসলাম। আমাদের রোযা, ঈদ, নামায অন্যান্য জাতির উৎসবের ন্যায় নিছক আনন্দ উৎসব নয়, বরং ঈদ মহান ইবাদত। মূলত: অন্যান্য জাতির আনন্দ উৎসব হলো ক্ষণস্থায়ী বিনোদন ও প্রবৃত্তির দাসত্বের উপকরণ মাত্র। পক্ষান্তরে মুসলমানদের আনন্দ-উৎসব, সুখ-দুঃখ, জীবন-মরণ সবই আল্লাহর জন্য নিবেদিত। এক কথায় মুসলমানের সবকিছুই দ্বীন। আর দ্বীনের মূলকথা হচ্ছে স্বেচ্ছায় আল্লাহর হুকুম মানা। যে কাজ তিনি যেভাবে করতে নির্দেশ দিয়েছেন সেই কাজ সেভাবেই নির্দ্বিধায় পালন করা। এতে কারো ব্যক্তিগত বুদ্ধি প্রয়োগ কিংবা রায় দানের অবকাশ নেই।

আর এটাও হৃদয়ঙ্গম করা উচিৎ যে, ইবাদতের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত ও নিয়মানুবর্তিতা থাকে, যেমন নামাযের জন্য ওয়াক্ত হওয়া, রোযার জন্য রমাযানের মাস হওয়া ইত্যাদি; সবই উক্ত ইবাদতের আওতাভুক্ত। উদাহরণস্বরূপ নামাজ একটি ইবাদত। নামাজ পাঁচ ওয়াক্ত কেন? কম বেশি হলে ক্ষতি কি? সময় আসার আগে নামায পড়লে অসুবিধা কি? রোযা সুবহে সাদিক হতে এশা পর্যন্ত রাখলে গুনাহ হবে কেন? ২৯ বা ৩০ দিনের স্থলে ৩১ দিন রোযা রাখলে অপরাধ হবে কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর এই যে, নামায, রোযা পালন যেরূপ ইবাদত ঠিক ঐগুলো সময় মত ও ইবাদতের মূলনীতিকে বজায় রেখে আদায় করাও ইবাদত। কারও যুক্তি দর্শন অনুযায়ী তাতে পরিবর্তন করা হলে আল্লাহর হুকুম পালন করা হলো না।

একই দিনে ঈদ পালন করার প্রথম যুক্তি যা চাঁদ দেখা বিষয়ক শরী’আতের মূল নীতির সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ ইসলামী শরী’আত যে সমস্ত আহকাম পালন চাঁদের উপর নির্ভরশীল করেছে, তা জনসাধারণের চাক্ষুষ দেখার উপরই নির্ভর করে। অথচ গোটা বিশ্বে একই সময় চাঁদ দেখা সম্ভবপর নয়। সুতরাং একই দিনে গোটা বিশ্বে ঈদ করা খোঁড়া যুক্তির পিছনে অন্ধ হয়ে ঘোরা ছাড়া কিছু নয়।

উল্লেখ্য, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও তাদের অনুষ্ঠান, উৎসব এক দিনে একসাথে করতে পারে না দিক চক্রবালের ভিন্নতার কারণেই। কারণ, দুনিয়ার সর্বপ্রাচ্যে অবস্থিত অস্ট্রেলিয়া। সেখানে যখন সূর্য উঠবে তা যদি জাপানের টোকিও বেতারে প্রচার করে দেয়া হয়, আর তখন থেকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের লোক (যেখানে এখনও সূর্য ওঠেনি) যদি দিন ধরে নিয়ে সৌর মাস গণনা শুরু করে, এরূপ করলে সৌর মাসের তারিখের ক্ষেত্রে জাপান, আমেরিকার তারিখের যে আগ-পিছ হয়, তা আর হবে না। বাস্তবে কি এরূপ হিসাব করা হয়? কখনও না! তাহলে চান্দ্র মাসের বেলায় এমন হিসাব করার প্রচারণা কেন? আমরা তো চান্দ্র মাস সৌর মাস উভয়টার বেলায়ই দিক চক্রবালের বিভিন্নতা গ্রহণ করি। যেমন ধরুণ ১লা জানুয়ারী নববর্ষ উদযাপন সারা বিশ্বে একই টাইমে পালন সম্ভব হয় না। সবাই নিজ নিজ সূর্যোদয় অথবা প্রত্যেক দেশের রাত ১২.১ মিনিট অনুযায়ী উদযাপন করে থাকে।

দ্বিতীয় যুক্তির উত্তর

চাঁদের উদয়স্থলের বিভিন্নতা কি? প্রথমে তার ব্যাখ্যা তুলে ধরছি। চন্দ্র, সূর্য পৃথিবীতে সব সময় বিরাজমান। সূর্য একস্থানে উদয় হচ্ছে, ঠিক ঐ সময়ে অন্যস্থানে অস্তমিত হচ্ছে। অনুরূপভাবে চাঁদ একস্থানে উদিত হচ্ছে, ঠিক ঐ সময়ে অন্যস্থানে পূর্ণিমা বা অমাবস্যা। চন্দ্র, সূর্যের এই উদয় ও অস্ত যাওয়ার বিভিন্নতাকে শরীয়তের পরিভাষায় “ইখতেলাফে মাতালে” বলে। চাঁদের উদয়স্থলের উক্ত বিভিন্নতার ব্যাপারে সমস্ত ফুকাহায়ে কেরাম একমত।

আইম্মায়ে মুজতাহিদগণের মতভেদ হল, এই মাসআলাটির উপর যে, যদি একস্থানের জনগণ কোন নতুন চাঁদ দেখে আর তা সাক্ষীর দ্বারা প্রমাণিত হয়, তবে যে স্থানে এখনও নতুন চাঁদ দেখা যায়নি সেখানে যদি উক্ত চাঁদ দেখার সংবাদ শরী’আত সম্মত উপায়ে পৌছে, তাহলে উক্ত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে সে এলাকার লোকদের জন্য রোজা রাখা বা ঈদ পালন করা জায়েয হবে কিনা? এ ব্যাপারে ইমামগণের তিন ধরণের মতামত পাওয়া যায়।

১. চাঁদের উদয়স্থলের বিভিন্নতা সর্বস্থানে সর্বাবস্থায় গণ্য করা হবে। অর্থাৎ এক এলাকার লোকের চাঁদ দেখা অন্য এলাকার লোকের জন্য যথেষ্ট নয়।

২. এক এলাকার লোকের চাঁদ দেখা অন্য এলাকার লোকের জন্য যথেষ্ট।

৩. দূরবর্তী এলাকার জন্য গ্রহণযোগ্য, নিকটবর্তী এলাকার জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।

আশ্চর্যের কথা, উক্ত তিনটি মতামত হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বলী; এই চারটি মাযহাবের ফকীহগণের মধ্যে বিদ্যমান। তবে প্রসিদ্ধ কথা হচ্ছে, প্রথম উক্তিটি ইমাম শাফেয়ী (রাহ.)এর অভিমত। দ্বিতীয় উক্তিটি ইমাম আবু হানীফা (রাহ.), এবং তৃতীয়টি সর্বস্তরের ফকীহগণের অভিমত।

যারা চাঁদের উদয়স্থলের বিভিন্নতা সর্বাবস্থায় গণ্য করেন, তাদের যুক্তি হলো, সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের বিভিন্নতা সর্বজনমান্য। একই সময়ে কোন দেশে ফজরের নামায হয়, কোন স্থানে মাগরিবের নামায হয় বা কোন স্থানে এশার নামায হয়। ঠিক একিভাবে চাঁদের ব্যাপারেও নিজ নিজ এলাকায় স্থানীয় সময় প্রযোজ্য হবে। এক স্থানের সাক্ষী শরী’আতের নীতি অনুযায়ী অন্য শহরে পৌছলেও ঐ শহরবাসীর জন্য তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এহেন অবস্থায় এক শহরকে অন্য শহরের অধীন বিবেচনা করা উচিত হবে না। যারা চাঁদের উদয়স্থলের বিভিন্নতা কোনো অবস্থাতেই গণ্য করতে চান না, তাদের যুক্তি হলো স্বয়ং রাসূল (সা.) সকল উম্মতকে সম্বোধন করে ইরশাদ করেছেন যে, “তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখ, চাঁদ দেখে ঈদ কর” । একথা পরিস্কার যে, দুনিয়ার সকল মানুষের জন্য চাঁদ দেখা জরুরী নয়। সুতরাং এক দেশের মানুষের চাঁদ দেখা অন্য দেশের লোকের জন্য যথেষ্ট হবে না কেন? এক শহরের শরী’আতের সাক্ষী অনুযায়ী চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে অন্য শহরবাসীর উপর চাঁদ দৃশ্যমান হয়েছে ধরে আমল করা জরুরী হবে।

যেসব ফুকাহায়ে কেরাম মীমাংসা নীতি অবলম্বন করে দূরবর্তী শহরে চাঁদের উদয়স্থলের বিভিন্নতা গণ্য হওয়ার ও নিকটবর্তী শহরে গণ্য না হওয়ার মত পোষণ করেছেন, তাদের যুক্তি হলো, নিকটবর্তী অঞ্চলে পার্থক্য কম বিধায় তা এড়ানো সম্ভব। কিন্তু দূরবর্তী এলাকার মাঝে পার্থক্য অনেক গভীর; যদ্বারা রাত ও দিনের মতো ব্যবধান হয়ে যাবে।

দ্বিতীয় মতটি যদিও ইমাম আবু হানিফার জাহেরী রেওয়ায়েত। কিন্তু হানাফী মাযহাবের বড় বড় ফকীহগণ তৃতীয় মতটি গ্রহণ করেছেন। ইমাম যায়লায়ী (রাহ.) যিনি হানাফী মাযহাবের ফকীহদের মধ্যে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী, তিনিও তৃতীয় মতটি গ্রহণ করেছেন। এছাড়াও বর্তমানে সর্বস্তরের মুহাক্কিক ফকীহগণ তৃতীয় মতের উপর ঐক্যমত পোষণ করেছেন। তৃতীয় মতের উপর (ফতোয়া) সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত।

আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী (রাহ.) যিনি বর্তমান বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, তিনি তৃতীয় মতের শ্রেষ্ঠত্বের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

আল্লামা শিব্বীর আহমদ উছমানী (রাহ.) এই তৃতীয় মতটি গ্রহণীয় হওয়ার ক্ষেত্রে দলীল পেশ করে বলেন, কুরআন ও হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, চন্দ্রমাস ৩০ দিনের বেশী এবং ২৯ দিনের কম হয় না। এহেন অবস্থায় যদি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মাঝে বিরাজমান দূরত্বের ব্যবধান গণ্য করা না হয়, তবে কোরআন ও হাদীসের খেলাফ হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনো এক স্থানে ২৮ তারিখে দূরদেশ হতে সাক্ষী উপস্থিত হয়ে বলল- আমরা অমুক স্থানে চাঁদ দেখে এসেছি। এখন যদি এ স্থানটিকে ঐ দূরদেশের অধীন করে দেয়া হয়, তবে এ স্থানে বর্তমান চন্দ্রমাস ২৮ দিনের হবে।

অনুরূপভাবে কোন এক এলাকায় রমজানের ৩০ তারিখে বহুদূর দেশ থেকে লোকজন এসে বলল, আজ অমুক স্থানে রমজানের ২৯ তারিখ । যদি আজ ঐ স্থানে চাঁদ না দেখা যায় তবে সেখানে আগামীকালও রোযা হবে। ঘটনাক্রমে চাঁদ দেখা গেল না। এই অবস্থায় যদি এই এলাকাটিকে সেই দূরবর্তী দেশের অধীন করে দেয়া হয়, তবে এখানে ৩১ দিন রোযা রাখতে হবে, যা কোরআন ও হাদীসের সম্পূর্ণ বিপরীত।

আল্লামা উসমানী রাহ. এর উক্ত ব্যাখ্যা দ্বারা বুঝা যায়, যদি এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চল এতটুকু দূরে হয় যদ্বারা এক অঞ্চলে চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য গ্রহণ করা হলে মাস ২৮ দিন বা ৩১ দিন হয়ে যায়, তবেই উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রহণযোগ্য হবে, অন্যথায় নয়।

উপমহাদেশের বিশিষ্ট মুফতী আল্লামা শফী (রাহ.) বলেন, আমার ধারণা, ইমাম আবূ হানীফাসহ যে সব ইমাম চাঁদ উদয়ের বিভিন্নতা গ্রহণ করেননি, তার কারণ এই যে, যেসব শহর সমূহের পূর্ব পশ্চিমে দূরত্ব এতটুকু যে, পূর্ব যুগে ঐ স্থানসমূহের একস্থানের সাক্ষী অন্যস্থানে পৌঁছা একটি অসম্ভব ব্যাপার ছিল। এজন্য তারা এটাকে উপেক্ষা করেছেন। কিন্তু বর্তমানে যখন উড়োজাহাজ সমূহ ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক যন্ত্রাদি সমস্ত দুনিয়ার মাশরিক ও মাগিরবকে এক করে দিয়েছে এবং এক স্থানের সাক্ষী অন্য স্থানে পৌঁছা দৈনন্দিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, এহেন পরিস্থিতিতে যদি পাশ্চাত্যের সাক্ষী প্রাচ্যের জন্য মেনে নেয়া হয়, তবে এক স্থানে চন্দ্রমাস ২৮ দিন ও অন্য স্থানে ৩১ দিন হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়বে। যা শরীয়তের সরাসরি পরিপন্থী। সুতরাং ‘ইখতেলাফে মাতালে’ দূরবর্তী স্থানে গ্রহণযোগ্য, নিকটবর্তী স্থানে গ্রহণীয় নয়; ধর্তব্য হবে। হানাফী মাযহাবের পরবর্তী উলামায়ে কিরাম উক্ত কারণেই এই মতামতকে গ্রহণ করেছেন।

ততীয় যুক্তির উত্তর

আধুনিক যন্ত্রাদি তথা বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কৃত সকল প্রযুক্তি ও নিয়ম প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালারই সৃষ্টি। এসবকে কৃতজ্ঞতার সাথে কাজে লাগানো উচিৎ। বিজ্ঞানের সঙ্গে অপরিচিত থাকা কোন ধর্ম বা বিবেকের কাজ নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে শরীআতের মূলনীতি হলো, বিজ্ঞানের মাধ্যমে আবিষ্কৃত প্রযুক্তি ও নিয়মসমূহ আল্লাহর নাফরমানীতে বা এমন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা উচিত হবে না, যার ফলে ইসলামের কোন মূলনীতির উপর আঘাত আসতে পারে। এ কারণেই বন্দুক, গোলা, ট্যাংক এবং বিভিন্ন ধরনের বোমা আবিষ্কার হয়েছে। অথচ কোন আলিম বর্তমান লড়াইয়ে এসব অস্ত্রের ব্যবহার নাজায়েয বা গুনাহ মনে করেননি। ঠিক তেমনি খবর সরবরাহের জন্য আবিষ্কৃত যন্ত্রের মাধ্যমে প্রেরিত সংবাদসমূহকে সংবাদের সীমারেখা পর্যন্ত একেবারে বিনা মতভেদে আলেমগণ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু যেখানে সংবাদ যথেষ্ট নয়, বরং সাক্ষীর প্রশ্ন রয়েছে, সেখানে সাক্ষীকে স্বয়ং উপস্থিত হয়ে বর্ণনা দিতে হয়। এ ব্যাপারে দুনিয়ার সমস্ত আদালত ও উলামায়ে দ্বীন একমত।

উপরোক্ত নীতির আলোকে চাঁদ দেখা ও নামাযের ব্যাপারে একটু চিন্তা করলেই বুঝা যাবে যে, নামাযের ব্যাপারে সূর্যের উদয় ও অস্তের মধ্যে ঘড়ির উপর নির্ভর করলে ইসলামী নীতির পরিবর্তন হয় না। বরং একটি সহজতম পথ গ্রহণ করা হয়। কারণ, ঘড়ির ব্যাপারে একটু সন্দেহ হলে যে কোন ব্যক্তি আকাশের দিকে তাকালেই নামাযের মূল ওয়াক্ত চিনতে পারবে। কিন্তু চাঁদের ব্যাপারে জনসাধারণের চাক্ষুস দেখার নীতি পরিহার করলে শরীয়তের একটি নীতি পরিবর্তন হয়ে যায়। কারণ, পূর্বেই উল্লেখ হয়েছে, চাঁদের ব্যাপারে শরী’আতের দৃষ্টিভঙ্গি চাক্ষুষ দেখার উপর, চাঁদের অস্তিত্বের উপর নয়। অথচ দূরবীণ বা জ্যোতিষী অঙ্কের উপর নির্ভর করলে মাস’আলাটির ভিত্তি চাঁদের অস্তিত্বের উপর হয়ে যায়।

চতুর্থ যুক্তির উত্তর

পৃথিবীর ইতিহাস সম্বন্ধে যাদের সামান্যতম জ্ঞান আছে তারা ভালভাবেই জানেন যে, জ্যোতিষবিদ্যা রাসূল (সা.)এর যামানার বহু পূর্ব হতেই দুনিয়াতে প্রচলিত ছিল এবং হুজুর (সা.)এর যুগেও মিসর, সিরিয়া, ভারত প্রভৃতি স্থানে অতি ব্যাপকভাবে মানমন্দির স্থাপিত ছিল। এগুলোর মাধ্যমে সঠিকভাবে ভবিষ্যত্বাণীও করা হত। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রাযি.)এর সময়ে মিসর ও সিরিয়া ইসলামী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাসূলে করীমের যুগে চাঁদের অস্তিত্ব জ্ঞাত হওয়ার যন্ত্রাদির অভাব ছিল- একথা মেনে নিলেও; হযরত ফারুকে আযমের যুগে যখন বিভিন্ন দেশ মুসলিম রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হলো, তখন ঐসব যন্ত্রের মোটেই অভাব ছিল না। এহেন পরিস্থিতিতে হযরত উমর (রাযি.)এর মত বিচক্ষণ খলীফা সম্পর্কে এই কথা কল্পনা করা যায় না যে, যে হুকুমটি রাসূল (সা.) দিয়েছিলেন, সেই হুকুমটি ফারুকে আযমের যুগে প্রাচুর্যের সময়েও তিনি পরিবর্তন করলেন না।

ইতিহাস সাক্ষ্য দিবে, খুলাফায়ে রাশেদীন ও তৎপরবর্তী যুগে প্রায় একহাজার বৎসর পর্যন্ত দুনিয়ার অধিকাংশ দেশের উপর ইসলামী হুকুমত থাকাকালীন সমস্ত মুসলিম বিশ্বে চাঁদের ব্যাপারে চাক্ষুস দেখার নীতিই গ্রহণ করা হয়েছে। আধুনিক যন্ত্রাদির উপর নির্ভর করে একই দিনে ঈদ পালন করার চিন্তা কোন হুকুমাত করেননি। প্রত্যেক হুকুমাতই নিজস্বভাবে চাঁদ দেখে স্বাধীনভাবে ঈদ উদযাপন করেছেন। বর্তমান যুগেও মুসলিম বিশ্বের প্রায় সকল দেশে আবহাওয়া বিভাগের সংবাদের উপর নির্ভর না করে চাক্ষুস দেখার উপর আমল হচ্ছে। তদুপুরি কোন ইসলামী রাষ্ট্রে শরীয়তের খেলাফ নীতির উপর আমল করলেও তা জায়েয হওয়ার দলিল হতে পারে না।

৪. একই দিনে ঈদ উদযাপনের অসুবিধাসমূহঃ

এক: ইসলাম ভৌগোলিক ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ঘোর বিরোধী। ইসলামের দৃষ্টিতে পূর্ব-পশ্চিম তথা গোটা দুনিয়ার মুসলমান এক জাতি। ইসলামের হুকুম আহকামও গুটি কতক উন্নত এলাকার অধিবাসীদের জন্য সীমিত নয়। বরং সর্বব্যাপী এবং সবার জন্য এক ও অভিন্ন।

বিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে পৃথিবী আজ জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির চরম শিখরে অধিষ্ঠিত। তা সত্ত্বেও উন্নত এলাকার তুলনায় অনুন্নত এলাকা রয়েছে, যেখানে আজ পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নের হাওয়া খুব একটা লাগেনি। এমতাবস্থায় যদি ইসলাম গোটা উন্নত এলাকার ওপর তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এই হুকুম দিয়ে দিত যে, তোমরা যখন চাঁদ ওঠার সংবাদ পাবে, অথবা জ্যোতির্বিজ্ঞানের অঙ্ক অনুযায়ী যখন জ্ঞাত হবে, তখনই রোযা ও ঈদ পালন করবে। তোমাদেরকে চাক্ষুষ চাঁদ দেখতে হবে না।

অথবা এই হুকুম দেয়া হতো যে, চাক্ষুস চাঁদ না দেখা গেলে যন্ত্রাদির মাধ্যমে চাঁদ অনুসন্ধান করে নেয়া উত্তম বা মোস্তাহাব। তাহলে সীমিত কতক শহরবাসী ও উন্নত এলাকার জনগণ এই হুকুম দ্বারা লাভবান হতো। কিন্তু অনুন্নত এলাকার লোকজন কত বড় জটিলতার সম্মুখীন হতো? এক সঙ্গে ঈদ করার আনন্দ তাদের ভাগ্যে জুটত না। কাজেই ইসলাম ইবাদতের সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে এমন নীতি গ্রহণ করেছে, যা সকলের জন্য সহজ ও বোধগম্য।

ইসলাম মানুষকে এক আল্লাহর অধীন ব্যতীত আর কারও অধীনস্থ করতে চায় না। যদি এক অঞ্চলের সময়কে অন্য অঞ্চলের সময়ের অধীন করে দেয়া হতো, তবে অধীনস্তগণ তাদের স্বাধীনতা হারিয়ে বিভিন্ন জটিলতার সম্মুখীন হতেন। তাছাড়া এটা স্পষ্ট যে, গরীব ও আমিরের পার্থক্য ইসলামী প্রকৃতির পরিপন্থী। ইসলামী আহকামকে চন্দ্র সূর্যের প্রকৃত আবর্তনের সূক্ষ্ম তত্ত্বসমূহের অধীন না করার পেছনে এই রহস্যও থাকতে পারে যে, মানুষ যেন জ্ঞাত হয়, মুসলমান চন্দ্র-সূর্যের পূজা করে না। তাদের ইবাদতে চন্দ্র-সূর্যের কোন প্রভাব নেই। এইসব শুধু ইবাদতের সময় নির্দিষ্ট করার কাজে ব্যবহৃত। মুসলমান যা করে তা হলো, সদাসর্বদা সর্বক্ষেত্রে তারা আল্লাহর আদেশ মেনে চলে।

তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উম্মতে মুহাম্মদীর কিবলার বিষয়টি। ইসলামের প্রারম্ভে ১৬-১৭ মাস বাইতুল মুকাদ্দাসকে কিবলা নির্ধারণের পর পুনরায় বাইতুল্লাহকে কিবলা বানানোর পেছনে শুধুমাত্র এই রহস্য নিহিত ছিল যে, যাতে রাসূল (সা.)এর কথার কে অনুসরণ করেন আর কে করেন না; তা প্রত্যক্ষ করা যায়। অর্থাৎ মুসলমান কোন ঘর বা দেয়ালের পূজা করেন না। কিবলা শুধু এইজন্য যে, ঐ দিকে মুখ করে নামায আদায় করা আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম।

ইসলামে সূর্যের হিসাবের স্থলে চন্দ্রের হিসাব এ কারণেই গ্রহণ করা হয়। যেহেতু সূর্যের মাস ও তারিখসমূহ দূরবীক্ষণ যন্ত্র ব্যতীত জানা যায় না, জানুয়ারী কখনো ৩১ দিনে হয়, ফেব্রুয়ারি কখনো ২৮ দিনে কখনো বেশি দিনে হয়। এসব হিসাব বর্তমানে বেশী ব্যাপক হওয়াতে শহরে গ্রামে ছড়িয়ে গেছে, ফলে অনেকটা সহজ অনুভূত হয়। কিন্তু জঙ্গল, পাহাড়সমূহের বাসিন্দাগণের জন্য আজও এই সমস্ত হিসাব রাখা কঠিন। বিধায় ইসলাম সরল সহজতম পন্থা অবলম্বন করেছে। অর্থাৎ চাক্ষুস চাঁদ দেখা। যা সকল স্থানের প্রত্যেক ব্যক্তি সহজে দেখতে ও হিসাব রাখতে পারেন।

দুই: জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব ও দূরবীক্ষণ যন্ত্রাদির মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানসমূহ যদি একেবারে নিখুঁত সত্য ধরে নেয়া হয়, তবুও শরীয়তের বিধানে এইসব যন্ত্রসমূহ টেনে আনলে উপকারের স্থলে অপকারই বেশি হবে। কেননা, সুক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে বুঝা যাবে যে, জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব ও আধুনিক যন্ত্রাদির মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানসমূহ সব সময় সন্দেহমুক্ত হয় না।

জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব মতে যে সমস্ত ক্যালেন্ডার তৈরি হয়েছে, তাতে চাঁদ দেখার ব্যাপারে গরমিল দেখা যায়। বিজ্ঞানের অত্যাধুনিক অগ্রগতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের নব আবিষ্কার সমূহ প্রাচীন বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের অনেক তথ্য ভুল প্রমাণ করেছে। ভবিষ্যতেও আরো কত ভুল প্রকাশ পাবে তা কে জানে? তাছাড়া বর্তমানেও একজন বিজ্ঞ পণ্ডিতের মতের সাথে অন্যজন একমত হতে পারছে না।

চতুর্থ শতাব্দীর বিখ্যাত ইসলামী দার্শনিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী পণ্ডিত আবু বায়হান আল বেরুনী এই সব বিষয়ের অদ্বিতীয় পণ্ডিত এবং সমগ্র বিশ্বে নতুন আলো ও নতুন গবেষণার যুগেও যার নেতৃত্ব স্বীকৃত, তার বিখ্যাত গ্রন্থে একজন জার্মান ডাঃ সি অ্যাডওয়ার্ড ছাড়াও এর লিখিত বই লিজকের টিকাতে ছেপে প্রচার করা হয়েছে। তাতে মন্তব্য করা হয়েছে যে, মান মন্দিরের দূরবীক্ষণের সংগৃহীত ফলাফলসমূহ নির্ভুল নয় এবং এই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই।

কাশফুয যুনুন নামক কিতাবে চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শামসুদ্দীন মোহাম্মদ বিন আলী খাজা লিখেছেন, এই সব ব্যাপারে কোন সঠিক ও সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ বাণী করা সম্ভব নয়। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) চাঁদ সম্পর্কে যে হাকিমানা তথা বিজ্ঞোচিত নীতি গ্রহণ করেছেন, তার বাস্তবতা ও যথার্থতা সম্পর্কে দ্বিমত করার সুযোগ নেই।

– মুফতি মকবুল হোসাইন কাসেমী, ফারেগ- দারুল উলূম দেওবন্দ এবং শিক্ষা পরিচালক ও মুহাদ্দিস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা।

উম্মাহ২৪ ডটকম: আইএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

হযরত যাকারিয়া (রাহ.)এর কতিপয় অমর বাণী