Home ওপিনিয়ন ফেসবুকে ঝগড়া-ঝাঁটিতে কার লাভ হয়?

ফেসবুকে ঝগড়া-ঝাঁটিতে কার লাভ হয়?

।। আলতাফ পারভেজ ।।

এক.
অন্য দেশগুলোর বৃত্তান্ত কমই জানি। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে আশে-পাশের দেশ বার্মা, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান ও শ্রী লঙ্কার একটা বড় মিলের দিক দেখতে পাচ্ছি- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চরিত্রে।

বাংলাদেশ ও বার্মায় টুইটার ব্যবহারকারী তুলনামূলকভাবে কম। তবে ফেইসবুক ব্যবহারকারী এই চার দেশেই বিপুল। চার দেশেই এই অঙ্গনে ফ্যাসিবাদী মনস্তত্ত্বের ব্যাপক জয়-জয়কার চলছে এখন। এই অঞ্চলের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘বেসরকারি’ প্রেক্ষিত এটা। কিন্তু ‘সরকারি’ প্রেক্ষিতের মতো এ দিকটি নিয়ে কথাবার্তা কম হয়।

মূলত: জাতিবাদ ও বিশেষ বিশেষ ধর্মবিশ্বাসকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এ নতুন অবস্থাটি দাঁড় করানো হয়েছে এবং হচ্ছে। দেশে ও জনস্বার্থে কেজো মানুষদের তৎপরতায় ত্রুটি-বিচ্যুতি খুঁজতে বসে আছে হাজার-হাজার কি-বোর্ড সৈনিক। নিজেরা উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক কোন কাজ ও তৎপরতায় হয়তো নেই- কিন্তু অন্যদের প্রচেষ্টার সমালোচনায় খুব পারঙ্গম এরা। সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে ‘অপর’কে হেয় করা, অপরের কাজের সামাজিক গুরুত্ব খাটো করার চেষ্টা খুব যত্নের সঙ্গে করে যাওয়া হচ্ছে। ফেসবুক-টুইটার এদিক থেকে এই সমালোচক-সম্প্রদায়ের জন্য বিশাল এক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। এর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক তাৎপর্য। ফেসবুক-টুইটারওয়ালারা বুঝে-শুনেই এরকম পরিসর খুলেছে।

আরও পড়তে পারেন- ‘ভাইরাস ও ভ্যাকসিন ব্যবসা: এখনি সোচ্চার হওয়ার সময়’

দুই.
সামাজিক কোন কাজই জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকা উচিত নয়। এরকম সব কিছুই গঠনমূলক পর্যালোচনার মধ্যদিয়ে আরও বেশি অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। তবে কী-বোর্ড সৈনিকরা ‘পর্যালোচনা’য় আগ্রহী নন। তাঁরা মজা পান কেবল ‘সমালোচনা’য়। সামাজিক কোন তৎপরতার ভবিষ্যত মূল্যায়নের দায়িত্ব দীর্ঘমেয়াদে জনগণের হাতে ছেড়ে দিতে নারাজ তাঁরা। বরং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই তার তাৎক্ষণিক বিচার-আচার-ফাঁসি দিতে তৎপর এরা। এমনকি ফাঁসির পরও কী বোর্ড থামাতে অনিচ্ছুক!!

এই সমালোচকদের বড় অংশের ভাষায় যে দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ মেলে- তাতে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, সমাজ-রাষ্ট্র-বিশ্ব যেভাবে চলছে তাতে ওনারা হতাশ। কিন্তু এই অবস্থার গঠনমূলক, মেঠো পরিবর্তনের কাজে তাঁদের হাত মেলানোর খবরা-খবর পাওয়া যায় না। কথার বদলে বাস্তব বিকল্প মডেল তৈরির কাজে যে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকারের ব্যাপার আছে- সেদিকে তাঁদের পক্ষপাত মেলে না। তাঁরা কেবল নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে অন্যের ভুল খুঁজবেন। দরকার মতো মনগড়া ‘ভুল’-এর বোঝাও চাপিয়ে দিবেন। যেকোন রূপান্তর চেষ্টাই তাঁদের কাছে অসম্পূর্ণ; সুতরাং পরিত্যাজ্য।

তিন.
যে দেশগুলোর অবস্থা নিয়ে এসব কথা হচ্ছে- সেগুলোর চলমান হালহাকিকত বলে দেয়- পরিবর্তনবাদী মানুষরা সেখানে কীরকম সংখ্যালঘু। মনস্তাত্ত্বিকভাবে এরকম মানুষরা পৃথক চরিত্রের হন। তাঁরা কাজিয়া থেকে ভবিষ্যত নির্মাণচেষ্টায় বেশি আগ্রহী। তাঁরা জানেন সময় কম- কাজ অনেক। ফলে কী-বোর্ড যুদ্ধে তাঁদের মনযোগ কম- ‘বিজয়’ও ক্ষীণ। এ অবস্থা অপর শিবিরের জন্য বিশেষ আত্মতৃপ্তিকর। এই ‘তৃপ্তি’র একটা ‘বাজারী প্রভাব’ সমগ্র যোগাযোগমাধ্যমে এবং মূলধারার প্রচারমাধ্যমেও পড়ে। এভাবে নৈরাশ্যবাদী-সমালোচনা-সংস্কৃতির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন ঘটে চলছে সামাজিক চৈতন্যে। অনেক আগেই মনোবিদরা একে নাম দিয়েছিলেন `TINA’ syndrome (TINA= There Is No Alternative).

আরও পড়তে পারেন- ‘নতুন ‘সামাজিক’ চুক্তি দরকার’

চার.
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে TINA syndrome পৃষ্ঠপোষকতার সামাজিক তাৎপর্য অনেক। এটা ‘সিস্টেম’-এর জন্য বেশ স্বস্তিকর। প্রথমত দেশে-দেশে মানুষকে (বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে) জাতে-জাতে, ধর্মে-ধর্মে, বর্ণে-বর্ণে, নারী-পুরুষে, সংস্কৃতিতে-সংস্কৃতিতে বিভক্ত রাখা যায়। এক দলের বিপরীতে অপর দলকে ‘শ্রেষ্ঠত্বে’র আমেজে আসক্ত রাখা যায়। এরকম ‘পারস্পরিক শ্রেষ্ঠত্বের যোগফল’ হলো ‘ঐকবদ্ধভাবে কোন কিছু না হওয়া’। এরকম বিভক্তি বিদ্যমান ‘স্থিতিশীলতা’কে সরাসরি স্বস্তি দেয়।

‘টিনা সিনড্রোম’ থেকে ‘সিস্টেম’-এর জন্য দ্বিতীয় লাভের দিক, যেকোন ধরনের ভবিষ্যতমুখী রূপান্তর চেষ্টাকে তাৎক্ষণিকভাবে ভ্রুণ অবস্থাতেই পঙ্গু করে দেয়া যায়। তার থেকে বিশ্বের ইতিবাচক মনযোগ নষ্ট করা যায়। ‘গণতন্ত্র’চর্চার নামেই কাজটি সমাধা করা যাচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার ‘টিনা সিনড্রোম’-এর বৈশ্বিক তাৎপর্যটি অনেক বড়। কারণ উপরে উল্লিখিত পাঁচটি দেশে বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় চার ভাগের এক ভাগের বাস। এদের এক পঞ্চমাংশ ফেসবুক ব্যবহার করছে। ফলে বৈশ্বিক ‘স্থিতিশীলতা’র মুরুব্বিদের জন্য এ অঞ্চলের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কাজিয়া থেকে প্রাপ্তি বিশাল।

– আলতাফ পারভেজ, গবেষক।

আরো পড়তে পারেন- ‘দুর্যোগে মানুষকে সহায়তার রাজনীতি’