Home সম্পাদকীয় আশূরা পালনে বিভ্রান্তি নিরসনের এখনই সময়

আশূরা পালনে বিভ্রান্তি নিরসনের এখনই সময়

আশূরা নিয়ে শুক্রবার জুমার খুতবায় দেশের প্রায় সকল মসজিদের খতিবগণই বয়ান করেছেন। এ দিনের তাৎপর্য তুলে ধরে মুসলমানদের করনীয় তুলে ধরেছেন। মুহাররম মাসের শুরু থেকেই এ নিয়ে সোস্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা চলছে। আগামীকাল রোববার হিজরি ১৪৪২ সনের মুহাররম মাসের দশম দিন তথা আশূরা।

সব বয়ান-আলোচনায় একটি বিষয়ই আসছে যে, শরীয়তের দৃষ্টিকোণে আশূরার দিনটি কারবলার স্মরণে শোক পালনের দিন হিসেবে পালনীয় দিন নয়। এটি আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার কারণ- এ নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে।

ইসলামে আশূরা উপলক্ষে রোযা রাখার যে আমল সেটি ফেরাউনের কবল থেকে হযরত মূসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের মুক্তি লাভ এবং ফেরাউন ও তার অনুসারীদের লোহিত সাগরে ডুবে সলিল সমাধির ঘটনার শুকরিয়া আদায় হিসাবেই। এটি হযরত মূসা (আ.)এর সুন্নাত। এ উপলক্ষে রোযা রাখা ছাড়া অন্য কোন আমল শরীয়তে নেই।   

আশূরায় রোযা রাখার নির্দেশনা হাদীসে এসেছে। ইসলামে রোযা ফরজ হওয়ার আগে আশূরার দিন রোযা রাখা ফরজ ছিল। রমজানের রোযা ফরজ হওয়ার পর থেকে এই দিন রোযা রাখা নফল। তবে রমজানের পর নফল রোযার মধ্যে এই রোযার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। রাসুলে পাক (সা.) এই দিন রোযা রেখেছেন এবং রাখতে বলেছেন। এদিন রোযা রাখলে বিগত এক বছরের গুনাহ আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দেন মর্মে হাদীসে উল্লেখ আছে।

আরও পড়তে পারেন-

সহীহ বোখারী ও মুসলিম হাদীস গ্রন্থে হযরত মূসা (আ.) এর  ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তির ঘটনার স্মরণে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় হিসেবে আশূরায় রোযা রাখার বিষয়টি পরিস্কারভাবে এসেছে। যেহেতু ইহুদীরাও আশূরার রোযা রাখতো সেজন্য রাসূল (সা.) তাদের বিপরীত করতে বলেছেন। তারা একটি রোযা রাখতো। এজন্য মুসলমানদের আগের বা পরের দিন মিলিয়ে দুটি রোযা রাখার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে ইহুদীরা আশূরায় রোযা রাখেন না বলেই প্রতীয়মান হয়। এজন্য বর্তমান যুগের বিশেষজ্ঞ আলেমদের অনেকে শুধু আশূরার দিন রোযা রাখলেও আশূরার রোযার ফজিলত পাওয়া যাবে বলে মত দিয়েছেন।

মুৃহাররম পবিত্র কোরআনে ঘোষিত ৪টি পবিত্র মাসের অন্যতম। মুৃহাররম, রজব, যিলক্বদ ও যিলহজ্ব- এই চারটি মাস পবিত্র মাস হিসেবে কোরআনে উল্লেখ রয়েছে। এই মাসগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ। অতীতে কাফের-মুশরিকরাও হারাম মাসের মর্যাদা রক্ষা করে চলতেন। এই দিক থেকেও মুহাররম মাস গুরুত্বপূর্ণ।

একটি দুর্বল হাদীসের ওপর ভিত্তি করে মুসলমানদের একটি অংশ আশূরার দিনে ভালো খাবার খাওয়া ও খাওয়ানোর নিয়ম পালন করে থাকেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞ আলেমদের মতে এই হাদীস আমলযোগ্য নয়। এর বাইরে ইসলামী শরীয়তে আশূরার আর কোন বিশেষ তাৎপর্য এবং পালনীয় কিছু নেই।    

৬১ হিজরির ১০ই মুহাররম  অর্থাৎ রাসূল (সা.)এর  ইন্তেকালের ৫০ বছর পর কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটে। রাসূল পাক (সা.) এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (রাযি.) ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণের ঘটনার দিনটি আশূরার দিন ছিল।  নিশ্চয়ই কারবালার ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে অনেক মর্মন্তুদ, নির্মম, শোকাবহ, তাৎপর্যপূর্ণ, শিক্ষনীয় এবং স্মরণীয় বটে। এছাড়া পৃথিবীতে আশূরা দিনে অনেক ঘটনা ঘটেছে এমনকি কেয়ামতও আশূরা দিনে হবে বলে বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়।

ইসলামের বিধান পালনের ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সা.) হাদীসের নির্দেশনার বাইরে কোন কিছু করার সুযোগ নেই। দুনিয়াবি  বা সামাজিক রীতি-নীতি পালনের ক্ষেত্রেও কোরআন-হাদীদের অনুমোদনের বাইরে এবং এ দুয়ের সাথে সাংঘর্ষিক রীতি পালন করার কোন সুযোগ নেই।

কিন্তু শিয়া সম্প্রদায়ের প্রভাবে বিশ্বের অনেক দেশে আশূরা পালনের ক্ষেত্রে হিজরি ৬১ সনে সংঘটিত কারবালায় ইমাম হুসাইনের নির্মম শাহাদাতের ঘটনাকেই সামনে আনা হচ্ছে বছরের পর বছর। সেই  শোকাবহ ঘটনার স্মরণকেই প্রধান উপলক্ষ হিসাবে সামনে এনে এই দিনটিকে শোকের দিন হিসেবে পালনের প্রথা চলে আসছে।

শিয়া সম্প্রদায় এই দিনকে কেন্দ্র করে তাজিয়া মিছিল থেকে শুরু করে প্রকাশ্য হায় হুসাইন হায় হুসাইন বলে শোকের মাতমের মধ্য দিয়ে দিনটিকে উদযাপন করে। এর প্রভাবে মুসলিম সমাজে আশূরার ইসলামী শরীয়তের মূল নির্দেশনা উপেক্ষিত হয়ে ভ্রান্ত রীতির প্রচলন ঘটেছে। ইসলাম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখনে না-এমন মুসলমানরা বিভ্রান্ত হয়ে আশূরাকে শোকের দিন জ্ঞান করে পালনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেছেন বলা চলে।  বিভিন্ন যুগে সাহিত্য, কবিতায় কারবালার ঘটনার সাথে অনেক বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী যুক্ত করে ঘটনাটিকে মুসলমানদের কাছে খুবই হৃদয়স্পর্শী হিসেবে চিত্রায়িত করে তোলার প্রবণতাও লক্ষ্যনীয়। এটিও আশূরা নিয়ে বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ। 

ইসলামের ইতিহাসে কারবালার ঘটনা ছাড়া আরো অনেক বিয়োগান্তক, নিষ্ঠুর জঘন্য ঘটনা ঘটেছে। রাসূল (সা.)এর সময় উহুদের ময়দানে আমীর হামজা (রাযি.) কে নির্মমভাবে হত্যা, রাসূল (সা.) এর তিরোধানের পর হযরত ওমর (রাযি.), হযরত ওসমান (রাযি.), হযরত আলী (রাযি.) এর শাহাদাতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার স্মরণে শোক পালনের কোন প্রচলন ইসলামে নেই। একই ধারাবাহিকতায় কারবালার ঘটনা স্মরনে আলাদা মর্যাদা দিয়ে দিবস পালনেরও কোন সুযোগ নেই বলেই বিশেষজ্ঞ আলেমগণ বলছেন।

যদি বলা হয়, ঘটনার স্মরণ ও শিক্ষার জন্যই আশূরার দিনকে কারবালা দিবস হিসেব পালন করা হয়; সেক্ষেত্রেও এভাবে শোকের মাতম তুলে, নিজের শরীরকে রক্তাক্ত করে ইমা হুসাইনের বা তার বাহনের প্রতীক প্রদর্শন করে শোক পালন ইসলাম সমর্থিত নয়। বরং সম্পূর্ণরূপে শরীয়ত বিরোধী, নতুন আবিস্কার বা বেদআত হিসাবে আখ্যায়িত করছেন আলেমগণ।

কারবালার ঘটনার আলোচনা, ঘটনার বিশ্লেষণ, ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য উৎসাহিত করা এবং কারবালার শহীদদের জন্য দোয়া করা যেতে পারে। সেটা  অবশ্যই শরীয়তের কোন অংশ মনে করে কিংবা দিবস ঠিক করে নয়। কারণ এমন কোন দিবস পালনের সমর্থন ইসলামে পাওয়া যায় না।

তথ্য প্রযুক্তি তথা জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির এই যুগে মানুষের মধ্যে প্রকৃত বিষয় জানার আগ্রহ যেমন বাড়ছে তেমনি জানাটা অনেক সহজও হয়ে গিয়েছে। আজকে পত্র-পত্রিকা, অনলাইনের প্রখ্যাত আলেমদের প্রবন্ধ, নিবন্ধ, অডিও, ভিডিও বক্তব্য থেকেও মানুষ আশূরার মতো বিষয়গুলোর ব্যাপারে কোরাআন- হাদীস তথা ইসলামের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গী জানতে পারছেন।

করোনা পরিস্থিতিতে এবার আশূরা পালিত হচ্ছে। বিশ্বময় করোনা মানুষের কর্মময় জীবনকে স্তব্দ করে রেখেছে। এ সময়ে মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি ঈমান ও আমলের উন্নতির দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে। পড়াশুনা, কোন বিষয় নিয়ে গভীরভাবে অধ্যয়নের যথেষ্ট সুযোগ হাতে রয়েছে গৃহবন্দী মানুষের। অনেকে তার সদ্ব্যবহার করছেনও।

এই অবস্থায় এবারের আশূরায় সবাই আশূরার প্রকৃত ইতিহাস জানার চেষ্টা করতে পারেন। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রচলিত ভ্রান্ত বিশ্বাস, বিভ্রান্তি সংশোধন করে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী দিনটি পালনে সচেষ্ট হতে পারেন।

– ফয়েজ উল্লাহ ভূঁইয়া, সাংবাদিক ও সমাজ চিন্তক।

উম্মাহ২৪ডটকম:এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।