Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ছোট জীবন, কম সময়, কাজ অনেক

ছোট জীবন, কম সময়, কাজ অনেক

।। মুফতী মনির হোসাইন কাসেমী ।।

মানুষের জীবনকে সুখময় করার জন্য দয়াময় আল্লাহ তাআলা স্থানের ন্যায় সময়েও বৈচিত্র্য রেখেছেন। তিনি পবিত্র কালামে পাকে ইরশাদ করেন- বলুন, ভেবে দেখ তো, আল্লাহ যদি রাতকে ক্বিয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, তবে আল্লাহ ব্যতীত এমন উপাস্য কে আছে, যে তোমাদেরকে আলোক দান করবে? তোমরা কি তবুও কর্ণপাত করবে না? বলুন, ভেবে দেখ তো, আল্লাহ যদি দিনকে ক্বিয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, তবে আল্লাহ ব্যতীত এমন উপাস্য কে আছে, সে তোমাদেরকে রাত দান করতে পারে? যাতে তোমরা বিশ্রাম করবে। তোমরা কি তবুও ভেবে দেখবে না? তিনিই স্বীয় রহমতে তোমাদের জন্য রাত ও দিন করেছেন, যাতে তোমরা তাতে বিশ্রাম গ্রহণ কর ও তাঁর অনুগ্রহ অন্বেষণ কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সূরা ক্বাসাস- ৭১-৭৩)।

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা এটি দিবাকরের ন্যায় প্রমাণিত হল যে, এই সময়ের পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য মানুষের জীবনকে সুখময় করতে সৃষ্টি করেছেন মহান আল্লাহ তাআলা। সুতরাং সময় একটি নিয়ামত, এই নিয়ামতের কদর ও সদ্ব্যবহার করা আমাদের কর্তব্য। আর এই সময়ের সদ্ব্যবহার করতে হলে কিছু নিয়মনীতি জানতে ও মানতে হবে। কেননা, কোন কাজ যদি নিয়ম মাফিক না হয়, তাহলে সহজ সাধ্য কাজও কঠিন হয়ে যায়। বৈধ কর্মটিও অবৈধ হয়ে যায়।

এ বিষয়ে আল্লামা শেখ সা’দী (রাহ.) বলেন, ‘না বর হুকমে শরায়া আব খোরদান খাতাস্ত, ওয়াগার খুন বফাত্ওয়া বরিযী রওয়াঁস্ত’। অর্থাৎ- শরীয়তের নির্দেশ ছাড়া পানি পান করা নিষিদ্ধ। অথচ শরীয়তের বিধান মাফিক কাউকে হত্যা করাও বৈধ।

কাজেই বক্ষমান প্রবন্ধে সময়ের সদ্ব্যবহারের নিয়ম-নীতি নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাব, ইন্শাআল্লাহ।

সময় আল্লাহ তাআলার এমন এক ব্যাপক নিয়ামত, যা ধনী-দরিদ্র, জ্ঞানী-মূর্খ ও ছোট-বড় সবাই সমানভাবে লাভ করে থাকে। সময় তার আপন গতিতে চলমান। আর তাই তো ভবিষ্যত হয়ে যায় বর্তমান আর বর্তমান হয়ে যায় অতীত। অত্যন্ত দ্রুতবেগে চলে এ ধারা। কিন্তু আফসোস! সময় ঘোড়ার আরোহী বনি আদম যেন তা টেরই পায় না। অথচ সময়ের এ গতিবেগ রোধ করা কিংবা স্তিমিত করার কোন উপায়ই নেই মানুষের হাতে। মানুষকে অত্যন্ত সীমিত সময় দেওয়া হয়েছে। হায়! মানুষের জীবন তো কতগুলো মুহূর্তের সংকলন মাত্র। এটি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। এ সময়ে সে যে বীজ বপন করবে, পরবর্তীতে তারই ফসল ঘরে তুলবে। এই সময় কালের মধ্যে আমাদের অনেক কিছু করা প্রয়োজন। সুতরাং আমাদের একটি মুহূর্তও বৃথা নষ্ট করা উচিত নয়। সময় ক্ষণস্থায়ী, কেউ একে ধরে রাখতে পারে না। অপচয়কৃত সময় কখনো ফিরে আসে না। সময় আমাদের নিকট এমনভাবে আসে, যেন একজন বন্ধু তার পোশাক পরিবর্তন করে অনেক মূল্যবান উপহারাদি নিয়ে নীরবে আগমন করে। আমরা যদি সে সব উপহার না নিই, তাহলে সে নিজের আনা উপহারসমূহ নিয়ে আবার নীরবে চলে যায়। পুনরায় আর কখনো ফিরে আসে না।

আরও পড়তে পারেন-

সময় টাকার চেয়ে অনেক মূল্যবান। হারানো অর্থ-সম্পদ কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে পাওয়া যায়। তেমনি হারানো জ্ঞান পড়াশোনা করে পাওয়া যেতে পারে। হারানো স্বাস্থ্য সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু হারানো সময় হাজারো চেষ্টা করেও পুনরায় লাভ করা যায় না। সময় নষ্ট করা আত্মহত্যার শামিল। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, আত্মহত্যা চিরকালের জন্য জীবন থেকে বঞ্চিত করে দেয়। আর সময় নষ্ট করলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জীবিত ব্যক্তি মৃত হয়ে যায়। সময়ের দৃষ্টান্ত প্রখর রোদের মধ্যে রাখা বরফ খণ্ডের মত, যা কাজে না লাগালেও গলে যাবেই। ইমাম শাফিঈ (রাহ.)এর মতে সময় হল, তলোয়ারের মত। হয় তুমি তাকে কাটবে। নইলে তা তোমাকে কাটবে। সময় তো হল, কাঁচা মসলার মত। এ থেকে আপনি যা ইচ্ছা তৈরী করতে পারবেন। প্রবাদ আছে- ‘সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।’ সময়ের উপযুক্ত ব্যবহার কৃতকার্যের চাবিকাঠি। প্রচুর আমোদ-প্রমোদে সময় অপচয় জীবনের কিছু মুহূর্ত হত্যার শামিল।

ইমাম আবু দাঊদ (রাহ.) বলেন, আমি আমার এই সুনান গ্রন্থটিকে পাঁচ লাখ হাদীস থেকে বাছাই করে রচনা করেছি। উল্লেখ্য, এ কিতাবে চার হাজার আটশ’ হাদীস রয়েছে। অতঃপর তিনি তার কিতাব থেকে ইসলামী জীবন বিধানের সার্বজনীনতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার নমুনা হিসেবে চারটি হাদীস বাছাই করে পেশ করেছেন। একটি হল, ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হচ্ছে ব্যক্তির অনর্থক কাজ পরিহার করা।

ইমাম বুখারী (রাহ.) ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়ে এবং ইমাম তিরমিযী (রাহ.) ‘যুহদ’ অধ্যায়ে একটি হাদীস সংকলন করেছেন, যাতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- “দু’টি নিয়ামত দ্বারা যথাযথ উপকৃত হতে অনেক মানুষই ব্যর্থ হয়- সুস্থতা ও অবসর।” সুস্থতার মূল্য তখনই বোঝা যায় যখন অসুস্থতার কষ্ট পোহাতে হয়, আর অবসরের মূল্য তারাই ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারে যারা এক মুহূর্ত অবসর পায় না।

সুতরাং সময় থাকতে সময়ের মূল্যায়ন করাই হবে জ্ঞানীর পরিচয়। মহান আল্লাহ মানুষকে সময়ের মূল্য বোঝাতে গিয়ে কুরআন শরীফের বিভিন্ন স্থানে রাতদিন ও কালের শপথ করার সাথে সাথে বিভিন্ন সময়ের শপথ করেছেন। কোথাও প্রভাতের, কোথাও চাশ্তের সময়ের, আবার কোথাও আসরের সময়ের শপথ করেছেন। এসব শপথের অন্যতম উদ্দেশ্য হল, মানুষকে ডেকে ডেকে সময় ও প্রিয় জীবনের প্রবাহমান ধারা থেকে উপকৃত হওয়া এবং প্রতিটি মুহূর্তকে মেপে মেপে ব্যয় করার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা।

আম্বিয়ায়ে কিরামও উপদেশ দিয়েছেন যে, সময়ের ব্যাপারে সাবধান থাকবে। সময় নষ্ট করবে না। সময় অযথা কাজে ব্যয় করবে না। তোমাদেরকে প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব দিতে হবে। ইতিহাসও আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয়। শত শত বছরের অভিজ্ঞতাও আমাদেরকে বলে দেয় যে, পৃথিবীতে যে পরিমাণ সফল ও সার্থক ব্যক্তিত্ব অতিবাহিত হয়েছেন, তাদের সাফল্য ও খ্যাতির পিছনে বিরাট ভূমিকা ছিল সময়ের মূল্যায়ণ এবং তার সঠিক ব্যবহার। সময় এমন এক ভূমি, যাতে পূর্ণ প্রচেষ্টা ব্যয় করলে তা থেকে অবশ্যই ফল পাওয়া যায়। আর ফেলে রাখলে তাতে আগাছা জন্মায়। সূফিয়ায়ে কিরাম বলেন, সময় হল কর্তনকারী তলোয়ার। দার্শনিকরা বলেন, সময় চলমান। তা কখনো থেমে থাকে না। সময় হল, চলমান ঘটনাবলীর নদী। এর স্রোত অতি তীব্র। এতে কোন কিছু পড়লেই তাকে সে তার স্রোতের সাথে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অতঃপর অন্য কিছু তার স্থান দখল করে নেয়।

মোট কথা, সময় এমন একটি মূলধন, যা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সকল মানুষকে সমানভাবে দান করা হয়েছে। যারা এ মূলধন যথানিয়মে উপযুক্ত ক্ষেত্রে কাজে লাগায়, তারাই শারীরিক শান্তি ও মানসিক আনন্দ লাভ করে। সময়ের সদ্ব্যবহারের ফলে একজন অশিক্ষিত লোক সভ্য-ভদ্র হয়ে যায়, আর ভদ্রলোক হয়ে যায় ফেরেশ্তা চরিত্রের অধিকারী। এরই বদৌলতে মূর্খ হয় জ্ঞানী, দরিদ্র হয় ধনী, অজ্ঞ হয় শিক্ষিত। সময় এমন এক সম্পত্তি, যা বাদশাহ ও ফকীর, আমীর ও গরীব এবং শক্তিশালী ও দুর্বল সকলে সমানভাবে পায়। যারা সময় নষ্ট করে তারা বলে থাকে, এতটুকু সময়ে কিইবা করা যায়? কিন্তু তাদের স্মরণ রাখা উচিত, সময়কে যারা কাজে লাগিয়েছে, তারা এই স্বল্প সময়েই আবিস্কারক হয়েছে, দার্শনিক হয়েছে, বুযুর্গানে দ্বীন ও ওলীআল্লাহ হয়েছে।

পক্ষান্তরে যত নিঃস্ব-দরিদ্র ও অভাবী লোক দেখা যায়, এরা হল তারাই, যারা শৈশবে অযথা সময় নষ্ট করেছে। শৈশবের ভিত্তিমূলের একটি বাঁকা ইঁট তার গোটা জীবনের ইমারতকে বাঁকা করে দিয়েছে। অহেতুক সময় ব্যয় করার অর্থ একটি সতেজ লকলকে গাছের কয়েকটি ডাল কেটে ফেলা। অযথা কাজ থেকে প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে বাঁচিয়ে একজন সাধারণ মানুষও বিজ্ঞানের কোন একটি শাখা পুরো আয়ত্ত করতে পারে। প্রতিদিন এক ঘণ্টা ব্যয় করে একজন অজ্ঞ-মূর্খ লোকও দশ বছর পরে এক পর্যায়ে অভিজ্ঞ আলেম হতে পারে। প্রতিদিন এক ঘণ্টা ব্যয় করে একজন স্বাভাবিক মেধার ছাত্রও কোন বইয়ের গড়ে ২০ পৃষ্ঠা ভালভাবে বুঝে পাঠ করতে পারে। এভাবে সারা বছরে প্রায় সাত হাজার পৃষ্ঠা পাঠ করে ফেলতে পারে। প্রতিদিন মাত্র একটি ঘণ্টা ব্যয় করার ফলে একজন মানুষ তার পশুসুলভ জীবনকে পরিণত করতে পারে আনন্দময় কর্মক্ষম মানবিক জীবনে।

মোট কথা, আপনি আনন্দিত হন কিংবা চিন্তিত, দুঃখ ও দ্বিধা থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র পথ হল- আপনি কখনই অবসর থাকবেন না। মনে রাখবেন, মরীচিকা যেমন লোহাকে ক্ষয় করে, অলসতা তেমনি জীবনী শক্তিকে শেষ করে দেয়। জীবিত মানুষের জন্য বেকারত্ব হল কবরের জীবনের সমান। সময় হল, তুলার দলার মত। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার চরকায় ঘুরিয়ে তা থেকে মূল্যবান কাপড় তৈরী করলে কাজে লাগবে। নইলে মূর্খতার ঝড়ো হওয়া তাকে উড়িয়ে কোথায় না কোথায় নিয়ে ফেলে দিবে! ঠিকানা থাকবে না।  [আগামী কিস্তিতে সমাপ্য]

– মুফতী মনির হোসাইন কাসেমী, ফাযেলে- দারুল উলূম দেওবন্দ (দাওরা ও ইফতা), মুহাদ্দিস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা এবং যুগ্মমহাসচিব- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম:এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।