Home বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হারিয়ে যাওয়া ভাষার সন্ধান মিলল পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো সচল পাঠাগারে

হারিয়ে যাওয়া ভাষার সন্ধান মিলল পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো সচল পাঠাগারে

সিনাইয়ের সেইন্ট ক্যাথারিন আশ্রম। ছবি: বেনসোজিয়া ব্লগ।

মিশরের সিনাই পর্বতের নিচে অবস্থিত সেইন্ট ক্যাথারিন মনেস্টারি। খ্রিস্ট ধর্মের অন্যতম পবিত্র এ উপাসনালয়ে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো এবং সচল পাঠাগার। এখানে রক্ষিত আছে হাজার হাজার অমুল্য প্রাচীন পুঁথি, ঐতিহাসিক রেকর্ড আর ধর্মীয় উপদেশমালা। কিন্তু, তার চেয়েও বড় লুকানো সম্পদ আছে এসব প্রাচীন রেকর্ডে। 

সম্প্রতি ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইন্ডিপেনডেন্টের সাংবাদিক জেফ ফেরেল জানান, নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে একদল গবেষক শত শত বছর আগে আশ্রমটিতে বসবাসকারী সন্তদের পুরোনো লেখা মুছে তার উপর নতুন ভাষায় লেখার চলটি শনাক্ত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।  
এ পদ্ধতি শনাক্ত করতে পারে- সন্তদের লেখা পান্ডুলিপির মুছে দেওয়া বিলুপ্ত ভাষার বর্ণমালাকে, যার উপর নতুন ভাষা লেখা হয়েছে। 

অধিকাংশ প্রাচীন রেকর্ডগুলি রাখা হয়, লাতিন, গ্রিক এবং আরবির মতো বর্তমানে বহুল প্রচলিত ভাষায়। কিন্তু, কিছু পান্ডুলিপি এমনও ছিল- যা লেখা হয়েছে, বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া ভাষায়। পরবর্তীকালে এসব লেখা মুছেই নতুন করে লেখা হয় প্রচলিত ভাষাতে। গবেষকদের কাছে এগুলোই অমূল্য। কারণ, লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা হারিয়ে যাওয়ার ভাষার নথি বিশ্বে খুবই বিরল। 

পুরোনো লেখা মুছে তার উপর অন্য ভাষায় নতুন করে লেখাকে বলা হয় ‘পালিম্পসেস্টস’। সেইন্ট ক্যাথারিন আশ্রমে এমন ১৩০টি পালিম্পসেস্টস পুঁথি আছে, বলে জানিয়েছে গবেষণা দলের ওয়েবসাইট ‘আর্লি ম্যানুস্ক্রিপট ইলেকট্রনিক লাইব্রেরি।’ মুছে ফেলা আসল লেখার অনুসন্ধান করে তা সাইটটিতে প্রকাশ করছেন গবেষকরা ।  

আরও পড়তে পারেন-

গবেষক রিচার্ড গ্রে মার্কিন গণমাধ্যম দ্য আটলান্টিক’কে জানান, ইসলাম অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সিনাই মরুভূমিতে খ্রিস্ট ধর্মের আশ্রমগুলো হারিয়ে যেতে থাকে। ওই সময়ের এ পরিবর্তনে প্রায় বিচ্ছিন্ন এক ধর্মীয় চর্চাকেন্দ্রে পরিণত হয় সেইন্ট ক্যাথারিন আশ্রম। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ না থাকায়, তখন লিখিত রেকর্ড রাখতে বাধ্য হয়েই প্রাচীন পান্ডুলিপির কাগজ আবার ব্যবহারে বাধ্য হন সন্যাসীরা। 

পালিম্পসেস্টস লেখার রহস্য অনুসন্ধানে গবেষকরা হাজার হাজার পাতা পুরোনো পান্ডুলিপির ছবি অসংখ্যবার তুলেছেন। প্রতিটি পাতার ভিন্ন ভিন্ন ছবি তোলা হয়েছে তা নানা রঙের আলোর সাহায্যে। কখনো কখনো পাতার পেছনেও ভিন্ন ভিন্ন রঙের বাতি জ্বালিয়ে ছবি তোলেন তারা। কৌণিক অবস্থান থেকেও ছবি তোলা হয়। এর ফলে কাগজের পৃষ্ঠতলের প্রতিটি রেখা এবং ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 

গ্রে জানান, এরপর তারা ওইসব তথ্যকে কম্পিউটার অ্যালগরিদমের সাহায্যে বিশ্লেষণ করেছেন। এতে করে, একই নথির সাম্প্রতিকতম লেখা আর প্রাচীনতম লেখাকে আলাদা আলাদা শনাক্ত করা গেছে।  

২০১১ সাল থেকে এপর্যন্ত ৭৪টি পালিম্পসেস্টস পান্ডুলিপির ছবি তুলেছেন গবেষক দলটির সদস্যরা। যার মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা ৬,৮০০টি। গবেষক দলটির আবিস্কারগুলোও আশ্চর্য্যকর। চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর সময়ে লেখা ১০৮টি পাতায় পাওয়া গেছে, গ্রিক ভাষায়; যার মধ্যে ছিল প্রাচীন কিছু কবিতা এবং চিকিৎসা শাস্ত্রের আদিজনক খ্যাত বিখ্যাত গ্রিক চিকিৎসক হিপ্পোক্রাতিসের বর্ণিত কিছু রন্ধন প্রণালী।    

আরও আছে বহু শতাব্দী আগে হারিয়ে যাওয়া দুর্বোধ্য ভাষার সন্ধান। দুটি মুছে ফেলা লেখা ছিল ককেশিয় আলবেনিয়ান ভাষায়। সেসময় বর্তমান আজারবাইজানে বসবাসকারী কিছু খ্রিস্টান এ ভাষায় কথা বলতেন। 

প্রাচীন ভাষা ও নিদর্শন সম্পর্কিত সাইট ‘অ্যাটলাস অবসকিউরা’র বিশেষজ্ঞ সারাহ লাস্কাউ জানান, বর্তমানে শুধুমাত্র কিছু প্রস্তুরফলকেই ককেশিয় আলবেনিয়ান ভাষার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। অর্থাৎ, জনসাধারণের ব্যবহার থেকে ভাষাটি হারিয়ে গেছে। এমন ভাষাকে মৃত বলেই অবহিত করা হয়। 

আর্লি ম্যানুস্ক্রিপটস ইলেকট্রনিক লাইব্রেরি’র পরিচালক মাইকেল ফেলপস বলেন, ‘সেইন্ট ক্যাথারিনে পাওয়া পান্ডুলিপি আমাদের বিশেষজ্ঞ দলের ককেশিয় আলবেনিয়ান ভাষার জ্ঞান বাড়িয়েছে, আরও সমৃদ্ধ করেছে ভাষাটির শব্দভান্ডার নিয়ে আমাদের জানাশোনা।

পান্ডুলিপির অন্যান্য গোপন ভাষার মধ্যে অন্যতম প্রাচীন ক্রিশ্চিয়ান ফিলিস্তিনি অ্যারামিক নামের একটি ভাষা। সিরিক এবং গ্রিক ভাষার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এ ভাষা ১৩ শতাব্দী পর্যন্ত লোকমুখে প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে ১৮ শতকে ফের এ ভাষার সন্ধান পান ভাষা বিজ্ঞানীরা।   

ফেলপস জানান, ”এ ভাষার কথা বলা জনগোষ্ঠীর নিজস্ব শিল্প, সাহিত্য আর আধ্যাত্মিকতার এক বিশাল জগৎ ছিল। তার প্রায় সবই হারিয়ে গেছে ইতিহাসের পাতা থেকে। এ সম্পর্কে জানা খুবি জরুরি, কারণ তাদের সংস্কৃতির অনেক বৈশিষ্ট্য আজ আমরা পালন করছি। প্রাচীন এসব পালিম্পসেস্টস হারিয়ে যাওয়া সেই অতীতকে যেন কণ্ঠস্বর ফিরিয়ে দিয়েছে। অধুনা সভ্যতায় এ জাতির মানুষের সাংস্কৃতিক যোগ সম্পর্কে আমরা নতুন অনেক কিছুই এখন জানতে পারছি।” 

সিনাই উপত্যকায় ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের তৎপরতা বাড়ায় সম্প্রতি পালিম্পসেস্টস নিয়ে গবেষণা আরও গুরুত্ব পাচ্ছে। সন্ত্রাসীদের হাতে ধবংসের আগেই প্রাচীন জ্ঞান বিশ্লেষণ করতে চান বিজ্ঞানীরা। তবে বিশ্ব মহামারি এবং জঙ্গিদের কারণে সেইন্ট ক্যাথারিন আশ্রমে যাওয়া গবেষকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। তাই ফেলপস এবং তার টিম এখন অনলাইনে থাকা পালিম্পসেস্টস- এর ছবি থেকেই তাদের অনুসন্ধানের কাজ চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। সূত্র- টিবিএস।

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।