Home সম্পাদকীয় কোথা সে মুসলমান!

কোথা সে মুসলমান!

।। মুনির আহমদ ।।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-

আল্লাতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান
কোথা সে আরিফ অভেদ যাহার জীবন মৃত্যু জ্ঞান।।

(যাঁর) মুখে শুনি তৌহিদের কালাম —
ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম।
যাঁর দীন দীন রবে কাঁপিত দুনিয়া জীন পরি ইনসান্‌।।

স্ত্রী পুত্রে আল্লারে সঁপি জেহাদে যে নির্ভীক।
হেসে কোরবানি দিত প্রাণ হায় আজ তারা মাগে ভিখ্‌।
কোথা সে শিক্ষা আল্লাহ্‌ ছাড়া,
ত্রিভুবনে ভয় করিত না যাঁরা।
আজাদ করিতে এসেছিল যাঁরা সাথে লয়ে কোর্‌আন্‌।।

কবি নজরুল ইসলামের জীবন-যাপন প্রণালী যেমনই থাক না কেন, তিনি ইসলামের ঐতিহ্য এবং মুসলমানদের পরবর্তী দুর্দশার প্রতি সচেতন ছিলেন নিঃসন্দেহে। তাই তিনি তাঁর বহু কবিতা এবং সংগীতে ইসলামী ঐতিহ্যের রূপরেখা তুলে ধরেছেন। ব্যথিত হৃদয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুসলমানদের অধোগতি দেখে। যদিও তিনি নিজেও ছিলেন একই সমতলে। কবিরা হয় তো সবাই না হোক, কেউ কেউ কখনো কখনো হক কথা বলে থাকেন।

যেমন মহাকবি ইকবাল বর্তমান বিশ্বের মুসলমানদের আদর্শহীনতা ও বিপথগামিতার কথা তুলে ধরতে লিখেছেন-

‘ইসলামের আদর্শ সবে ছেড়ে দিয়েছে
বে-দ্বীনের আদর্শ ধরেছে মজবুত করে,
মুসলমানী ছেড়ে সেজেছে ভদ্র
ইসলামী শিক্ষা ছেড়ে শিখেছে কুশিক্ষা’।

মহাকবি ইকবাল যা বলেছেন, তা যথার্থই। আর, এই কারণগুলোর জন্যই তো মুসলমানদের আজ এতো অধোগতি। কবিরা হয় তো দৃষ্টান্ত স্থাপনের চাইতে উপদেশ প্রদানে অধিক আগ্রহী। তা যাই হোক, মুসলমানরা যে ইসলাম থেকে ক্রমে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে, তা সত্যি।

আজ আমরা আমাদের জীবনাচারে পাশ্চাত্যের ইহুদী-নাসারাদের অনুকরণ এবং অনুসরণ করে চলছি। আমরা মুশরিকদের আচরণেও অভ্যস্ত হচ্ছি। ইসলামের মধ্যে আমরা দেখছি, মধ্যযুগীয় বর্বরতা, অনুদারতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মান্ধতা। তাই আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আওড়ে চলি। মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব এ জন্যই যে, মানুষের ধর্ম আছে। ধর্মের জন্য মানুষ না হলেও, মানুষের জন্য তো ধর্ম। সেই মানুষ যদি হয় ধর্মনিরপেক্ষ, তাহলে ধর্মটা আর থাকলো কোথায়? আর ধর্মই যদি না থাকে মানুষের, তাহলে মানুষে-পশুতে তফাৎটা কি?

ইসলামের ইতিহাস যারা অধ্যয়ন করেছেন, তারা জানেন, প্রাক ইসলামী যুগে আরব-দেশে মধ্যযুগীয় বর্বরতা, অনুদারতা, নিষ্ঠুরতা, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, অনাচার-অবিচার-ব্যভিচার সবই ছিল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের পর সেখানে একটি সুশৃংখল শান্তিময় ধর্ম, জাতি এবং রাষ্ট্রের পত্তন হলো। “হযরত মুহাম্মদ (সা.) ওয়াজ দি থ্রি ফোল্ড ফাউন্ডার অফ্ এ রিলিজন, এ নেশন এ্যান্ড এ স্টেটস্”।

উক্তিটি যথার্থ। সেই ইসলাম কঠোর ছিল কিন্তু নির্দয় ছিল না। সেই ইসলামে ইনসাফ ছিল, কিন্তু অনুদারতা, সাম্প্রদায়িকতার সংঘাত ছিল না। সেই মুসলমান শান্তির দূত ছিল, ঈমানাদার ছিল। কিন্তু ধর্মান্ধ, অত্যাচারী, ব্যভিচারী ছিল না। ইতিহাসই তার সাক্ষ্যবহন করে। আমরা জগতের সকল ব্যাপারে ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য নসীহত করি। কিন্তু এ ব্যাপারে কেন ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণ করি না? কেন বলি- ‘ধর্মরাষ্ট্র একটি অবাস্তব ইয়োটোপিয়া কলুরাজ্য’? কেন আমরা ধর্মান্ধতার দোহাই দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ হতে চাচ্ছি? জানি, এসব প্রশ্নের উত্তর থাকলেও তা অতিশয় বিতর্কিত ও ভিত্তিহীন হতে বাধ্য। আমরা যে ইসলামের নিন্দা করি- আমরা ক’জন খাঁটি মুসলমান আছি? আমরা যে ইসলামে দোষ খুঁজি- ইসলামের বাইরে কি কি গুণ দেখেছি?

আমাদের দেশসহ প্রায় সকল দেশের মুসলমানই আজ খাঁটি মুসলমান থাকতে পারছে না। তারা অধিকাংশেই পাশ্চাত্যের অনৈসলামিক শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং সভ্যতার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। তারা মুশরিকদের আচার-আচরণ অনুসরণ করে চলছে। তাতেই তারা নিজেদেরকে ভাবছে গর্বিত, আলোকিত, প্রগতিশীল, আধুনিক। এদের মধ্যে ইসলামের শিক্ষা, আদর্শ, আচরণ অনুপস্থিত প্রায়ক্ষেত্রেই। প্রকারান্তরে এরা নিষিদ্ধ গোরপূজা-পুতুল পূজা এবং অন্যসব অনৈসলামিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হচ্ছে।

ইসলাম চায় মুসলমানদের জন্য অর্থবহ ইসলামী নামকরণ। কিন্তু আধুনিক সভ্য মুসলমান ছেলেমেয়েদের নাম রাখছে- জর্জ, রিপন, রবিন, শুভ্র, রুদ্র, দীপক, মালতী, বিশাখা, বিনতা, প্রিয়াংকা, লিলি, লিজা ইত্যাদি। এদের কিন্তু নাম দিয়ে মুসলমান পরিচয় করা যায় না। এরা আল্লাহ্ এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ মানেনি। হাশরে পিতার নামের সংগে এদের নাম ডাকবার উপায় তো দেখছি না।

ইসলাম বলে, ‘লজ্জা ঈমানের অংগ’। আর, আধুনিক মুসলমান নর-নারী পোষাক-পরিচ্ছদে, কথায়, গানে, আমোদ-ফূর্তিতে নির্লজ্জ। আধুনিকা নারীরা ফরয পর্দা তো মানেই না, বরং শাড়ী পরে নাভীর নীচে, উদরের কিয়দাংশ অনাবৃত রেখে। শরীরের একটি স্পর্শকাতর গোপনাংগ; যা পুরুষকে কামনাকাতর করে তোলে, তা তারা প্রদর্শন করে বেড়ায়। এটা শুধু লজ্জাহীনতাই নয় বরং তা যিনার মতো মহাপাপকে সংঘটিত করে। অথচ নারীর সর্বাঙ্গই ইসলামী বিধান মতে ‘সতর’ (আবৃত রাখা আবশ্যক)।

আবার পুরুষ-নারী একই সংগে চলাফেরা, নাচ-গান, ঠাট্টা-তামাশা, অভিনয়, ধস্তাধস্তি কোনটা না করে? ফলতঃ ব্যভিচার এবং ধর্ষণ এড়ানোর উপায় থাকে না। এখন তো শুনি ভার্সিটির শিক্ষক নিজ ছাত্রীর শ্লীলতাহানী করছে। ছাত্ররা ছাত্রীদের ওড়না টেনেই শুধু রেহাই দিচ্ছে না, মওকা পেয়ে ধর্ষণও করছে। বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা পত্র-পত্রিকার বদৌলতে কে না জানে?

ইসলাম নারীর জন্যও শিক্ষা ফরয করেছে বটে, তবে “কো-এডুকেশন” সমর্থন করে না। অথচ আজ দৈনন্দিন এমনই হচ্ছে- ‘পুরুষ আছে যেখানে আমরা আছি সেখানে’ আর কি! নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, নারীর অসম্মান, ব্যভিচার বাড়ছে বৈ কমছে না তো। ইসলামের বিধান রয়েছে- ‘নিজ নিজ গোপনাঙ্গ হিফাযত করো।’ কিন্তু আধুনিকতায়, প্রগতিশীলতায়, উদারতায়, ধর্মনিরপেক্ষতায় তা হচ্ছে না বা হতে দেওয়া হচ্ছে না। বরং আজকালকার রংবাজ যুবারা দেশময় যাচ্ছে তাই করে বেড়াচ্ছে। বড় বড় গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকারাও বসে নেই। তারাও চুটিয়ে লিভিং টুগেদার করে নিজের স্বামীকে ত্যাজ্য করে আরেকজনকে কাছে আনছে। পতিতাবৃত্তির চাইতে এসব কি আর ভালো কিছু? তবে ইসলামী জীবনাচার প্রগতিবাদীদের কাছে কেন নিন্দনীয়? ইসলাম পৈশাচার সমর্থন করে না বলেই কি তার প্রতি এত অনীহা?

বিবাহ একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এটা হবে ধর্মীয় বিধান মতে। বিবাহের পূর্বে নারী-পুরুষের পরস্পরের উপর কোন অধিকার বর্তায় না। অথচ বর্তমান সভ্য সমাজে পাশ্চাত্য রীতিতে ‘ডেটিং সিস্টেম’ চলছে কোথাও কোথাও অবাধে। ডেটিং মানে তো বিবাহপূর্ব মেলামেশা, যা ইসলামে ব্যভিচার বলে আখ্যায়িত। গায়ে হলুদ, বরণকুলা এসব তো হিন্দুয়ানী। আর ভিন্নধর্মের পাত্র-পাত্রীর কোর্টম্যারেজ তো ইসলামে একদম নাজায়েয। কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন- “তোমরা মুশরিক রমণীদেরকে বিবাহ করো না…. মুশরিক পুরুষদের সংগে কন্যার বিবাহ দিয়ো না”। অথচ এখন তা প্রায় সামাজিক প্রথা হিসেবে গণ্য হতে যাচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করছে না। আমরা আছি ধর্মনিরপেক্ষতার তালে।

এই যে মাঝে মাঝে দেশে যে বোমাবাজি হয়ে থাকে অথবা নিত্য যে সন্ত্রাস চলছে- এটা অত্যন্ত ঘৃণ্য, দেশবিরোধী ও দুঃখজনক ঘটনা। যারাই এর সংগে জড়িত থাকুক, তারা ধার্মিক হোক আর নাস্তিক হোক, তারা অপরাধী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক হলেও যা, মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র হলেও তাই। এদের কঠোর শাস্তি পাওয়া উচিত। এটা প্রতিটি দেশপ্রেমিক ও দ্বীনদার মুসলমানেরই কথা। কিন্তু দ্বীন ও সমাজ বিচ্ছিন্ন গুটি কয়েক অপরাধীর কর্মকান্ডকে কেন্দ্র করে পুরো মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধের পাঁয়তারা যারা করে, যারা এসব দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ও উলামা-মাশায়েখের বিরুদ্ধে বিষোদগার ছড়ায়, তারা কেমন মুসলমান? সেই সংগে ইসলামী শিক্ষা এবং তাবলীগ জামাআতের দাওয়াতী কার্যক্রমের প্রতিই বা নাখোশ কেন তারা? তারা কি চায়- ধর্মচর্চা দেশ থেকে একদম উঠে যাক? মাদরাসায় দ্বীনের শিক্ষা দেওয়া হয়। আর, তাবলীগের লোকজনও দ্বীনের কথাই বলে থাকেন। এসবের প্রতি অনীহা কি ধর্মনিরপেক্ষতার খাতিরে? ধর্মপ্রাণ মুসলমান আল্লাহ্তেই রাখে পূর্ণ ঈমান। আর, তাদের জন্যই আল্লাহ্ তার দ্বীনের হিফাযত করবেন। #

লেখকঃ সম্পাদক- উম্মাহ ২৪ডটকম, সাবেক প্রেসসচিব- হেফাজত আমীর ও  নির্বাহী সম্পাদক- মাসিক মুঈনুল ইসলাম।