Home স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ফাইজারের ভ্যাকসিন সম্বন্ধে যে বিষয়গুলো জানা জরুরি

ফাইজারের ভ্যাকসিন সম্বন্ধে যে বিষয়গুলো জানা জরুরি

- প্রতিকী ছবি।

জার্মান সংস্থা বায়োএনটেক-এর সঙ্গে মিলে এমআরএনএ প্রযুক্তির সাহায্যে করোনা টিকা তৈরি করেছে মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা ফাইজার। তৃতীয় ধাপের অন্তর্বর্তী ট্রায়ালে ৯০ শতাংশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে তাদের এই করোনা টিকা। সোমবার এই তথ্য জানায় সংস্থাটি।  

সংস্থার চেয়ারম্যান অ্যালবার্টা বুর্লা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রতিদিন বাড়ছে সংক্রমণের হার। ভেঙে পড়ছে অর্থনৈতিক স্থিতি। মহামারির চরম পর্যায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা। এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের তৈরি ভ্যাকসিন নতুন একটা মাইল ফলক ছুঁল। এটা অবশ্যই বিজ্ঞান এবং মানবজাতির জন্য বিরাট সুখবর।” 

তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ব্রাজ়িল, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং তুরস্কে পরীক্ষা চালানো হয়। যাদের উপর পরীক্ষা চালানো হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ এবং অন্যান্য নানা সম্প্রদায়ের মানুষও। 

তবে তার মানে কিন্তু এই নয় যে এখনই এই ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে। আরও বেশ কয়েকটি কার্যধাপ পার হবার পর বাজারে আনার উপযুক্ত প্রমাণিত হলে তবেই এই ভ্যাকসিন বাজারে আসবে। এবং এর জন্য কয়েক মাসও লেগে যেতে পারে। 

আরও পড়তে পারেন-

তবে তার আগে ফাইজারের এই টিকা সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।

বিজ্ঞানীরা আসলে কি খুঁজে পেয়েছেন?

গত জুলাই মাসে  জার্মানির বায়োএনটেক আর ফাইজার টিকার ট্রায়াল শুরু করেন। ৪৪ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে অর্ধেকের শরীরে টিকা দেওয়া হয়। এরপর তাদের অসুস্থ হবার অপেক্ষা করেন বিজ্ঞানীরা, তারা দেখতে চাইছিলেন আদৌ এই ভ্যাকসিন কোন প্রতিরক্ষা দেয় কি না।  

পরবর্তীতে এই ৪৪ হাজারে মধ্যে ৯৪ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এই ৯৪ জনের মধ্যে কতজন ভ্যাকসিন পেয়েছিলেন সেই তথ্য বের করে দেখা গেল, ৯০ শতাংশের শরীরেই ভ্যাকসিন কাজ করছে। 

যেহেতু ভ্যাকসিনটি ৯০ শতাংশই কার্যকর, ফলে আমরা ধরে নিতে পারি যাদেরকে টিকা দেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে খুব কমই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

এই ফলাফল কি ভালো?

এই ফলাফল খুবই ভালো। কোন ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা অন্তত ৫০ শতাংশ হতে হবে- এমন মাত্রা ঠিক করে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। সেই হিসেবে বায়োএনটেক ও ফাইজারের প্রস্তুতকৃত এই টিকা অনেক এগিয়ে আছে।

এই ফলাফল যে ভালো তার প্রমাণ পাওয়া যাবে প্রচলিত অন্যান্য টিকার সঙ্গে একটা তুলনামূলক চিত্র দেখালে। সাধারণত ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য যে টিকা আমরা ব্যবহার করি তা সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ কার্যকর। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস কিছুদিন পর পরই নিজের ধরন পালটে ফেলতে পারে। তাই এর জন্য শতভাগ কার্যকর ভ্যাকসিন পাওয়া আসলে মুশকিল। 

মিজলস এর দুই ডোজ ভ্যাকসিন ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর। 

ফাইজারের এই ভ্যাকসিন কি নিরাপদ?

এখনও পর্যন্ত এই টিকা সম্পর্কে কোন বিপজ্জনক তথ্য খুঁজে পায়নি বায়োএনটেক ও ফাইজার, গত মে মাসে টিকার ক্ষতিকর দিক আছে কি না তা খুঁজে বের করতে একটি ক্লিনিকাল ট্রায়াল পরিচালনা করেছিল তারা। সে সময় টিকার ৪টি ধরণ নিয়ে পরীক্ষা করেন তারা। শেষ পর্যন্ত যেটাতে জ্বর, মাথা ব্যথার মতো মামুলি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সবচেয়ে কম দেখা গেছে সেটাই বেছে নেওয়া হয়েছে।   

এই ভ্যাকসিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ও সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অনুমোদন দিলেও এর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করবে এই দুই সংস্থা। টিকার ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদেরও আগামী ২ বছরের জন্য পর্যবেক্ষণ করা হবে।

কারা সবার আগে ভ্যাকসিনটি পাবে?

ফাইজারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই বছর শেষ হবার আগে ৩০ থেকে ৪০ মিলিয়ন ডোজ টিকা প্রস্তুত হবে। অর্থাৎ ১৫ থেকে ২০ মিলিয়ন মানুষকে একটি টিকা ও একটি বুস্টার দেওয়ার জন্য যা যথেষ্ট। 

কারা সবার আগে ভ্যাকসিনটি পাবে তা এখনও নিশ্চিত হয়নি। তবে যাদের করোনা আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বেশি যেমন- স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত কর্মী, বয়স্ক ব্যক্তি ও ডায়াবেটিস-প্রেশার এর মতো জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি- তাদেরকেই আগে প্রাধান্য দেওয়া হবে। 

সাধারণ মানুষের জন্য কখন সহজলভ্য হবে ভ্যাকসিনটি?

নভেম্বরের শেষ সপ্তাহেই জরুরি ভিত্তিতে ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেবে এফডিএ ও সিডিসি- এমনটাই আশা করছে ফাইজার।  তবে তার আগে গত ২ মাসের নিরাপত্তা সংক্রান্ত উপাত্ত উপস্থাপন করতে হবে তাদের কাছে। এরপর উতপাদনকারী সংস্থার বাইরে একটি পর্যবেক্ষক দল ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা, এটি নিরাপদ কি না এসমস্ত বিষয় পর্যবেক্ষণ করবেন। 

সবকিছু ঠিকঠাক মতো চললে এই বছরের শেষ নাগাদ বাজারে আসতে পারে ভ্যাকসিনটি।

বৃদ্ধ ও শিশুদের ক্ষেত্রে কি এই টিকা কাজ করবে?

বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে এই ভ্যাক্সিন কাজ করবে কি না সে ব্যাপারে এখনও কোন তথ্য ফাইজার বা বায়োএনটেক দেয় নি। বয়স্কদের শরীরে ভ্যাকসিন খুব ভালো কাজ করে না বলে এক গবেষণায় জানানো হলেও ক্লিনিকাল ট্রায়ালে ৬৫ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষের শরীরে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। এবং এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সে অনুযায়ী আশা করা যাচ্ছে যে বয়স্কদের ক্ষেত্রেও এটি কাজ করবে।

এবার প্রশ্ন থাকে শিশুদের ক্ষেত্রে এই ভ্যাকসিন কাজ করবে কি না। ফাইজার ও বায়োএনটেক তাদের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের  প্রাথমিক পর্যায়ে  ১৮ বছর বা এর বেশি বয়সীদের শরীরে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল পরিচালনা করেছে। তবে গত সেপ্টেম্বরে ১২ বছর বয়সের শিশুদেরও এই ট্রায়ালে অন্তর্ভুক্ত করেছে। তবে এখনও কোন উপাত্ত তাদের ক্ষেত্রে বের হয়ে আসেনি।

অন্যান্য কোম্পানির ভ্যাকসিনগুলোর কি হবে এখন?

এখনও আরও ১০টি ভ্যাকসিন বিভিন্ন পর্যায়ের ট্রায়াল পরিচালনা করছে। ফাইজার ও বায়োএনটেক এর এই সাফল্যতে আশাবাদী বিশেষজ্ঞরা। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আকিকো ইওয়াসাকি বলেন, ‘এই ফলাফল আরও আশাবাদী করে তুলেছে আমাদের। অন্যান্য ভ্যাকসিনগুলোও কার্যকর ও নিরাপদ হবে এমনটাই আশা আমাদের।’

ফাইজার ও বায়োএনটেক এর এই ভ্যাকসিন মূলত আরএনএ-ভিত্তিক প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি। ভ্যাকসিনটি শরীরে প্রবেশ করালে মানুষের শরীরের কোষ নিজে থেকেই ভাইরাল প্রোটিন তৈরি করবে। আমাদের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা এই প্রোটিন ব্যবহার করে ভাইরাস-রোধী অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এতে করে শরীরে করোনাভাইরাসটি প্রবেশ করা মাত্রই তাকে শনাক্ত করে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা দিতে কাজ করে। 

এই আরএনএ ভ্যাকসিন তোইরির কাজ করছে চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও থাইল্যান্ড। 

ফাইজার আর বায়োএনটেক এর ভ্যাকসিনের এই সাফল্য বাকিদের জন্য হৃদয় বিদারক বলে মনে হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, কেবল এই একটি কোম্পানির ভ্যাকসিন দিয়ে কিন্তু বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। এই সাফল্য শুধু একটি কোম্পানিরই নয়, বরং পুরো চিকিৎসা বিজ্ঞানের। তাই একে এক ছোট গন্ডি থেকে বিচার করা ঠিক হবে না।

  • সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।