Home ফিকহ ও মাসায়েল ডাক্তারদের জন্য ঔষধ কোম্পানীর গিফট ও কমিশন গ্রহণ করা কি হালাল?

ডাক্তারদের জন্য ঔষধ কোম্পানীর গিফট ও কমিশন গ্রহণ করা কি হালাল?

।। শায়খ আহমাদুল্লাহ ।।

আমাদের দেশে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ডাক্তারদেরকে বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানী নানা রকমের গিফট আইটেম দিয়ে থাকেন। অনেককে নগদ অর্থ দিয়ে থাকেন। আরো বিভিন্ন রকমের সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকেন। ডাক্তারদের জন্য ঔষধ কোম্পানীর এসব গিফট এবং সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করা; এটা ইসলামী শরিয়তে জায়েয আছে কিনা, আমরা সে বিষয়টি জানার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহু তায়ালা।

এ বিষয়ে আমরা দেখি তিনটি চিত্র আমাদের সামনে রয়েছে। ডাক্তারদেরকে অনেক সময় ঔষধ কোম্পানী তাদের প্রোডাক্টের পরিচিতির জন্য কোন ছোট এবং নগন্য গিফট ইত্যাদি দিয়ে থাকেন। যেমন- কলম দিলেন অথবা রাইটিং প্যাড দিলেন। সেগুলোতে কোন প্রোডাক্টের নাম এবং পরিচিতি এবং তার কার্যকারিতা ইত্যাদির উল্লেখ করা থাকল। এটা হলো এক ধরনের হাদিয়া।

আর দ্বিতীয় হলো, ডাক্তারদেরকে অনেক সময় অনেক মূল্যবান দামি কিছু গিফট দেওয়া হয়, অথবা অঘোষিত চুক্তির ভিত্তিতে টাকা-পয়সা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি দেওয়া হয়। যদিও লিখিত কোন চুক্তি থাকে না। কিন্তু এসব মূল্যবান গিফট, নগদ অর্থ এবং অন্যন্য ভালো সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পিছনে অন্তর্নিহিত কারণ থাকে যে, তিনি ঐ কোম্পানীর ঔষধ প্রেসক্রাইব করবেন। এ বিষয়ে লিখিত কোন চুক্তি থাকে না, কিন্তু অঘোষিত চুক্তির মাধ্যমে এ কাজটি হয়ে থাকে।

তৃতীয়ত: যে চিত্রটা আমরা সাধারণত: দেখি তা হলো, তাদেরকে অনেক সময় চুক্তির আওতায় আসতে হয়। অর্থাৎ- আপনি আমাদের প্রোডাক্টগুলোই শুধুমাত্র প্রেসক্রাইব করবেন বা আমাদের প্রোডাক্ট গুলোকে গুরুত্বের সাথে প্রেসক্রাইব করবেন, বা বেশি পরিমাণে প্রেসক্রাইব করবেন, অথবা এ পরিমানে প্রেসক্রাইব করবেন তার বিনিময়ে আপনাকে এটা এটা দেওয়া হবে।

উল্লিখিত এ তিনটি চিত্রের মধ্য থেকে প্রথম যে চিত্রটি আমরা দেখেছি অর্থাৎ ছোট-খাটো কোন গিফট, যেমন- কলম, রাইটিং প্যাড, ডায়েরী, মগ ইত্যাদি দেওয়া; যেটার উদ্দেশ্য থাকে কোম্পানীর প্রোডাক্টিকে পরিচিত করা এবং সেটাকে প্রচার করা। তো, এ ধরনের সামান্য ছোট-খাটো কোন হাদিয়া বা গিফট গ্রহণ করাতে কোন অসুবিধা নেই। কারণ, এ গিফটের মাধ্যমে চিকিৎসকের উপরে কোনরূপ প্রেসার ক্রিয়েট করার কোন সুযোগ নেই। বরং সেটা নিছক প্রচারণার মাধ্যমে অন্য দশজনকেও দেওয়া যেতে পারে। যেমন ডাক্তার সাহেবকে ঔষধ সম্পর্কে অবগত করা বা মনে রাখতে সাহায্য করা। এতে কোন অসুবিধা নেই।

আরও পড়তে পারেন-

আর, দ্বিতীয় ও তৃতীয় যে উপায়ের কথা বলা হয়েছে, যেমন- মূল্যবান হাদিয়া, নগদ অর্থ বা গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ-সুবিধা ডাক্তারদেরকে দেওয়া । এই দুই পর্যায়ের হাদিয়া বা গিফট সম্পর্কে বিশ্বের সমস্ত উলামায়ে-কেরামের গবেষণা অনুযায়ী, এটি গ্রহণ করা কোন চিকিৎসকের জন্য কোনভাবেই জায়েয নয়। এটাকে কেউ যদি উপহার হিসেবে দেখেন, তাহলে সেটা দৃশ্যত: উপহার হলেও কার্যত: সেটা ঘুষের পর্যায়ে পড়ে। কারণ, ডাক্তার যদি উক্ত কোম্পানীর স্বার্থ রক্ষা না করেন, তাদের ঔষধ নিয়মিত প্রেসক্রাইব না করেন, তাহলে সে ক্ষেত্রে মুল্যবান হাদিয়া এবং উপঢৌকন এবং গুরুত্বপূর্ণ কোন সুযোগ-সুবিধা কোন কোম্পানী এমনি এমনি দিবে না। সুতরাং এটা স্পষ্ট হল যে, ডাক্তারের প্রেসক্রাইবের ফলে কোম্পানী আর্থিক লাভবান হওয়াতে তার বিনিময়ে ডাক্তারকে কোম্পানী বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, উপহার ইত্যাদি দিচ্ছেন।

এখানে বাহ্যিকভাবে উপঢৌকন অথবা উপহার বা গিফট বলা হলেও এটা এক ধরনের ঘুষের সাদৃশ্য বিধায় এটাকে কোনভাবে গিফট হিসেবে আখ্যায়িত করা জায়েয বলার কোন সুযোগ নেই।

কেউ কেউ যুক্তি দিয়ে থাকেন যে, রোগীর জন্য সে ঔষধটি যদি ক্ষতিকর না হয় বরং তার জন্য এ ঔষধটি পারপেক্ট, সে ক্ষেত্রে ডাক্তার তো কোন ধরনের অন্যায় কাজ করেননি। তার জন্য গিফট নেওয়াটা কেন নিষিদ্ধ হবে?

এর উত্তর হলো যে, তিনি রোগীকে যখন সে ঔষধ লিখে দেওয়ার মধ্যে সে রোগীর কল্যাণ নিহিত আছে, তাহলে তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। কারণ, রোগী ডাক্তারের কাছে নির্দিষ্ট পরিমান ফি দিয়ে যখন হাজির হয়েছেন, তখন এ সময়টাতে রোগীর জন্য যেটা উপকারী সে নসিহত বা মুল্যবান উপদেশ দেওয়া বা পরামর্শ দেওয়া ডাক্তারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে গেছে।

সে দায়িত্ব পালন করে তিনি যদি আরেকজন থেকেও সুবিধা নেন, তাহলে সে ক্ষেত্রে এটা এক ধরনের অসততা, এটা এক ধরনের প্রতারণা। তিনি একদিকে রোগির কাছ থেকেও সুবিধা নিচ্ছেন, অন্যদিকে আরেকজনের কাছে অর্থের বিনিময়ে বরাদ্দ দেওয়া সময়ে ঔষধ কোম্পানী থেকেও সুবিধা আদায় করছেন। অনেকটা কোম্পানীর ঔষধ সেল করার দায়িত্বেও নিয়োজিত হলেন। তিনি যেন সেলসম্যান এর কাজও করছেন, অথচ রোগীর কাছ থেকে তিনি সেবার বিনিময়ে ফি নিয়ে রোগীর জন্য পরামর্শকের ভূমিকায়ও রয়েছেন।

তাহলে একজন লোক একই সঙ্গে একজনকে পরামর্শ দিচ্ছেন, আবার আরেকজনের সেলসম্যান হচ্ছেন অঘোষিত ভাবে। অর্থাৎ একসাথে বিক্রেতা ও ভোক্তার পরামর্শকের ভূমিকা পালন। এটা এক ধরনের প্রতারণা। আর দ্বিতীয়ত এখানে রোগী যখন নির্দিষ্ট পরিমানে ফি দিয়েছেন, এ সময়ের মধ্যে রোগীর জন্য সে কোম্পানীর সংশ্লিষ্ট ঔষধ বা প্রোডাক্ট যদি উপকারি হয় তাহলে সে পরামর্শ দিতে তো ডাক্তার এমনিতেই বাধ্য। চিকিৎসক হিসেবে তাকে এটা করতেই হবে। আর যদি তুলনামূলক অন্য ভাল ঔষধ থাকা সত্ত্বেও শুধু গিফট গ্রহণ করার কারণে সংশ্লিষ্ট ঔষধ কোম্পানীর প্রোডাক্ট প্রেসক্রাইব করেন ঐ কোম্পানীর স্বার্থ রক্ষার জন্য, তাহলে সেটা পরিষ্কার হারাম হবে। কারণ, রোগীর সাথে তিনি প্রতারণা করছেন, রোগীর ক্ষতি সাধন করছেন এবং তিনি আমানতের খেয়ানত করছেন।

তাছাড়া ডাক্তারগণ যদি সম্মিলিতভাবে এ ধরণের গিফট গ্রহণের রেওয়াজ প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে কোম্পানীসমূহের ঔষধের বাজারজাতকরণ খরচও কম হওয়ার কথা। তাতে ঔষধের দামও কিছু কমে যেতো। অর্থাৎ- ডাক্তারদের এসব মূল্যবান গিফটের ব্যয়ভারও পরোক্ষভাবে রোগির কাঁধে ওঠছে। এটা একজন ডাক্তারের অজানা থাকার কথা নয়। সুতরাং সব দিক থেকেই ডাক্তারদের জন্য এধরণের গিফট গ্রহণ রোগির স্বার্থ হানিকর এবং রোগির সাথে প্রতারণার শামিল।

এ ধরনের তথাকথিত গিফট এবং সুযোগ-সুবিধাগুলো একজন চিকিৎসককে সে কোম্পানীর প্রতি যে দুর্বল করে দেয়, এটা বলা বাহল্য। যে কারণে রোগীর স্বার্থ বেশিরভাগ কারণে প্রায় গৌণ হয়ে যায়। বরং অনেক সময় রোগির স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়, নষ্ট হয়। আর সেসব দিক বিবেচনা করে উলামায়ে কেরাম এ ধরণের গিফট গ্রহণকে পরিষ্কার নাজায়েয বলেছেন।

রাসূলে কারীম (সা.)এর একটি হাদিস যেটি বুখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সা.) একজন ব্যক্তিকে পাঠালেন রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বায়তুল মালের পক্ষ থেকে যাকাত কালেকশন করার জন্য। তিনি যাকাত এবং সাদকা কালেকশন করে নিয়ে আসার পর রাসূল (সা.)কে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি ডোনারের কাছ থেকে যে যাকাত বা সাদকা কালেকশন করে নিয়ে এসেছি, এর মধ্যে এই পরিমাণ সম্পদ দিয়েছেন বায়তুল মাল তথা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য, আর এটা আমাকে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে দিয়েছেন।

রাসূলে কারীম (সা.) তখন ঐ লোকটির এ আচারণ দেখে উপস্থিত লোকদেরকে জড়ো করে আল্লাহ তায়ালার প্রসংসা করে সংক্ষিপ্ত এক ভাষণ দিলেন পুরো পরিস্থিতির উপর। তিনি বললেন, তোমাদের কাউকে যখন কোন দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয়, তখন অন্য আরেক পক্ষের কাছ থেকে তিনি গিফট নিচ্ছেন। তিনি যদি এ দায়িত্বে নিয়োজিত না থাকতেন, তাহলে তাকে কে গিফট দিত? তিনি তার বাপের বাড়িতে বসে অবস্থান করতেন, অথবা তিনি যদি এই দায়িত্বে নিয়োজিত না থাকেন, তাহলে কি তাকে কেউ গিফট দিত?

এ হাদিসে রাসূলে কারীম (সা.) এ ধরনের গিফট নেওয়াকে নাজায়েয ও হারাম আখ্যায়িত করেছেন।

অন্য হাদিসের একটা পর্যায়ে এসে তিনি এটাও বলেছেন, এরকম কথিত গিফট যদি কেউ নেন, তাহলে কেয়ামতের ময়দানে তাকে সে গিফট কাঁধে নিয়ে উত্থিত হতে হবে।

সুতরাং একজন চিকিৎসক যখন নির্দিষ্ট ফি এর বিনিময়ে কোন রোগীকে সময় দিচ্ছেন, তাহলে এ সময়টাতে তিনি অন্য কারো কাছ থেকে হাদিয়া নেওয়া তথাকথিক উপঢৌকন নেওয়া, সুযোগ-সুবিধা নেওয়া; এটা তার জন্য জায়েয নয়। আর সে বিবেচনা থেকে ডাক্তার বা চিকিৎসকদের জন্য ঔষধ কোম্পানীর এ সমস্ত লোভনীয় উপহার বা অফারগুলো ফিরিয়ে দিতে হবে।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে হালাল কাজ করার তাওফীক দান করুক এবং সব ধরনের হারাম থেকে বেঁচে থাকতে ঈমানী শক্তি নসীব করুন। আমীন।

– শায়খ আহমাদুল্লাহ, চেয়ারম্যান- আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন।

অনুলিখনে- ইফতিখার আহমদ (আতিক)

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।