Home ইতিহাস ও জীবনী ‘ইনতাকিয়া’ নামের একটি শহরের ঘটনা

‘ইনতাকিয়া’ নামের একটি শহরের ঘটনা

- প্রতিকী ছবি।

।। তানজিনা রহমান ।।

এটি ইনতাকিয়া নামে একটি শহরের ঘটনা। সেখানকার রাজার নাম ছিল ইনতায়খাস। সেখানে রাজা, প্রজা সকলেই মূর্তিপূজক ছিল। প্রথমে আল্লাহ সুবহানাহুয়া তা’লা তাদের কাছে দু’জন নবী প্রেরণ করেন। তারা তাদেরকে অস্বীকার করলে তাঁদের শক্তি বাড়ানোর জন্য তৃতীয় একজন নবী আসেন। তাঁরা তিনজনই বলেন-

“আমরা আল্লাহর প্রেরিত, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমাদের মাধ্যমে তোমাদেরকে হুকুম করেছেন যে, তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারো ইবাদত করবে না।”

ঐ স্থানের লোকগুলো তাদেরকে বললো- “তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ। তাহলে এমন কি কারণ থাকতে পারে যে, তোমাদের কাছে আল্লাহর অহী আসবে আর আমাদের কাছে আসবে না? হ্যাঁ, তোমরা যদি রাসূল হতে তবে তোমরা ফেরেশতা হতে।”

অধিকাংশ কাফিরই নিজ নিজ যুগের রাসূলদের সামনে এই সন্দেহই পেশ করেছিল। আল্লাহ বলেন- “ওটা এ কারণে যে, তাদের কাছে তাদের রাসূলগণ দলীল প্রমাণসহ যখন আগমন করতো তখন তারা বলতো- মানুষ কি আমাদেরকে হিদায়াত করবে?” (৬৪:৬)।

এই কথা ঐ লোকগুলোও তিনজন নবীকে বলেছিল- “তোমরা আমাদের মতই মানুষ। আসলে আল্লাহ কিছুই অবতীর্ণ করেননি। তোমরা মিথ্যা কথা বলছো।”

নবীগণ উত্তরে বললেন- আল্লাহ্ খুব ভাল জানেন যে, আমরা তাঁর সত্য রাসূল। যদি আমরা মিথ্যাবাদী হতাম তবে আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই আমাদেরকে মিথ্যা বলার জন্য শাস্তি দিতেন!
কিন্তু তোমরা দেখতে পাবে যে, তিনি আমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং আমাদেরকে সম্মানিত করবেন। ঐ সময় তোমাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, পরিণাম হিসাবে কে ভাল!

নবীগণ আরও বললেন- স্পষ্টভাবে পৌঁছিয়ে দেয়াই শুধু আমাদের দায়িত্ব। মানলে তোমাদেরই লাভ, আর না মানলে তোমাদেরকেই এ জন্যে অনুতাপ করতে হবে। আমাদের কোন ক্ষতি নেই। একদিন নিশ্চয়ই তোমাদেরকে তোমাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হবে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.), হযরত কাবুল আহ্বার (রাযি.) এবং হযরত অহাব ইবনে মুনাব্বাহ্ (রা.) বর্ণনা করেন, ঐ গ্রামবাসীরা শেষ পর্যন্ত ঐ নবীদেরকে হত্যা করে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

আরও পড়তে পারেন-

সেই সময় নগর প্রান্ত থেকে এক লোক ছুটে আসলো। যে ঐ গ্রামেরই শেষ প্রান্তে বসবাস করতো। সে রেশমের কাজ করতো এবং কুষ্ঠরোগী ছিল। সে ছিল খুব দানশীল। সে যা উপার্জন করতো তার অর্ধেক আল্লাহর পথে দান করে দিতো। তার হৃদয় ছিল খুবই কোমল এবং স্বভাব ছিল খুবই উত্তম।

সে জনগণ থেকে আলাদা থাকতো। একটি গুহায় বসে আল্লাহর ইবাদত করতো। যখন সে তার কওমের ঘৃণ্য চক্রান্তের কথা জানতে পারলো, তখন সে আর ধৈর্য ধরে নিশ্চুপ থাকতে পারলো না। সে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে আসলো। কেউ কেউ বলেন যে, সে ছুতার ছিল। একটি উক্তি আছে যে, সে ছিল ধোপা। উমার ইবনে হাকাম (রাহ.) বলেন যে, সে জুতা সেলাই করতো। আল্লাহ তার প্রতি রহমত নাযিল করুন!

সে আল্লাহর রাসূলদেরকে অবিশ্বাস, প্রত্যাখ্যান ও অপমান করতে দেখে এসে তার কওমকে বুঝাতে লাগলো। সে তাদেরকে বললো- “তোমরা এই রাসূলদের অনুসরণ কর। তাঁদের কথা মেনে চল। তাদের পথে চল। দেখো, তারা নিজেদের উপকারের জন্যে কোন কাজ করছেন না। তারা যে তোমাদের কাছে আল্লাহ তা’আলার বাণী পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন, এ জন্যে তোমাদের কাছে তার কোন বিনিময় প্রার্থনা করছেন না। তারা যে তোমাদের মঙ্গল কামনা করছেন, এর কোন পুরস্কার তারা তোমাদের কাছে চাচ্ছেন না। আন্তরিকতার সাথে তারা তোমাদেরকে আল্লাহর একত্ববাদের দিকে আহ্বান করছেন। তোমাদেরকে তারা সঠিক ও সরল পথ প্রদর্শন করছেন। তারা নিজেরাও ঐ পথেই চলছেন। সুতরাং তোমাদের অবশ্যই তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়া উচিত ও তাদের আনুগত্য করা কর্তব্য।”

সে এখন নিজের আমল ও আকীদার কথা তাদের সামনে পেশ করলো এবং তাদেরকে মূলতত্ত্ব সম্পর্কে সংবাদ দিয়ে ঈমানের দাওয়াত দিলো।

সে তাদেরকে বললো- “আমি তো শুধু এক ও অংশীবিহীন আল্লাহরই ইবাদত করি। একমাত্র তিনিই যখন আমাকে সৃষ্টি করেছেন তখন কেন আমি তার ইবাদত করবো না? এটাও নয় যে, আমরা এখন তার ক্ষমতার বাইরে চলে গেছি। সুতরাং তার সাথে আমাদের এখন আর কোন সম্পর্ক নেই? না, না। বরং আমাদের সবকেই আবার তার সামনে একত্রিত হতে হবে। ঐ সময় তিনি আমাদেরকে আমাদের ভাল ও মন্দের পুরোপুরি প্রতিদান প্রদান করবেন।

এটা কতই না লজ্জার কথা যে, আমি ঐ সৃষ্টিকর্তা ও ক্ষমতাবানকে ছেড়ে অন্যদের উপাসনা করবো, যে না কোন ক্ষমতা রাখে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার উপর কোন বিপদ আসলে ঐ বিপদ দূর করতে পারে, না দয়াময় আল্লাহ আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইলে তাদের কোন সুপারিশ আমার কোন কাজে আসতে পারে। আমার প্রতি আপতিত কোন বিপদ হতে তারা আমাকে উদ্ধার করতে পারবে না।

হে আমার কওম! তোমরা তোমাদের যে প্রকৃত মা’বুদকে অস্বীকার করছো, জেনে রেখো যে, আমি তার প্রতি ঈমান এনেছি। অতএব, তোমরা আমার কথা শোনো।”

ঐ লোকটি এসব কথা বলামাত্র তারা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল! তারা তাঁকে ফেলে দিয়ে তার পেটের উপর চড়ে বসলো এবং পা দিয়ে পিষ্ট করতে লাগলো, এমন কি তাঁর পিছনের রাস্তা দিয়ে নাড়িভূঁড়ি বেরিয়ে পড়লো।

তৎক্ষণাৎ আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে তাঁকে জান্নাতের সুসংবাদ জানিয়ে দেয়া হলো। মহান আল্লাহ্ তাঁকে দুনিয়ার চিন্তা ও দুঃখ হতে মুক্তি দান করলেন এবং শান্তির সাথে জান্নাতে পৌঁছিয়ে দিলেন।

তার শাহাদাতে আল্লাহ তা’আলা সন্তুষ্ট হলেন। জান্নাত তার জন্যে খুলে দেয়া হলো এবং তিনি জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি লাভ করলেন।

নিজের সওয়াব, পুরস্কার এবং সম্মান দেখে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়লো- হায়! আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা যদি আমার এ মর্যাদার কথা জানতে পারত যে, আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আমাকে সম্মানিত করেছেন, তাহলে তারাও ঈমান আনত।

তারপর আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা দিচ্ছেন, পরবর্তীতে তাদের নিকট আর কোনই সতর্ককারী পাঠানো হয়নি এবং তার কোন প্রয়োজনও ছিল না। তারা মু’মিন ব্যক্তিকে হত্যা করার ফলে তাদের ওপর এসেছিল এক মহানাদ, যা তাদেরকে ধ্বংস ও নিথর নিস্তব্ধ করে দিয়েছিল।
আল্লাহ তা‘আলা এরপর বলেন,” তাদের কাছে যখনই কোন রাসূল এসেছে তখনই তারা তাঁদের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছে। আর এ কারণে তারা কিয়ামতের মাঠে কতই না লজ্জিত হবে।

অথচ তারা এ কথা চিন্তা করে না যে, তাদের পূর্বে কত শক্তিশালী জনগোষ্ঠীকে আমি ধ্বংস করে দিয়েছি, আর কোনদিন তাদের নিকট ফিরে আসবে না। তাদের সকলকে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে, আর আমিই তাদের এ ঠাট্টা-বিদ্রূপের শাস্তি প্রদান করব।

তাদের এ সকল ঠাট্টা-বিদ্রূপের ফলে কিয়ামতের মাঠে তারা লজ্জিত হবে এবং বলবে, কেন আমরা রাসূলগণকে মিথ্যা মনে করেছিলাম এবং কেনইবা তাদের অবাধ্য হয়েছলাম? কিন্তু তখন আর এ আফসোস করে কোনই লাভ হবে না! “

আয়াত গুলো থেকে শিক্ষনীয়:

  • রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা করা তাঁর জীবদ্দশায় অথবা মৃত্যুর পরেও হতে পারে। যেমন- মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা, অপমানজনক কথা বলা অথবা তাঁর হাদীসকে উপক্ষো করে চলা।
  • আমাদের এসব থেকে সতর্ক থাকা জরুরি। কেননা এসব কাজ ঈমান বিনষ্টের কারণ।
  • আর সৎ কাজের প্রতিদান কেবল “জান্নাত” মানুষের চোখে তা যতই ছোট হোক না কেন। কেবল প্রতিবাদ করার কারণেই, তাকে শহীদ করা হল এবং বিনিময়ে ইনতাকিয়ার ঐ সৎ লোকটি আল্লাহর চোখে মর্যাদাশীল হয়ে উঠলেন।

আল্লাহ আযযা ওয়াজাল আমাদের দ্বীনের সহিহ বুঝ দান করুন! আমীন।

সূত্র- তাফসীর সূরা ইয়াসিন, আয়াত ১৩-৩২ আয়াত, ইবনে কাসীর, ফাতহুল মাজীদ।

[লেখকের ফেসবুক পোস্ট থেকে]

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।