Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন বাছিরাত বা অন্তর্চক্ষু উন্মোচন

বাছিরাত বা অন্তর্চক্ষু উন্মোচন

।। এ. কে. এম মোতাহার হোসেন ।।

দুনিয়াতে যত প্রাণী আছে প্রায় সবারই চক্ষু আছে যদ্বারা তারা দেখতে পায়। মানুষের যেমন চোখ আছে গরুরও তেমনি চোখ আছে। দেখার শক্তির ব্যাপারে এক্ষেত্রে মানুষ ও পশুর কোন পার্থক্য নেই। উভয় প্রকার চক্ষুর গাঠনিক কাঠামোও (Anatomical Structure) একই প্রকার। এই প্রকার চক্ষুকে বলা হয় চর্মচক্ষু।

মানুষের মধ্যে অন্য এক ধরনের চোখ আছে যা মস্তিষ্কে থাকে, এটাকে বলা হয় জ্ঞানচক্ষু। এই চক্ষু অন্যান্য জীব-জানোয়ারের মধ্যে থাকে না। এটা অবুঝ শিশুর মধ্যেও থাকে না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই চক্ষুর বিকাশ ঘটে। এই চক্ষুর কারণেই জীব-জানোয়ারের উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, মানুষের প্রভুত্ব। একটি উদাহরণ দ্বারা জ্ঞানচক্ষু ও চর্মচক্ষুর পার্থক্য বোঝা যেতে পারে। তিন/চার বছরের একটি শিশু, যে জিলাপি খেতে ভালবাসে, তাকে তার নানা একটি জিলাপি ও পাঁচ লক্ষ টাকার একটি চেক দেখিয়ে বললেন, তুমি কোনটা নিবে? শিশুটি বলল- জিলাপি নেব। কারণ, জিলাপি মিষ্টি চেক মিষ্টি নয়। শিশুর বাবা বললেন, তুমি চেকটা নাও, তাতে হাজারো মণ জিলাপি লুকিয়ে আছে। কিন্তু শিশু তা বুঝল না। কারণ, তার জ্ঞানচক্ষু নেই। আছে চর্মচক্ষু। তার বাবা জ্ঞানচক্ষু দ্বারা চেকের মধ্যে লুকানো জিলাপি দেখতে পেয়েছিলেন। এই জ্ঞানচক্ষুর সদ্ব্যবহার দ্বারা মানুষ পৃথিবীতে এত উন্নতি সাধন করেছে। বৈজ্ঞানিক উন্নতির দ্বারা মানব সভ্যতা চরম উৎকর্ষতা লাভ করেছে এই জ্ঞানচক্ষুর সদ্ব্যবহার দ্বারা। জ্ঞানচক্ষু যে কোন মানুষ অর্জন করতে পারে, সে মু’মিন হোক বা কাফির হোক, দ্বীনদার হোক বা ফাসিক হোক।

মানুষের মধ্যে আরেক ধরনের চোখ আছে, যেটিকে বলা হয় অন্তর্চক্ষু বা দিলের চক্ষু, আরবীতে যাকে বাছিরাত বলা হয়। এটা শুধু দ্বীনদার মু’মিনদের মধ্যেই থাকে। কাফির-মুশরিকদের মধ্যে থাকে না, তাদের অন্তর মৃত। তাই তাদের দিলের চক্ষু থাকার প্রশ্নই উঠে না। যেসব মু’মিন মুত্তাক্বী ও মজবুত ঈমানের অধিকারী, তাদের অন্তর্চক্ষু খুবই সূক্ষ্মদর্শী। মানুষের মধ্যে হিদায়াত আসলেই অন্তর্চক্ষু জাগ্রত হয়।

একজন মানুষ মসজিদের পাশে দোকান করে। জুম্আর আযান পড়ল। এই সময় তার দোকানে বেশ কয়েকজন গ্রাহক এল যারা কয়েক হাজার টাকার সওদা করবেন। দোকানদার যদি জুম্আর নামাযে যায় তাহলে কয়েক হাজার টাকা ক্ষতি হবে। অপরদিকে আল্লাহ তাআলা সূরা জুম্আয় বলেন- “হে ঈমানদারগণ! যখন জুম্আর আযান দেওয়া হয় তখন তোমরা ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর যিকরের দিকে দৌড়াও; এটাই তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক যদি তোমরা বুঝ”।

এখন যদি দোকানদারের অন্তর্চক্ষু না থাকে, তার জ্ঞানচক্ষু তাকে বলবে, তুমি যদি জুম্আর নামায পড়তে যাও তোমার হাজার হাজার টাকা ক্ষতি হবে। আর যদি তার অন্তর্চক্ষু (হিদায়াত নসীব হয়ে) থাকে, তবে সে মনে করবে আল্লাহর হুকুম মানার মধ্যেই কামিয়াবী ও শান্তি। জুম্আ তরক করে কয়েক হাজার টাকা লাভ করলেও যেহেতু শান্তিদাতা আল্লাহর হুকুম অমান্য করা হবে তাই শান্তি আসবে না।

দ্বীনের অধিকাংশ হুকুম আহ্কামের লাভ অন্তর্চক্ষু দ্বারাই দেখতে পাওয়া যায়। চর্মচক্ষু বা জ্ঞানচক্ষু দ্বারা নয়। একটি সুরম্য অট্টালিকা তৈরী করতে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়। মাসের পর মাস শত শত লোকের খাটতে হয়। অথচ ঐ ভবনে মানুষ চিরস্থায়ীভাবে থাকতে পারবে না। মৃত্যুর সাথে সাথে বের করে দেওয়া হবে। তাছাড়া ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভবনটা মৃত্যুর আগেও হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে। ঐ ভবনে বাস করলেই শান্তি পেয়ে যাবে এমন গ্যারান্টি নেই।

অপর পক্ষে, কেউ যদি “সুব্হানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী সুব্হানাল্লাহিল আযীম” সাত বার পড়ে তবে জান্নাতে এমন একটি প্রাসাদ (গম্বুজ, বালাখানা) তৈরী হবে, যার একটি ইট সোনার, একটি রূপার, সিমেন্ট হবে মিশ্কে আম্বরের। তার মেঝেতে একটি ছড়ি (বেত) রাখতে যতটুকু জায়গা লাগে তার মূল্য দুনিয়া সাত বার বিক্রি করলেও হবে না। উক্ত বালাখানায় তাসবীহ্ পাঠকারী অনন্তকাল পরম শান্তিতে থাকবে। তার পরেও মানুষ নশ্বর দুনিয়া সাজাতে ব্যস্ত। তার মহামল্যবান সময়, মূল্যবান জান-মাল দুনিয়ার পিছনেই ব্যয় করছে। কারণ, দুনিয়া চর্মচোখে দেখা যায়। জান্নাত দেখা যায় অন্তর্চোখে, চর্মচোখে নয়। আর অধিকাংশ মানুষেরই অন্তর্চোখ নেই।

এখন প্রশ্ন হল অন্তর্চক্ষু কিভাবে অর্জন করা যাবে? চর্মচক্ষু জন্মসূত্রেই পাওয়া যায়। কিন্তু অন্তর্চক্ষু কঠোর মেহ্নত-সাধনা করে অর্জন করতে হয়। একটি হাদীসে আছে, একবার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইরে বেরিয়ে ইরশাদ করেন- “তোমাদের মধ্যে কেউ কি এটা চায় যে, আল্লাহ তাকে শিক্ষা ব্যতীতই ইলম দান করবেন এবং কোন পথপ্রদর্শক ব্যতিরেকে তাকে হিদায়াত দান করবেন? কেউ কি চায় যে, আল্লাহ অন্ধত্ব দর করে তার দিলের চক্ষু খুলে দিবেন? এরূপ প্রত্যাশা করলে বুঝে নাও যে, যার দুনিয়ার প্রতি কোন আগ্রহ নেই এবং স্বীয় আকাখাকে খাট করে, আল্লাহ তাআলা তাকে শিক্ষা ব্যতীত ইল্ম দান করবেন এবং কোন পথপ্রদর্শক ব্যতীত হিদায়াত দান করবেন।” (ফাযায়েলে ছাদাকাত)।

উক্ত হাদীসে দেখা যায়, বান্দা যদি দু’টি জিনিস হাসিল করে আল্লাহ তাকে তিনটি জিনিস দান করবেন। জিনিস দু’টি হল, দুনিয়ার প্রতি অনাগ্রহতা এবং সংক্ষিপ্ত আশা-আকাঙ্খা। এই দু’টি জিনিস হাসিল হলে আল্লাহ তাআলা তিনটি নিয়ামত দান করবেন- বিনা শিক্ষায় ইল্ম দান করবেন, বিনা পথপ্রদর্শকে হিদায়াত দান করবেন এবং অন্তর্চক্ষু খুলে দিবেন। অতএব, বোঝা গেল, অন্তর্চক্ষু অর্জন করতে হলে দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত হতে হবে এবং প্রত্যাশার বাহু সংক্ষিপ্ত করতে হবে। দুনিয়া বিমুখিতা এসে গেলে আশা-আকাঙ্খা অবশ্যই সংক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। দুনিয়া সাজানোর পরিকল্পনা অন্তর থেকে বিদায় নিবে। আসলে দুনিয়ার প্রতি আসক্তিই মানুষকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। দুনিয়া করতে নিষেধ নেই। তবে দুনিয়ার প্রতি দিল লাগানো অর্থাৎ দুনিয়াকে মুহাব্বত করা নিষেধ ও ভয়াবহ ক্ষতিকর। হাদীস শরীফে আছে, দুনিয়ার মুহাব্বত সমস্ত পাপের মূল।

আরও পড়তে পারেন-

দুনিয়ার প্রতি মানুষ যখন সম্পূর্ণ নিরাসক্ত হয়ে যায় তখন তার অন্তর্চক্ষু খুলে যায়। দুনিয়াতে বসে সে বেহেশ্তের নিয়ামত দেখতে পায়। এমনকি অন্তর্চক্ষু দ্বারা আল্লাহ তাআলার দিদার দুনিয়াতেই লাভ করা সম্ভব। নিম্নের ঘটনা দ্বারা বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।

হযরত শিবলী (রাহ্.) বলেন, আমি এক সময় জনৈক মাজনূনকে দেখলাম, ছেলেরা তার প্রতি ঢিল ছুঁড়ছে। আমি তাদেরকে ধমক দিলাম। তারা বল্ল, এই ব্যক্তি দাবী করছে যে, সে নাকি খোদাকে দেখছে। আমি তার নিকট গিয়ে শুনতে পেলাম, সে বলছে, ছেলেদেরকে আমার পিছনে লেলিয়ে দিয়ে ভালই করেছ। আমি তাকে বল্লাম, এরা তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে যে, তুমি নাকি খোদাকে দেখছ বলে দাবী করছ। মাজনূন লোকটি একথা শুনে এক চিৎকার দিয়ে বল্ল, শিবলী! ঐ সত্তার ক্বছম! যিনি আপন মুহাব্বতে আমাকে দুরাবস্থায় ফেলেছেন, তিনি আমাকে নৈকট্যের এমন বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন যে, যদি এক মুহূর্তও তিনি আমার নিকট থেকে অদৃশ্য হয়ে যান তবে বিচ্ছেদের বেদনায় আমি টুকরা টুকরা হয়ে যাব। এই বলে সে নীচু হয়ে এই পংক্তিটি উচ্চারণ করল- “তোমার ধ্যান আমার চক্ষে এবং যিকর আমার মুখে আর তোমার ঠিকানা আমার অন্তরে। সুতরাং তুমি কোথায় অদৃশ্য হতে পার?” (ফাযায়েলে যিকর)।

আর একটি ঘটনা। এক সাহাবী দীর্ঘদিন পরে সফর থেকে বাড়ী ফিরলেন। ঈশার নামাযের পর ঘরে এসে দু’রাক্আত নফলের নিয়্যাতে নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। দু’রাক্আত নামায পড়তে পড়তে ভোর হয়ে গেল। ফজর পড়তে রওয়ানা হলে বিবি জামার আস্তিন টেনে ধরে বললেন, এতদিন পর বাড়ী ফিরলেন, এসে সারা রাত নামাযই পড়লেন, আমার কি কোন হক্ নেই? সাহাবী বললেন, তোমার হক আদায়ের ইচ্ছা আমার ছিল, কিন্তু নামাযে দাঁড়ালে বেহেশ্তের হর-গিলমান, বাগ-বাগিচা, নহর-বালাখানা নজরে এসে যায়। ওগুলো দেখতে দেখতে কখন যে ভোর হয়ে গেল টেরও পেলাম না।

এখানে প্রথম ঘটনায় মাজনূন ব্যক্তি সার্বক্ষণিকভাবে আল্লাহ্কে দেখছেন আর দ্বিতীয় ঘটনায় সাহাবী নামাযের মধ্যে বেহেশ্তের দৃশ্যাবলী দেখেছেন। এগুলো দৃষ্টিগোচর হয়েছে অন্তর্চক্ষু দ্বারা, চর্মচক্ষু বা জ্ঞানচক্ষু দ্বারা নয়। মানুষের যখন দিলের চক্ষু খুলে যায় তখন মানুষ দুনিয়াতে বসে জান্নাতের নিয়ামত উপভোগ করতে পারে, তার কোন পেরেশানী থাকে না, পরম শান্তি তার দিলে সর্বদা বিরাজ করে। সব মানুষ তাকে মুহাব্বত করে। সে আল্লাহর ওলী বা বন্ধু হয়ে যায়। ওলী-আল্লাহদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা সূরা ইউনুসে বলেন- “মনে রেখ, নিশ্চয়ই আল্লাহর ওলীদের কোন ভয়ও নেই, চিন্তাও নেই, যারা ঈমান আনে ও আল্লাহ্কে ভয় করে (গুনাহ্ থেকে বেঁচে থাকে), তাদের জন্য সুসংবাদ দুনিয়ার জীবনে ও আখেরাতের জীবনে। আল্লাহর কথার মধ্যে কোন নড়চড় নেই। এটিই হল সবচেয়ে বড় সফলতা।”

অর্থাৎ দুনিয়া ও আখেরাতের সকল সমস্যার সমাধান ও দোজাহানের কামিয়াবী নিহিত রয়েছে অন্তর্চক্ষু (বাছিরাত, হিদায়াত) অর্জন করার মধ্যে।

আগেই বলা হয়েছে, দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তির দ্বারাই দিলের চক্ষু অর্জিত হয়। কারণ, দুনিয়ার মুহাব্বত দিলকে অন্ধ করে দেয়। প্রশ্ন হল, দুনিয়ার প্রতি বেরগবতী (নিরাসক্তি) কিভাবে আসবে?

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়্যাতী যিন্দেগীর প্রতি লক্ষ্য করলে প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া যাবে। ইসলাম গ্রহণের আগে সাহাবাদের জীবন চরমভাবে কলুষিত ছিল। সর্বপাপে তারা পাপী ছিল।

হাদীসের ভাষ্য মতে দুনিয়ার মুহাব্বতই সকল পাপের মূল। অর্থাৎ সাহাবাদের অন্তর ইসলাম গ্রহণের আগে দুনিয়ার মুহাব্বতে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। ফলে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাদের অন্তর। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উপর ঈমানের মেহনত তথা দাওয়াতের মেহনত করেছেন। ফলে ধীরে ধীরে দুনিয়ার মোহ অন্তর থেকে বের হয়ে গেছে, তদস্থলে ঈমান স্থান লাভ করেছে, অন্তর্চক্ষু খুলে গেছে। মক্কী জীবনের ৯ বছর ধরে শুধু ঈমানের মেহনতই চলেছে। নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত তখন কিছুই ফরয হয়নি।

সাহাবায়ে কিরামের যিনিই ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তিনিই একজন দায়ীতে পরিণত হয়েছেন। এভাবে দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনত দ্বারা সাহাবায়ে কিরামের অন্ধকার দিল যেমন আলোকিত হয়েছে, আজও আমরা যদি দাওয়াতের মাধ্যমে নিজের অন্তরের উপর মেহনত করি, তবে আমাদের অন্তরে প্রকৃত ঈমান আসবে। অন্তর্চক্ষু খুলে যাবে; ব্যক্তি জীবনে কায়েম হবে দ্বীন-ইসলাম।

তাবলীগী মেহনতের উসীলায় লক্ষ লক্ষ অমুসলিম মুসলিম হচ্ছে। এমন হাজার হাজার উদাহরণ রয়েছে যে, একজন ফাসিক বখাটে সন্ত্রাসী লোক তাবলীগে তিন চিল্লা দিয়ে পুরোপুরি দ্বীনের উপর উঠে গেছে। পূর্ণ সুন্নাতের অনুসরণ করছে। দাড়ি, পাগড়ী, লম্বা জামা নিয়েছে, তাহাজ্জুদ পড়ছে।

আসলে ব্যাপার হল, নিজের বাড়ী-ঘর পরিবেশ ছেড়ে তাবলীগে গিয়ে মসজিদে ফেরেশ্তাদের পরিবেশে থাকতে হয়। সেখানে পাপ করা সম্ভব নয়। পবিত্র পাপমুক্ত পরিবেশে দিনের পর দিন থাকতে থাকতে ঐ পরিবেশের প্রভাব অন্তরের উপর পড়ে এবং অন্তর থেকে দুনিয়ার মুহাব্বত বের হতে থাকে। মানুষের উপর পরিবেশের এক শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, গ্রামে যেসব মাটির চুলা আছে তাতে বিশ বছর আগুন জ্বালানোর পরও চুলার মাটি ইট হয় না। ঐ মাটি পানিতে ফেলে দেখবেন ধীরে ধীরে কাদা হয়ে মিশে যাবে। পক্ষান্তরে, মাটিকে তার পরিবেশ থেকে আলাদা করে সাইজ করে ইটের ভাটায় কয়েকদিন পোড়ালেই তা ইট হয়ে যায়। ভেঙ্গে চূর্ণ করে পানিতে কয়েক বছর রাখলেও তা পানির সাথে মিশে না।

একটি আংটি পায়খানায় পড়ে গেলে সেখানে রেখে শত বালতি পানি ঢাললেও তা পরিস্কার হবে না। আর আংটিটা পায়খানা থেকে তুলে আলাদা করে এক গ্লাস পানি ঢেলে তা পরিস্কার করা যায়। এজন্য তাবলীগে গিয়ে দীর্ঘ সময় (১২০ দিন) মসজিদের পরিবেশে কাটালে মানুষের অন্তরের অন্ধত্ব দূর হয়ে অন্তর্চক্ষু উন্মোচিত হয়। দুনিয়ার মুহাব্বত দূর হয়ে আল্লাহর মুহাব্বত পয়দা হয়। ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি পায়। এই ঈমানই মানুষকে সর্বপ্রকার পাপ থেকে রক্ষা করে এবং নেক কাজে উদ্বুদ্ধ করে।

তাবলীগের মেহনতের একটি বিশেষ ফায়দা হল আÍশুদ্ধি। অর্থাৎ নিজের হিদায়াত। আরেকটি দিক হল, আখেরী নবীর উম্মত হিসেবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেওয়া যিম্মাদারী আদায়। আমরা যদি শুধু নিজের ইবাদতে সন্তুষ্ট থাকি অন্যের কাছে দাওয়াত না পৌঁছাই, তাহলে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এজন্য আল্লাহর কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে।

ইসলাম শান্তির ধর্ম। পরিপূর্ণরূপে ইসলাম মানলে পরিপূর্ণ শান্তি ও আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যাবে। পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ মানুষ অমুসলিম। ইসলামের অভাবে অশান্তির সাগরে তারা হাবুডুবু খাচ্ছে, আত্মহত্যা করছে, আখেরাতের অনন্ত আযাব তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা যদি আমাদের শান্তির ধর্ম লুকিয়ে রাখি, তাদেরকে দাওয়াত না দিই, তাহলে ক্বিয়ামতের দিন তারা কি আমাদের ছাড়বে? যে দাওয়াতের কাজের জন্য তায়েফের ময়দানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রক্তাক্ত হয়েছেন, উহূদের ময়দানে দান্দান মুবারক শহীদ করেছেন, পেটে পাথর বেঁধেছেন, দুই মাস যাবৎ ঘরে চুলা জ্বলেনি, উটের নাড়ীভুঁড়ি মাথায় চাপানো হয়েছে, সে দাওয়াতের কাজ আমরা আজ মামুলি ও অনাবশ্যক মনে করছি। পরিণতিতে আল্লাহর সাহায্য আমাদের উপর থেকে হটে যাচ্ছে। ফলে বিশ্ব জুড়ে মুসলমানরা মার খাচ্ছে।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রক্তমাখা মেহনত যদি আমরা আপন করে নিই, তাহলে গণহারে মানুষ হিদায়াত পাবে। ১৯৭৬ সালে ফ্রান্সে একটি মাত্র মসজিদ ছিল। তাও শুধু শুক্রবারে খুলত, মাত্র কয়েকজন মুসল্লী হত। তাবলীগের মেহনতের বদৌলতে বর্তমানে ফ্রান্সে চার হাজারের উপর মসজিদ হয়েছে। মানুষ দলে দলে মুসলিম হচ্ছে, তাদের গির্জাগুলোকে মসজিদে পরিণত করছে। এভাবে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ সর্বত্র দলে দলে মানুষ মুসলমান হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ মুসলমান সাচ্চা মুসলমান হচ্ছে।

এহেন জরুরী মেহনতকে যারা অপছন্দ করেন, তারা এ মেহনত সম্বন্ধে ধারণা না থাকার কারণেই করেন। কাঁঠাল না খেয়ে যেমন কাঁঠালের স্বাদ বোঝা যায় না, তেমনি তাবলীগে না গিয়ে এর হাক্বীক্বত বোঝা যাবে না। চার মাস লাগালে এর হাক্বীক্বত বোঝা যাবে, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক কায়েম হবে, অন্তর্চক্ষু খুলে যাবে। আসুন, আমরা আর অন্ধ না থেকে জোরদার দ্বীনের মেহনত করে অন্তরকে আলোকিত করি, অন্তর্চক্ষু উন্মোচিত করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন॥

উম্মাহ২৪ডটকম:এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।