Home মহিলাঙ্গন মুসলিম নারীদের বিভ্রান্ত করার নতুন ফাঁদ!

মুসলিম নারীদের বিভ্রান্ত করার নতুন ফাঁদ!

।। ডা. তানজিনা রহমান ।।

প্রায় ১৩ বছর আগের কথা বলছি। আমাদের দূর সম্পর্কিত এক আত্মীয়া আমাকে নিয়ে গেলেন এক ফটোশ্যুটে। উদ্দেশ্য একটি “ইসলামিক ম্যাগাজিন”-এর জন্য কিছু ছবি তোলা, যা এই মেসেজ দেবে যে, “হিজাব পরেই সব কিছু স্মার্টলি ক্যারি আউট করা সম্ভব। যা মেয়েদের হিজাব পরায় উৎসাহিত করবে”।

ছবিগুলো ছিল অনেকটা এমন, ফুলের গহনা হলুদের শাড়ির সাথে হিজাব, গর্জিয়াস কামিজের সাথে হিজাব। ব্রাইডাল মেকআপ ভারী গহনার সাথে হিজাব পরিহিতা কনে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

সেখানে আমি ছাড়া বাকি সব মেয়েরা ছিল ব্যক্তিগত জীবনেও হিজাবী। মানে মাথায় কাপড় দিয়ে চলেন। যেহেতু আমি তখন পর্দা করতাম না, এ বিষয়ে কিছু জানতামও না, ঠিক বেঠিক নিয়ে তেমন মাথা ব্যাথাও আমার ছিল না। যাই হোক কাজ সম্পন্ন হল।

ব্যাপারটি প্রায় ভুলেই গেছিলাম। হিজাবি কিন্তু “ফেমিনিস্ট” এই সব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। সেসময় উদ্দেশ্য খুব নেক মনে হলেও এখন, এই সময় পেছনে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারি, সেই উদ্দেশ্যটা ভয়ংকর একটা ফিতনা ছড়ানোর চেষ্টা ছাড়া আর কিছু ছিল না।

যে ফিতনা এই ১৩ বছরে বেশ অনেকের ভেতর ছড়িয়ে পড়েছে! আল্লাহ মাফ করুন।

আপাত দৃষ্টিতে নেক উদ্দেশ্য, কতগুলো মেয়ে, ভ্রু প্লাক করে, মেকআপ করে গহনা পরে কেবল মাথা ঢেকেছে। কিছু কিছু পোষাকে তাদের ফিগারও বোঝা যাচ্ছে। কারো হাতে মেহেদী আংটি। একজন বেগানা পুরুষ তাদের ছবি তুলছে। ইসলামী শরীয়ায় পর্দা বলতে যা বোঝায় তার কিছুই এসব ছবিতে ছিল না, কেবল মাথা কাভার করা ছাড়া। আদৌ কি একে পর্দা বলে?
এই ম্যাগাজিন কি জাতীয় পর্দার মেসেজ দিল? এই ছবিগুলো দ্বীনের ব্যাপারে সল্প জ্ঞান থাকা মেয়েদের কোন পর্দায় উদ্বুদ্ধ করল? এই মেসেজ পেয়ে যারা এই ভাবে কেবল মাথায় ওড়না পেচিয়ে ভেবেছেন- “পর্দা ইজ ডান” মানে আমি প্র‍্যাক্টিসিং, তাহলে এ দায়ভার কি ওনাদের উপরও বর্তাবে না? এতে আখেরে কি ফায়দা হল?

আরও পড়তে পারেন-

ম্যাগাজিনের আইডিয়া যাদের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়েছিল তারা কি আদৌ রাসূল (সা.)এর শেখানো ইসলাম প্র‍্যাক্টিস করেন? তারা কি জানতেন না পর্দার উদ্দেশ্য কি? মেকআপ করে মুখ সাজিয়ে স্রেফ হিজাব পরে বেগানা পুরুষদের সামনে আসলে, এটা ইসলামের ফরয পর্দা মানা হল? এভাবে মেহেদী আংটি পরে হাত সাজালে, মুখ সাজালে হাত এবং মুখও যে পর্দার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, এই সিদ্ধান্তে ইবনে আব্বাস (রাযি.) এবং ইবনে মাসউদ(রাযি.) উভয়ের কারো কোন দ্বিমত নেই! (তাফসীর মারেফুল কুর’আন)।

অপ্রয়োজনে ছবি তোলার ব্যাপারে ইসলাম কি বলে?

এই জাতীয় কর্মকান্ড শরীয়াহ অনুমতি দেয় কিনা এ ব্যাপারে একবারো কি তারা কোন আলেমের মতামত নিয়েছিল? মহিলাদের মেকআপ, গয়না পরা আকর্ষনীয় সব ছবি সংবলিত সেই ম্যাগাজিন, হয়তোবা কোন পুরুষের দ্বারাই এডিট করা হল, ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল, অনেকেই দেখল। আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা আমাকে এবং তাদের সবাইকে মাফ করুন, যারা না বুঝে এতে শামিল হয়েছিলেন, আমীন।

সেই ম্যাগাজিনের পেছনে যারা ছিলেন তাদের অনেকেই তখনো এবং এখনো বিভিন্ন চ্যানেলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ইসলাম নিয়ে কথা বলেন। এই মহিলাদের কেউ কেউ সহিহ সনদে বর্ণিত হাদিস মানেন না। লক্ষ্য করবেন, মাহরাম ছাড়া ট্রাভেল করা, দাইয়ুসের বিধান, এসব বিষয় তারা কখনো তাদের আলোচনায় আনেন না। আবোল তাবোল যুক্তি দিয়ে এরা নিজের সুবিধামত কুরআনের আয়াতকে নিজের মত করে ব্যাখ্যা করেন।

ভ্রমন বা অন্য যেকোন বিষয়ে স্বামীর অনুমতি নেওয়ার বিধানটিও যে তারা সরাসরি অস্বীকার করেন, এটা ব্যক্তিগত ভাবেই আমার দেখা। এদের গলা রাসূলের চাইতে উঁচু। নাউযুবিল্লাহ।

তাদের সমস্ত আলোচনা থাকে দুনিয়াতে নারীদের অধিকার, অর্থ উপার্জন কেন্দ্রিক। অথচ মেয়েদের আল্লাহর চোখে মর্যাদাশীল হবার জন্য ‘অর্থ উপার্জন’ কোন মাপকাঠিই নয়। তাদের আলোচনা কখনো আখিরাতমুখী হয়না। খেয়াল করেছেন কখনো?
আল্লাহর দেয়া বিধানকে যে মানতে পারল না, সে গুনাহ করল। কিন্তু যে অস্বীকার করল সে করল কুফুরী।

এদেরকে ইসলামের ব্যাপারে বিশ্বাস করতে তাদের অন্তরই সায় দেয়, যারা পশ্চিমা আদর্শের সাথে ইসলাম ব্লেন্ড করে নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে চায়। রাসূলের প্রতি ভালবাসায় কমতি থাকার কারণে বা আদর্শিক ভাবে বা দুনিয়াবী স্বার্থে রাসূল (সা.)এর সব নির্দেশকে যারা মানতে পারে না।

নাস্তিক, ইসলাম বিদ্বেষী বা সেক্যুলার ফেমিনিস্টদের নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নাই! এদের নিয়েও মাথা ব্যাথার প্রয়োজন হত না, যদি না তারা নিজেদের কথিত নারীবাদী আদর্শকে জায়েয করবার জন্য ইসলামকে এর ভেতর টেনে আনত। উদ্বেগের দিক হচ্ছে, ১১-১২ বছর আগেও তারা তাদের টক্সিক চিন্তাভাবনা ছড়িয়ে দিতে পারেনি যতটা এখন পারছে।

কেউ যদি জেনে বুঝে রাসূলের শেখানো ইসলামের পরিবর্তে নিজের ব্যক্তিগত আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে নিজের মতো করে উদ্ভাবিত কথিত “স্মার্ট ইসলাম” শেখানোর চেষ্টা করে থাকেন, তাদের আল্লাহ ছেড়ে দেবেন- তারা এত নিশ্চিত হন কি করে?

মানুষকে যারা ভুল রাস্তায় পরিচালিত করে তারা ছাড় পাবেন না। আর যারা তাদের আদর্শকে ফলো করছেন নিজের ব্যক্তিগত মতামতের সাথে মিলে যায় বলে, তারাও কিন্তু বাদ যাবেন না।
হিসাবের দিনে এদের সবাইকে হিসাব দিতে হবে, বাকীদের গোমরাহ করার জন্য। ইন শা আল্লাহ।

প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি হিসাবের দিনের ব্যাপারে আসলে তারা ঈমান আনেনি? যদি তাই হয়, ঈমানেই গলদ কারো কাছ থেকে ইসলামের মৌলিক বিষয়ের জ্ঞান নেয়া নিজের ঈমানের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, ভেবে দেখেছেন? এটা এত বড় রিস্ক, যার পরিণাম হতে পারে “আযাবুন না-র “!!

ইসলামের নামে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এত কনফিডেন্টলি মানুষকে ভুল রাস্তায় পরিচালিত করার সাহস শয়তান ছাড়া আর কারো কাছ থেকে আসে না।

কার কাছ থেকে আমরা ইসলামের প্রাথমিক জ্ঞান নিচ্ছি সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভ্রান্ত আক্কিদার কারো কাছ থেকে “ইসলামের জ্ঞান” ভেবে যে জ্ঞান নিব, সেই জ্ঞান আমাকে উদ্ভ্রান্তই করবে কেবল। সীরাতুল মুস্তাকিমের পথ ধীরে ধীরে সরে যাবে বহু দূরে। এতে ঘরে অশান্তি ছাড়া আর কিছুই বাড়বে না।

মনে রাখবেন, যে ঘরে ইসলাম থাকে সে ঘরে শান্তি থাকে, অশান্তি নয়! “আমার মনে হয়” জায়েয বা বৈধতা সাব্যস্ত করতে এমন উক্তির স্থান ইসলামে নেই।

ইসলাম সবাইকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়, অর্থাৎ “take it or leave it”, তবে যতক্ষন সে ইসলামে প্রবেশ না করছে ততক্ষণ। কিন্তু যেই মাত্র আপনি আত্মসমর্পণ করলেন আল্লাহর ইচ্ছার কাছে, নিজের ইচ্ছামত ভাবার, চলার অনুমতি আর আপনাকে আপনার দ্বীন দেয় না।
শুধু লেকচার শোনার যে নতুন ট্রেন্ড এটা খুব ভাল নয়। কেবল শুনে শুনে ইসলাম জানা বা শেখা যায় না। ইসলাম সহজ বিষয় নয়। অফূরন্ত সময় কিন্তু আমাদের হাতে নেই…।

“আল্লাহুম্মাহদিনা ফী-মান হাদাইত।
ওয়া ‘আফিনা ফী-মান ‘আফাইত”।

[২৫ রবিউল আউয়াল,১৪৪২ হিজরী]

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।