Home ইতিহাস ও জীবনী ইসলাম এবং আয়ারল্যান্ড: এই বন্ধুত্বের সাক্ষ্য বহন করে ইতিহাস

ইসলাম এবং আয়ারল্যান্ড: এই বন্ধুত্বের সাক্ষ্য বহন করে ইতিহাস

বিশ্বে বর্তমানে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে মুসলমানরা বারবার আক্রান্ত হচ্ছেন এবং তাঁদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ধীরে ধীরে সীমাবদ্ধ করা হচ্ছে, এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন মুক্ত মনে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানলাভ। সম্প্রতি ব্রিটিশ সমাজে ইসলামফোবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই কিছুটা এগোলেও, কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এখনও কিছু ভুল ধারণা প্রচার করে চলেছেন এবং নিজস্ব অজ্ঞতার ফলে ইসলাম সম্পর্কে যে ভ্রান্ত ধারণা তাঁরা ব্যক্তিগত ভাবে পোষণ করেন- সেগুলিই তাঁরা জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন।

এমনই এক ব্যক্তি হলেন জেমস ম্যাককনেল। ইনি হলেন আয়ারল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী এক খ্রিস্টান যাজক যিনি ২০১৪ সালের ২৫ মে তারিখে প্রকাশ্যে তাঁর বক্তব্য রেখে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে একটি বিদ্বেষময় অভিযান চালু করেছেন। তাঁর বিভিন্ন অযৌক্তিক ও উত্তেজক মন্তব্য ইসলামবিরোধী মনোভাবকে পোক্ত করে তোলার পাশাপাশি আয়ারল্যান্ডে বসবাসকারী মুসলিম সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করার জন্য ইসলামোফোবিকদের প্রয়োজনীয় গোলাবারুদও জুগিয়েছে।

তৎকালীন উত্তর আয়ারল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার পিটার রবিনসন শুধুমাত্র এই মন্তব্যগুলির সাথে সহমত পোষণ করেই থামেননি, বরং তিনি এই যাজকের মতামতকে সমর্থন করে প্রকাশ্যে বিবৃতি জারি করে বিতর্কে আরও ইন্ধন জুগিয়েছেন। এর ফলে ম্যাককনেলের দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমশ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং তা আয়ারল্যান্ডের একটি মূলধারার রাজনৈতিক দলের সমর্থনও অর্জন করেছে। উল্লিখিত যাজক এবং ফার্স্ট মিনিস্টার, উভয়েই তাঁদের ধর্মান্ধ ও বিদ্বেষমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গোপন করার কোনও চেষ্টা করেননি। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয়টি হল, তাঁরা ১৬০ বছর আগে আয়ারল্যান্ডকে বাঁচাতে সহায়ক ভূমিকা পালনকারী একটি ধর্ম এবং ধর্মাবলম্বীদের প্রতি এই বিদ্বেষমূলক আচরণ করছেন।

আরও পড়তে পারেন-

আয়ারল্যান্ড ও দুর্ভিক্ষ

উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, আয়ারল্যান্ডে প্রবল দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, যার ফলে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ২৫% হ্রাস পেয়েছিল। আয়ারল্যান্ডের এই সঙ্কটে, অন্তত এক কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষজনিত রোগ এবং অনাহারের জেরে প্রাণ হারিয়েছিলেন এবং আরও অন্তত দশ লক্ষ লোক ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। আয়ারল্যান্ডের এই সঙ্কটকাল ইতিহাসে ‘দ্য গ্রেট হাঙ্গার’ নামেই পরিচিত।

এই সময় ব্রিটিশ সরকারের নিষ্ক্রিয়তা নিঃসন্দেহে পরিস্থিতি আরও শোচনীয় করে তুলেছিল। তবে বৈদেশিক সাহায্য এই ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই বৈদেশিক সাহায্যকারীদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য দাতা ছিলেন, মুসলিম অটোমান খলিফা, আবদুল মেজিদ, যিনি প্রাথমিকভাবে আয়ারল্যান্ডকে ১০,০০০ পাউন্ড সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে সেই সময় ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়া তাঁর নিজের রাজ্যে ২০০০ পাউন্ডের বেশি অনুদান না দেওয়ার ফলে, খলিফার উপরে রাজনৈতিক চাপ তৈরি করা হয় যাতে তিনি কোনও ভাবেই রানির চেয়ে অধিক আর্থিক অনুদান না প্রদান করেন। এর ফলে খলিফা মাত্র ১০০০ পাউন্ডের বেশি অর্থসাহায্য প্রেরণ না করার চুক্তি স্বীকার করতে বাধ্য হন।

কূটনীতির কটূচক্র

সেই চুক্তি স্বীকার করলেও খলিফা বুঝতে পেরেছিলেন যে, আয়ারল্যান্ডের এই বিপর্যয়ে এত সামান্য অর্থসাহায্য যথেষ্ট নয়। তাই তাঁর উপরে আরোপ করা কূটনৈতিক বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করেই তিনি গোপনে খাদ্য এবং অতিরিক্ত আর্থিক অনুদান দ্বারা পূর্ণ ৩টি জাহাজ আয়ারল্যান্ডে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু সেগুলি ব্রিটিশ কর্মকর্তারা অবরুদ্ধ করেছিলেন। জাহাজগুলি যাতে ডাবলিন এবং বেলফাস্ট বন্দরে প্রবেশ করতে না পারে, তার জন্য আইনি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। তখন অটোমান নাবিকরা গোপনে ডাবলিনের উত্তরে অবস্থিত একটি ছোট শহর দ্রোহিদাতে জাহাজের সমস্ত খাবার নামিয়ে দিয়েছিলেন।

ইতিহাস সাক্ষী

তাঁর দেশের প্রতি এমন উদার আচরণের স্বীকৃতি স্বরূপ, দ্রোহিদার মেয়র অল্ডারম্যান ফ্রাঙ্ক গডফ্রে ১৯৯৫ সালের মে মাসে খলিফা আবদুল মেজিদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন এবং তাঁর সম্মানে একটি ফলক স্থাপন করেন। সেই সময় মুসলমান জনগণ এবং তাঁদের খলিফার প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে দ্রোহিদা ইউনাইটেড ফুটবল ক্লাবের প্রতীকে আইরিশরা একটি তারা এবং একফাঁলি চাঁদ যুক্ত করেছে। ম্যাককনেল ইসলাম সম্পর্কে যে বিরূপ মন্তব্যগুলি করে থাকেন, এই ইতিহাস সম্পূর্ণ তার বিরোধী একটি ছবি তুলে ধরে। এই ইতিহাসই প্রমাণ করে যে, শরিয়াহ আইন, ইসলাম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই খ্রিস্টান যাজকের বিদ্বেষমূলক মতবাদের কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই।

অটোমান সাম্রাজ্য এবং আয়ারল্যান্ডের সহযোগিতা ও সহমর্মিতাপূর্ণ ইতিহাসের এই সংক্ষিপ্ত বিবরণই প্রমাণ যে, যাজক ম্যাককনেলের দাবি কোনও ভাবেই সঠিক নয়। মানুষের প্রতি সমবেদনা ও করুণা প্রদর্শন করা ইসলামের অনন্য শিক্ষা, যা নিয়ে মুসলমানরা অত্যন্ত গর্ববোধ করে থাকেন। আয়ারল্যান্ডের সঙ্কটকালে তৎকালীন অটোমান খলিফা যে ভাবে রাজনৈতিক বাধা-বিপত্তির পরোয়া না করে আইরিশদের সাহায্য করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন তা কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, বরং ইসলাম ধর্ম মুসলমানদের কাছ থেকে এমন আচরণই দাবি করে।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।