Home ইতিহাস ও জীবনী মরক্কোর ভাসমানমান মাসজিদ আল-হাসান আল-থানি

মরক্কোর ভাসমানমান মাসজিদ আল-হাসান আল-থানি

-মরক্কোর দ্বিতীয় হাসান মসজিদ।

মরক্কোর ক্যাসাব্লাঙ্কা অনেক বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক একটি শহর। শহরের উপকূলবর্তী প্রান্তে, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে এক বিশাল মিনার। সেখান থেকে ক্রমাগত লেজার আলোর বিচ্ছুররণ হচ্ছে ২০০ মাইল দূরে কাবার দিকে। অতলান্তিক মহাসাগরের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে মিনার সংলগ্ন প্রসাদপম মসজিদের পায়ের উপর। ক্যাসাব্লাঙ্কা শহরের বেশিরভাগ স্থাপনা সাদা হলেও এই মসজিদের ইমারতগুলো লালচে। দেখতে যেন অতলান্তিক মহাসাগরের বুকে চিরে গড়ে ওঠা এক সুন্দর স্থাপনা। রাতে বেলা জ্বলে ওঠা এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।

মাসজিদ আল-হাসান আল-থানি-

এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ মিনার বিশিষ্ট মসজিদ। হাসান আল-থানি মসজিদটি মরক্কোর সবচেয়ে বড় মসজিদ। এর অবস্থান মুসলিম বিশ্বের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে, ঠিক অতলান্তিক মহাসাগরের তীরে। মসজিদটির এক-তৃতীয়াংশ সমুদ্রের পানিতে ভাসমান। এর সমুদ্রের পানিতে ভাসমান অংশের উপর দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া যায়, যদিও সাধারণ মুসল্লিদের জন্য কাঁচের তৈরি স্বচ্ছ মেঝের মধ্য দিয়ে নিচের পানির দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ নেই। সমুদ্রের তীরে অবস্থিত হওয়ায় মসজিদটিতে নামাজরত মুসল্লিরা সব ধরনের দূষণ থেকে মুক্ত থেকে সমুদ্রের মুক্ত সতেজ হাওয়া উপভোগ করতে পারেন।

মসজিদটি তৈরি করেন রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদের বাবা দ্বিতীয় হাসান। তাই এতে দ্বিতীয় হাসান মসজিদ বলেও ডাকা হয়। মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৮৬ সালে। যদিও ১৯৬১ সালে মরক্কোর পঞ্চম রাজা মোহাম্মদের মৃত্যুর পরপরই এটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এরপর ১৯৮৯ সালে এটি উদ্বোধনের কথা থাকলেও নানান কারণে তা পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৩ সালে মসজিদটি উদ্বোধন করা হয়। আসলে মসজিদটি বাদশাহ দ্বিতীয় হাসানের ৬০তম জন্মদিনে সম্পন্ন করার কথা ছিল। অবশেষে ১১ রবিউল আউয়াল ১৪১৪ হিজরি মোতাবেক ১৯৯৩ সালের ৩০ আগস্ট মসজিদটি উদ্বোধন করা হয়।

আরও পড়তে পারেন-

ইতিহাস-

রাজা দ্বিতীয় হাসানের উদ্যোগে নির্মিত এই মসজিদ কমপ্লেক্সটি ছিল নিম্ন-মধ্য আয় বিশিষ্ট মরক্কোর ইতিহাসের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮০০ মিলিয়ন ডলার, যার যোগান দেওয়া মরক্কোর সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের একটি বিরাট অংশ সংগ্রহ করা হয় দেশের জনগণের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে।
প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ এই মসজিদ নির্মাণের জন্য অর্থের যোগান দেন। তাদের সবাইকে সরকারের পক্ষ থেকে অনুদানের রশিদ এবং একটি করে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়।

সাধারণ মানুষ ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং কুয়েত, সৌদি আরব সহ কিছু আরব রাষ্ট্রও নির্মাণ কাজের অর্থায়নের ব্যাপারে সাহায্য করে। এছাড়াও কিছু পশ্চিমা রাষ্ট্রও এ কাজের জন্য ঋণ প্রদান করে। রাজা চেয়েছিলেন এমন একটি স্থাপনা তৈরি করতে যেটা কিনা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেটা হবে ল্যান্ডমার্ক। শহরের যে কোনো জায়গা থেকেও সেটা দেখা যাবে।

আর সেই চিন্তা থেকেই নির্মাণ করা হয় এই মসজিদটি। আর সেভাবেই এই মসজিদের নকশা করা হয়। নকশা করেন বিখ্যাত ফরাসি স্থপতি মিশেল প্যাঁসো যিনি সেই সময় মরক্কোতেই থাকতেন। এটি নির্মাণে কাজ করেছেন ফরাসি কোম্পানি বয়গিসের কারিগররা।

অপূর্ব কারুকার্য-শোভিত মসজিদ সংলগ্ন মিনারের উচ্চতা ৬৯০ ফুট। যা কিনা ৬০ তলা বিল্ডিংয়ের সমান উঁচু। মসজিদের মিনারটি বর্গাকৃতির। সবুজের প্রাধান্য আছে এমন ক্রোমিয়াম ব্যবহার করা হয়েছে মিনারে। এর ফলে মসজিদটি হয়ে উঠেছে অদ্ভুত সুন্দর। ব্যবহার করা হয়েছে ভিন্নধর্মী সবুজ টাইলস। রোদ আর সাগরের পানির মিশেলে এই সবুজ রং কখনো গাঢ় সবুজ, কখনো ফিরোজা, কখনো নীলচে রঙে বদলে যায়।

বলা হয়ে থাকে এই মিনার তৈরিতে স্থপতি সমুদ্রের ফেনার জন্য সবুজ এবং আকাশের মতো বিশালতার নীল ব্যবহার করেছেন যা কিনা রাজার বিলাসবহুল জীবনের প্রতীকও। মিনারটির চূড়ায় রয়েছে একটি লেজার বিম। যার আলো বিচ্ছুরিত হয় পবিত্র কাবাঘরের দিকে। সমুদ্রে চলাচলকারী বিভিন্ন জাহাজ সেই আলোকরশ্মি ৩০ কিলোমিটার দূর থেকেও দেখতে পান।

বিবরণ-

প্রায় ৯ হেক্টর জমির উপর অবস্থিত মসজিদটির ভেতরে ২৫,০০০ এবং বাইরের চত্বরে আরও ৮০,০০০ মানুষ একসাথে নামাজ আদায় করতে পারে। এতে নারীদের নামাজ আদায়ের জন্য পৃথক একটি বারান্দা আছে, যার ধারণ ক্ষমতা ৫,০০০। মসজিদটির আংশিক মাটির উপর এবং আংশিক পানির উপর ভাসমান। পানির উপরে ভাসমান অংশের মেঝের কিছু স্থান কাঁচের তৈরি, যেখান থেকে মসজিদের নিচে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার দৃশ্য সরাসরি উপভোগ করা যায়। তবে এই সুবিধাটি জনসাধারণের জন্ম উন্মুক্ত নয়, এটি শুধু রাজপরিবারের সদস্যরা এবং নির্বাচিত বিশেষ অতিথিরাই পেয়ে থাকেন।

মসজিদ ছাড়াও এই বিশাল কমপ্লেক্সের মধ্যে আছে একটি মাদ্রাসা, হাম্মাম তথা গোসলখানা, মরক্কোর ইতিহাস সম্বলিত একটি জাদুঘর, একটি কনফারেন্স হল এবং একটি সুবিশাল লাইব্রেরি। শুধুমাত্র মাদ্রাসাটিই ৪,৮৪০ বর্গ মিটারের বিশাল ভূমির উপর অবস্থিত। ভূগর্ভস্থ এক তলা ছাড়াও আরও দুই তলা জুড়ে নির্মিত এই মাদ্রাসাটির আকার অর্ধ-চন্দ্রাকৃতির। মাদ্রাসা, কনফারেন্স হল এবং লাইব্রেরির কক্ষগুলোতে অত্যাধুনিক অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রযুক্তির ব্যবস্থা আছে।

মসজিদের কেন্দ্রীয় হলের ছাদটি দুই পাশে সরে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে যেতে সক্ষম। ৩,৪০০ বর্গ মিটার আকারের এই ছাদটির ১,৭৫০ বর্গ মিটারই উন্মুক্ত হতে পারে। ১,১০০ টন ওজনের এই ছাদটি একটি মোটরের সহায়তায় খুলে যেতে সময় নেয় মাত্র পাঁচ মিনিট।

ছাদটি বন্ধ থাকা অবস্থায় ৫০টি ঝাড়বাতি হলটিকে আলোকিত করে রাখে। দিনের বেলা ছাদটি খুলে দেওয়া হলে মুসল্লীরা খোলা আকাশের নিচে সূর্যের আলোয় আলোকিত হলঘরে নামাজ আদায় করতে পারেন। অথবা রাতের বেলা হলে চাঁদ-তারার কোমল আলো এবং হলরুমের চারপাশের দরজাগুলো থেকে বিচ্ছুরিত আলো হলরুমটিকে আলোকিত রাখে।

উল্লেখ্য, মরক্কোর অনন্যা মসজিদের মতো এই স্থানে কিন্তু অমুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ নয়। বছরভর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা মায়াবী এই ধর্মীয় কেন্দ্রে ভিড় করেন। ভ্রমণের পিপাসা, মনের শান্তি, সর্বশক্তিমানের কাছে নিজেকে মেলে ধরার আশা চরিতার্থ হয় একই জায়গায়।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।