Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ বাইডেনের বিজয় এবং তুর্কি-মার্কিন সম্পর্কের ভবিষ্যত

বাইডেনের বিজয় এবং তুর্কি-মার্কিন সম্পর্কের ভবিষ্যত

।। মাসুম খলিলী ।।

জো বাইডেন গত বুধবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করার পর বৈদেশিক সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে।এই আলোচনায় চীন-রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক কেমন হবে এই বিষয়টির পাশাপাশি বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে আমেরিকান সম্পর্কটি কিভাবে নির্ধারিত হবে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রশ্ন এলে প্রধান যে সব উপাদান আসে তার শীর্ষে থাকে তুরস্কের সাথে সম্পর্কের বিষয়টি। অনেকেই এই সম্পর্কের বিষয়টি বেশ জটিলভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। তবে বিষয়টিকে সহজভাবে তুলে এনেছেন তুর্কি দৈনিক ডেইলি সাবাহ পত্রিকার কলামিস্ট ইয়াহিয়া বোস্টান। এই লেখার মূল বিশ্লেষণ সূত্রটি তার।

বাইডেনের হাতে ক্ষমতার স্থানান্তরের পর তুরস্ক-আমেরিকান সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে আসবে: বাইডেনের অধীনে,এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য কী অপেক্ষায় রয়েছে? এই সম্পর্কের উপর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে অন্য অংশীদারদের সম্পর্কও কমবেশি প্রভাবিত হবে। বিশেষত ইসরাইল সৌদি আরব ইরান এমনকি রাশিয়ার সাথে সম্পর্কও।

একথা ঠিক যে তুরস্ক-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কটি অতীতে বহুবার পরীক্ষার মধ্যে পড়েছে বিশেষত শীতল যুদ্ধের সময় জুড়ে এবং ২০০০ এর দশকে। চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে একটি হ’ল ১৯৭৪ সালে সাইপ্রাসে আঙ্কারার সামরিক হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্তের পর ওয়াশিংটনের অবরোধ আরোপ। তবে, অতীতে তুরস্ক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতায় উল্লেখযোগ্য ব্যবধান, আমেরিকার স্বার্থে ভূমিকার জন্য আঙ্কারার আগ্রহ ও প্রতিশ্রুতি এবং পশ্চিমা বলয়ে থাকার ব্যাপারে তুরস্কের বিশেষ আকাঙ্ক্ষার কারণে আগের স্বার্থসংঘাতগুলি সেভাবে মুখ্য হয়ে উঠেনি।

এসব কারণে তুর্কি-আমেরিকান সম্পর্ককে কিছু মতপার্থক্যের বিষয় থাকা সত্ত্বেও “কৌশলগত অংশীদারিত্ব” হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। স্পষ্টতই, কৌশলগত এই অংশীদারিত্ব একটি নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য গঠিত হয়,তবে এটি এমন একটি সম্পর্ক ছিল যার মধ্যে তুরস্ক গভীরভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল ছিল।

অতীতের চ্যালেঞ্জগুলির বিপরীতে ওবামা প্রশাসনের সময় অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাসহ নানা কারণে সৃষ্ট দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনা ট্রাম্প প্রশাসনের সময় বহাল থাকে এবং ক্ষেত্র বিশেষে তা আরো রবেড়েছে। বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে যা তুরস্ক-আমেরিকান সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা নির্ধারণে সহায়তা করেছে। এক্ষেত্রে বিশ্ব যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তা প্রাথমিকভাবে অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে।

তিন দশক আগে শেষ হওয়া শীতল যুদ্ধে তুরস্কের নীতিগত বিকল্পগুলিকে ব্যাপকভাবে সীমিত ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া এককেন্দ্রীক বিশ্ব ব্যবস্থা গত ১০ বছরে মূলত ভেঙে পড়েছে। বিশ্ব যখন একটি বহুমেরু ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে, তুরস্ক তখন নতুন অবস্থার সুযোগ নিতে একটি “স্বতন্ত্র” বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করছে। তবে, তুরস্ককে শীতল যুদ্ধের মতোই নির্ভরশীল অংশীদার হিসাবে চায় আমেরিকা। নয়তো অন্তত ২০০০ এর দশকের মতো এমন এক অংশীদার হিসাবে দেখতে চায় যা তার স্বার্থকে হুমকির সম্মুখীন না করে মিত্রের ভূমিকা গ্রহণ করবে।

আঙ্কারা স্বতন্ত্র বিদেশ নীতি নেবে নাকি যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল বা সমন্বিত বিদেশ নীতি নেবে তা নিয়ে দুদেশের মধ্যকার এই মৌলিক মতবিরোধটি তুরস্ক-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সমস্ত উত্তেজনার মূলে কাজ করছে।এর বাইরে রাশিয়ার সাথে তুরস্কের সম্পর্ক, এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অথবা এফ -৩৫ যুদ্ধবিমান ইস্যুর মতো অন্য যে কোনও কারণ মৌলিক বিষয় নয়। বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন পিকেকের বিরুদ্ধে তুরস্কের লড়াই এবং এর ইরাক ও সিরিয়া শাখা ওয়াইপিজির বিষয়েও উভয়ের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। যদি এই সমস্ত চ্যালেঞ্জগুলি অতিক্রম করতে হয়, তবে উভয় দেশকে অবশ্যই তাদের সম্পর্কের প্রকৃতির বিষয়ে একমত হতে হবে।

প্রশ্ন হলো তাহলে এটি কীভাবে কাজ করবে? আঙ্কারা চায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বহুমেরু বৈশিষ্ট্যটির বাস্তবতা মেনে নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আর একই সাথে এও মেনে নিবে যে তুরস্কের নিজস্ব নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক ক্ষমতা রয়েছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো তুরস্কও একটি মহাকৌশল অনুসরণ করছে। ওয়াশিংটনের অবশ্যই এই বিষয়টির তাদের নীতি কৌশলের সাথে সমন্বয় ঘটানো উচিত। আঙ্কারার মহকৌশলটি তার স্বার্থ এবং মধ্যপ্রাচ্য, ককেশাস, উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব ভূমধ্যসাগর এবং বলকান অঞ্চল আর তার চারপাশের বন্ধু ও মিত্রদের রক্ষা কেন্দ্রিক। প্রয়োজনে তুর্কিরা তাদের লক্ষ্য অর্জনে আরও আক্রমণাত্মক কৌশলও অবলম্বন করতে চায়। তবে সেটি হয়তো এখন নয় আরও পরে।

আঙ্কারার বিশ্লেষকদের ধারণা, বর্তমান বিষাক্ত অবস্থা থেকে বাইডেন প্রশাসনের অধীনে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অগ্রগতির জন্য, তুরস্ক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের পরষ্পরের গেমপ্লানগুলি বিবেচনা করতে হবে এবং একটি যৌথ কৌশল অবলম্বন করতে হবে যাতে তাদের স্বার্থ সংঘাতপূর্ণ না হয়। তবে ওয়াশিংটনের প্রাথমিক সিগন্যালগুলিতে মনে হয় যে,আমেরিকানরা এখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তুরস্কের নতুন অবস্থান উপলব্ধি করতে পারেনি অথবা গ্রহণ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়।

আরও পড়তে পারেন-

অতি সম্প্রতি, বাইডেনের মনোনীত সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্টনি ব্লিংকেন তুরস্ককে তার “তথাকথিত কৌশলগত অংশীদার” হিসাবে উল্লেখ করেছেন এবং জোর দিয়েছেন যে তুরস্ক এবং রাশিয়ার একই দিকে থাকা গ্রহণযোগ্য নয়। ব্লিনকেন এক্ষেত্রে ঠিক আছেন যে, তুরস্ক ও রাশিয়া বিমান প্রতিরক্ষা এবং পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কিত কৌশলগত বিষয়ে সহযোগিতা করে আসছে। তবে দু’দেশ লিবিয়া, ইদলিব এবং নাগরনো-কারাবাখসহ বেশ কয়েকটি ফ্রন্টে দ্বিমতও পোষণ করেছে। তাদের মতভেদ সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি রেসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং তার রাশিয়ার প্রতিপক্ষ ভ্লাদিমির পুতিন একটি কৌশলগত পন্থা অবলম্বন করেছেন যা সহজতর ঐকমত্যের ক্ষেত্রে নিবিড় সহযোগিতা করে। এই ক্ষেত্রে, মস্কোর সাথে আঙ্কারার সম্পর্কটি কেবল একটি জোট নয়, পারস্পরিক স্বার্থের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সমতার অংশীদারি।

আঙ্কারার বিশ্লেষকরা মনে করেন, তুর্কি-রাশিয়ান চুক্তির বর্তমান আবস্থাটি আজ তুর্কিদের সাথে কীভাবে যুক্ত থাকতে পারে সে সম্পর্কে বাইডেন প্রশাসনের মানদন্ড হিসাবে কাজ করতে পারে।প্রশ্ন হলো ওয়াশিংটনের নীতি প্রণেতারা কি এ জন্য প্রস্তুত রয়েছেন? তুরস্কের সাথে সম্পর্কের বিষয়টির সাথে ইসরাইলের সাথে আমেরিকান সম্পর্কের সমীকরণ স্বাভাবিকভাবে চলে আসবে।ইসরাইল হলো আমেরিকার প্রধান কৌশলগত মিত্র মধ্যপ্রাচ্যে।
ট্রাম্প প্রশাসন এক্ষেত্রে ইসরাইলের স্বার্থকে আমেরিকান স্বার্থে পরিণত করে ফেলেছিলেন দৃশ্যমানভাবে। কিন্তু এই নীতিকে যতই নগ্নভাবে দেখা হোক না কেন গভীরভাবে তাকালে স্পষ্ট হবে এটি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে অনুসৃত দীর্ঘ মেয়াদি নীতির সাথে সাংঘর্ষিক নয়। ওবামা এমনকি জুনিয়র বুশও এই নীতিই অনুসরণ করেছিলেন। বাইডেন প্রশাসন এর মধ্যেই ঘোষণা করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী জেরুসালেমেই থাকবে।

ইরানের সাথে বাইডেন প্রশাসনের সম্পর্ক কিছুটা নমনয়ি হতে পারে।কিন্তু সেটির মাত্রা কতটা আগাবে সেটি নির্ভর করবে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে সমঝোতার ধরন কেমন হয় তার উপর।

ইসরাইল আমিরাত তথা ইসরাইলকে স্বীকৃতিদাতাদের যে জোট সেটিকে এগিয়ে নিতে হলে আমেরিকান সমর্থন লাগবে। সেই সমর্থন কতটা বাইডেন প্রশাসন দেবে সেটি কিছুটা সংশয়ের মধ্যে রয়েছে। তবে তুরস্ক একটি স্বতন্ত্র নীতি নির্ধারকদের যে জোট মধ্যপন্থী ইসলামি দেশগুলোকে নিয়ে গঠন করতে চাইছে সেটি আগামী দিনের মুসলিম বিশ্বের ধরন নিরূপণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

– মাসুম খলিলী, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বার্তা সম্পাদক- দৈনিক নয়া দিগন্ত।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।