Home ইতিহাস ও জীবনী এসমাহান সুলতান মসজিদ: রোমানিয়ার বুকে তূর্কী ইতিহাসের নাম

এসমাহান সুলতান মসজিদ: রোমানিয়ার বুকে তূর্কী ইতিহাসের নাম

‘মাঙ্গালিয়ায় যাচ্ছ তো? রোমানিয়ার মক্কা ঐ শহরকেই বলা হয়।’

সদ্য কফির কাপে চুমুক দিতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ তারেকের এই মন্তব্যে বিষম খেলাম যেন। আমি জানি দক্ষিণ পুর্ব রোমানিয়ার মাঙ্গালিয়া শহরে প্রাচীনতম এসমাহান সুলতান মসজিদ অবস্থিত। আমি জানি এই মসজিদ প্রাচীন রোমানিয়ার সঙ্গে ইসলামের সংযোগের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। কিন্তু কখনও ভাবিনি মক্কার সঙ্গে মাঙ্গালিয়ার তুলনা শুনতে হবে।

ইসমিহান সুলতান, যাঁর নাম থেকেই এসমাহান সুলতান মসজিদের নাম, আসলে ছিলেন একজন অটোমান রাজকন্যা। ১৫৪৫ সালে তুরস্কের তৎকালীন সম্রাট দ্বিতীয় সেলিম ও তাঁর স্ত্রী নূরবানু সুলতানের ঘরে তাঁর জন্ম। ছোট থেকেই তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও যুক্তিবাদী।

এর পিছনে তাঁর মা নূরবানুর ভূমিকা অনস্বীকার্য। অটোমান সাম্রাজ্যে মেয়েদের অধিকার কায়েম করার পিছনে নূরবানু ছিলেন প্রাথমিক উপদেষ্টা। তাঁরই সুযোগ্য মেয়ে ইসমিহান ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে সিদ্ধান্ত নেন রোমানিয়ার তূর্কী ও তাতার মুসলমানদের জন্য এই মসজিদ তৈরি করার।

আরও পড়তে পারেন-

আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল রোমানিয়ার বিস্মৃত ইসলামী ইতিহাস খুঁজে বের করা, আর আমার ধারণা ছিল আমার এই অন্বেষণে উত্তরের থেকে প্রশ্ন উঠে আসবে অনেক বেশি। কিন্তু লুতফির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমার এই ধারণা  সম্পূর্ণ পালটে গেল।

আমি রোমানিয়ার ইসলামী ইতিহাস নিয়ে কাজ করছি জানতে পেরে লুতফি নিজেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ষাটোর্ধ্ব এই মানুষটি তূর্কী বংশজাত। রোমানিয়ায় যে সমস্ত অটোমান তূর্কী বসবাস শুরু করেছিল তাঁদের মধ্যে একজন লুতফির পূর্বপুরুষ। সুতরাং বলা যায়, লুতফি হল সেই ইতিহাস যার অন্বেষণে আমার এখানে আসা।

এসমাহান সুলতান মসজিদ এর ছবির ফলাফল

রোমানিয়া ও তূর্কী অতীত

এসমাহান সুলতান মসজিদের মধ্যে একসঙ্গে জোহরের নমাজ আদায় করার পর লুতফি আর আমি বাইরের বাগানে এলাম। মসজিদের বাগানে অজস্র গাছ, ফুলের ভারে অবনত ডালের নীচে একের পর এক তূর্কী কবরের ফলক। ৩০০ বছরের অতীতের ছাপ তাদের শরীরে। জরাগ্রস্থতার মধ্যেও যেন ফিসফিস করে ইতিহাসের খতিয়ান দিয়ে যাচ্ছে সেগুলো।

বেশিরভাগ ফলকের গায়েই আরবীতে স্পষ্ট ভাবে নাম ও পরিচয় লেখা।

বর্তমানে এক প্রভাবশালী ও ধনী তূর্কী ব্যবসায়ী সৈয়দ ইসমাইল হাক্কি বে এই মসজিদের উন্নতিকল্পে অর্থ প্রদান করেন। তিনিই মসজিদের সামনে প্রতিষ্ঠাতা ইসমিহান সুলতান ও তাঁর শৌহর সোকোল্লু মেহমেত পাশার সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া ফলক স্থাপন করেছেন।

মেহমেত পাশা অটোমান তূর্কী সাম্রাজ্যের অন্ত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন উজির ছিলেন। বসনিয়ার সোকোলোভিচি নামক ছোট্ট এক গ্রামে এক ক্যাথলিক পশুপালকের ঘরে তাঁর জন্ম। দশ বছর বয়সে অটোমান তূর্কীরা ‘ব্লাড ট্যাক্স’ হিসাবে তাঁকে হরণ করে নিয়ে যায় ও নিজেদের সৈন্যদলে নিযুক্ত করে। সেই শুরু, তারপর পঞ্চাশ বছর ধরে অটোমান তূর্কীদের উজির হিসাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছেন তিনি।

ইসমিহান ভালবেসেছিলেন এই উজিরকে, তাই খানিক পরিবারের অমতেই বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু, ইসমিহানের পিতা যখন মসনদে বসেন, তখন থেকে পুরো অটোমান সাম্রাজ্য চালানোর দায়িত্ব ছিল মেহমেত পাশারই। একদিকে সাম্রাজ্য আরেকদিকে পরিবার, দুইদিকেই ছিল তাঁর সমান নজর। তাঁর উৎসাহেই এই মসজিদ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন রাজকন্যা ইসমিহান।

এসমাহান সুলতান মসজিদের বর্তমান অবস্থা

১৯৯০ সালের আগে পর্যন্ত এই মসজিদ খানিক অবহেলিত ছিল। কিন্তু তারপর একের পর এক প্রভাবশালী তূর্কী ব্যবসায়ী এই মসজিদের উন্নতিকল্পে এগিয়ে আসেন। বর্তমানে প্রায় ৮০০ মুসলমান পরিবারের প্রার্থনার জায়গা এই মসজিদ। এছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে টুরিস্টরাও আসেন এই মসজিদ দর্শন করতে।

মিনারের চুড়োয় তখন শেষ বিকেলের রোদ্দুর চকচক করছে। সেদিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে ছিলেন লুতফি। আমি নিঃশব্দে পাশে গিয়ে বসলাম। না, এসমাহান সুলতান মসজিদকে আমার রোমানিয়ার মক্কা মনে হয়নি। তবে মনে হয়েছে এমন এক পবিত্র স্থান যেখানে লুকিয়ে রয়েছে স্বয়ংসম্পূর্ণ ইতিহাস।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।