Home পরিবার ও সমাজ সহনশীলতার সংস্কৃতি

সহনশীলতার সংস্কৃতি

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘মানুষ’ শিরোনামের কবিতায় ধর্মান্ধ ভণ্ড ও লোভাতুর একটি সমাজের চিত্র এঁকেছিলেন। সেই সমাজের পুরোহিত কিংবা মৌলভীর কাছে ধর্মের বাহ্যিক খোলসটাই সব, এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সেখানে উপেক্ষিত। ব্যবসায়ীর ধর্মপুঁজির গুরুত্ব মানুষের মর্যাদার তুলনায় নগণ্য। কবিতার মূল প্রতিপাদ্য, ক্ষুধাতুর মুসাফির হিন্দু পুরোহিতের কাছে কাতর হয়ে খাবার প্রার্থনা করে প্রত্যাখ্যাত হন, অনুরূপভাবে মসজিদে শিরনির অঢেল গোশত রুটি থাকা সত্ত্বেও প্রত্যাখ্যাত হন।

বাংলাদেশে ধর্ম-বর্ণ-জাতপাত এবং পেশার ঊর্ধ্বে উঠে একটি সর্বজনীন চিরায়ত সংস্কৃতির চর্চা বহু পুরনো। এর ওপর গড়ে উঠেছে একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। এ জন্য এ অঞ্চলের মানুষ হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান-খ্রিষ্টানে কোনো বৈষম্য করে না। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সবাই সমান সুবিধা ভোগ করতে পারেন। অথচ প্রতিবেশী ভারতে এমনটি দেখা যায় না।

আমাদের জীবন-জীবিকার প্রধানতম উৎস কৃষি। এ জাতির জীবন-জীবিকা আবর্তিত হয় নদীর প্রবাহের তালে তালে। নদী ভাটি বাংলার মানুষকে জীবন-জীবিকার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। এ অঞ্চলের মানুষের ব্যবসাবাণিজ্য নদীকেন্দ্রিক, আধুনিককালের কল-কারখানাও নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে। নদীতে ভেসে আসা পলিতে এ দেশের মানুষ চাষবাস করে ফসল ফলান। এই পলি, এই চর সর্বজনীন এক আশীর্বাদস্বরূপ। পারস্পরিক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে সব ধরনের ভেদ-অভেদের ঊর্ধ্বে উঠে চাষবাস করি। সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিই আমাদের মূলমন্ত্র।

আরও পড়তে পারেন-

নদীভাঙন, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাসে ভুক্তভোগীরা শুধু মর্মবেদনা ভোগ করে না, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাস্তুহারা মানুষ একে অন্যের বাড়ি নির্মাণ করে দেন। ভাটিয়ালি, জারি-সারি গান নদীকেন্দ্রিক। আমাদের পোশাক-আশাকের অভ্যাস গড়ে উঠছে শ্রমের সাথে মিলিয়ে। পূর্ব বাংলা পশ্চিমের অভিজাত সমাজের কাছে বিবেচনায় যতই ‘খামার বাংলা’ কিংবা এখানকার মানুষ যতই তাদের ‘লাইভস্টক’ অভিধায় তিরস্কৃত হোন না কেন, এ মানুষের চিরায়ত সর্বজনীন ঐতিহ্য হচ্ছে, মানবিক গুণে গুণান্বিত হয়ে ওঠা। কিন্তু সেই মানবিক সমাজ আজ বহুধাবিভক্ত। প্রতিহিংসার রাজনীতিই এর জন্য দায়ী। ‘রাজনীতি’ মানে ‘নীতির রাজা’; তাই একে আমরা সমীহ করি। রাজনৈতিক ‘সম্প্রীতি’ আমাদের বহু বছরের সমৃদ্ধ সামাজিক ঐতিহ্য ছিল। কোনো কারণে এ সম্প্রীতি ও ভালোবাসা ধ্বংস হোক, এ আমরা চাই না। এ না চাওয়ার মধ্যেও অবচেতনভাবেই আমাদের শরীর ও আত্মা দুষ্ট রাজনীতির ফাঁদে আবর্তিত হচ্ছে। সামাজিক সৌহার্দ্য আজ রাজনীতির ‘অজগরের’ পেটে ঢুকে পড়েছে। তাই আমরা ভাইকেও খুন করতে উদ্যত হচ্ছি।

একে অন্যের ঘাড় মটকে দেয়ার কিংবা পরস্পরবিরোধী ভয়ঙ্কর উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছি প্রতিনিয়ত। এটি কোনোভাবেই বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই সবাইকে ঐক্যের বন্ধনে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ হতে হবে। কিন্তু এই পথ সহজ নয়।

কথাশিল্পী বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র শেষ কটি লাইন মনে প্রতিনিয়তই প্রবল দোলা দেয়। বাবার মৃত্যুর পর উপন্যাসের নায়ক ‘অপু’ ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণার্থে স্বগ্রাম ত্যাগ করে যখন কোনো এক দূর গ্রামে অবস্থান করছিল, তখন তার সমস্ত অন্তরাত্মা হাহাকার করে বলে উঠেছিল, ‘তিন বছর কত কাল! আমাদের যেন সেই নিশ্চিন্দিপুর ফেরা হয় ভগবান।’ পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলিলেন, মূর্খ বালক পথ তোমার শেষ হয় নাই, এ যে সেই পথ, এ পথ খুব দীর্ঘ’।

– সৈয়দ মুনতাজিম আলী বখতিয়ার
E-mail: syedmultazimali@gmail.com

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।