Home সোশ্যাল মিডিয়া বক্তা-চুক্তি-টাকা: সমস্যার সমাধান সময়ের দাবী

বক্তা-চুক্তি-টাকা: সমস্যার সমাধান সময়ের দাবী

।। জুনাইদ আহমাদ ।।

বাংলাদেশে শীতের মৌসুমে শহর গ্রাম এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন হয়। যা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এতো ব্যাপকভাবে প্রচলিত নয়। মাহফিলে ওলামায়ে কেরাম বিষয় ভিত্তিক ওয়াজ করেন। তাদের বিষয় ভিত্তিক বয়ান শুনে ধর্মপ্রাণ মানুষ ইসলামের বিরুদ্ধে চলমান নানা ষড়যন্ত্র, ঈমান বিধ্বংসী ফিৎনা ইত্যাদি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হন। নিজের ঈমান-আকিদা রক্ষায় সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি আমালের ব্যাপারেও যত্নবান হন মাহফিলে আসা ধর্মপ্রাণ শ্রোতাবৃন্দ।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আয়োজক ও বক্তাদের নানা অসঙ্গতির কারণে বর্তমান যুগের ওয়াজ-মাহফিলগুলো প্রায় নিছক একটি প্রথা ও বার্ষিক অনুষ্ঠান পালনের রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে।

অতীতের মাহফিলগুলোর অভূতপূর্ব প্রভাব এখনকার মাহফিলগুলোতে আর নেই। বক্তাদের প্রতিটি কথা ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা লুফে নিয়ে আমলে পরিণত করতেন। তাদের সাদামাটা সহজ-সরল লৌকিকতাহীন সে ওয়াজগুলো ইসলামের প্রচার-প্রসার ও সমাজ সংস্কারে ব্যাপক প্রভাব রাখতো।

এখন আয়োজকবৃন্দের মানসিকতা এমন যে, সুন্দর সুর-কণ্ঠ, মাঠ কাঁপানো কন্টাক্টকারী বক্তাদের দাওয়াত না দিলে মাহফিল জমানো যাবে না। যে কারণে আমাদের বর্তমানের মাহফিলগুলো আগের মতো সেই প্রভাবময় নয়। মানুষের হিদায়াতের চেয়ে অযথা টাকা খরচ ও বিনোদন বেশি হচ্ছে।

শ্রোতা ও আয়োজকদের মানসিকতার প্রেক্ষিতে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, বর্তমানে অনেক বক্তার চাহিদা পূরণে থাকছে ডজনখানেক শর্ত। বক্তা কীভাবে আরামে আসবেন, কী কী খাবেন, যাওয়ার সময় হাদিয়া তোহফা কত দেওয়া হবে ইত্যাদি নানা শর্ত। এমন শত শর্ত মেনেও মাহফিলের আয়োজন করছে কর্তৃপক্ষ।

নিশ্চিত উপস্থিত হতে পারবেনা জেনেও একই তারিখে একাধিক মাহফিল রাখা, মোটা অংকের টাকা চুক্তির বিনিময়ে মাহফিলে উপস্থিত হওয়া, অন্য প্রোগ্রামে টাকা বেশি পাওয়ার আশ্বাস পেলে সাতপাঁচ বলে পূর্বের প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করে দেওয়া, অগ্রীম টাকা নিয়েও মাহফিলে হাজির না হওয়া সহ নানা সমস্যা এখন যেন মহামারী আকার ধারণ করেছে।

এখন ওয়াজের মাহফিলগুলো আওয়াজের মাহফিলে পরিণত হয়েছে। নির্ধারিত বিষয়ে কুরআন সুন্নাহের আলোকে আলোচনা করেন এমন ওয়ায়েজের সংখ্যা নিতান্তই কম। অনেক ওয়ায়েজ ঘন্টা, দেড় ঘন্টার ওয়াজেও কুরআন শরীফের দু’চারটা আয়াতের সহজ সাবলীল তরজমা, তাফসীর, দুএকটা হাদীসের অনুবাদ বলার সুযোগ পান না। বানোয়াট, অহেতুক কিচ্ছা কাহিনি আর সাতপাঁচ বলতে বলতেই ওয়াজের নির্ধারিত টাইম শেষ হয়ে যায়।

এর ভিন্ন চিত্রও আছে। বহু আয়োজক জনপ্রিয় বক্তাদের নাম ব্যবহার করে বিশাল অংকের টাকা কালেকশন করলেও বক্তাকে গাড়িভাড়া সহ সামান্য হাদিয়া দিতেও কষ্ট পান। অনেক সময় দেখা যায়-বক্তাকে এতো অল্প টাকা দেন যা তাঁর গাড়ি ভাড়াও হয় না। যার নাম ব্যবহার করে এতো টাকা কালেকশন করা হলো তাঁকে প্রয়োজনীয় টাকা দিতে এতো সাতপাঁচ কেন? নিজের মূল্যবান সময় নিয়ে, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একজন বক্তা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ওয়াজ-মাহফিলে উপস্থিত হন। সে হিসেবে তাঁর যাতায়াত খরচ সহ যথাযথ সম্মানী দেওয়া মাহফিল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। কিন্তু কিছু জায়গায় মাহফিল কর্তৃপক্ষ একজন বক্তাকে দাওয়াত করে এনে বয়ান করানোর পর গা ঢাকা দেন। এমনকি সাক্ষাতও করেন না। ফোন অফ রাখেন ইত্যাদি। তাই অনেক সময় মাহফিল আয়োজকদের প্রতারণার শিকার হয়ে বক্তাগণও নানা শর্ত আরোপ করতে বাধ্য হন।

মাহফিলের আয়োজক যখন বক্তাকে বলেন- হুজুর! আমাদের এলাকার হাজারো-লাখো মানুষ আপনার ভক্ত। আপনি ছাড়া মাহফিলই হবে না। আপনি যখন তারিখ দিবেন তখনি মাহফিল হবে। আপনাকে আনতে যত টাকা লাগুক আমরা ব্যবস্থা করতে রাজি আছি, এটা কোন সমস্যা নয়। আয়োজক বৃন্দের এই বয়ান শুনার পরই বক্তা সাহেব লাখ টাকার চুক্তি করেন। তিনি মনে করেন- আমার কোটি কোটি ভক্ত থেকে মাত্র লাখ টাকার চুক্তি করমু, এ তো অতি সাধারণ বিষয়।

তবে পণ্য কেনা বেচার মত দরদাম করে, বায়না বা অগ্রিম বুকিং মানি নিয়ে তারপর পেমেন্টের জন্য সিস্টেম ধরিয়ে দেয়ার পদ্ধতি কখনই ওলামায়ে কেরামের শান-ইজ্জতের সাথে মানানসই নয় ৷ এই জাতীয় আচরণ পরিহার করা জরূরী ৷

চুক্তি একপক্ষীয় হয় না বরং উভয় পক্ষের সম্মতিতেই হয়। নেব, দেবো এ দুয়ের মধ্যেই চুক্তি। মাহফিল কর্তৃপক্ষ আগেভাগে “দেবো” অফার না দিলে বক্তারাও এতো টাকা “নেবো” কথার চুক্তি করার সাহস পেতেন না। বক্তা- আয়োজক পক্ষ একে অপরকে চুক্তি শিখিয়ে আজ ওয়াজের ময়দানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।

প্রাণপ্রিয় শায়েখ আমীরে হেফাজত আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী হাফিযাহুল্লাহু হাটহাজারী মাদরাসায় দাওরায়ে হাদীসের দুই সহস্রাধিক ছাত্রকে বুখারি শরীফের পাঠদানকালে প্রায়-ই নসিহত করেন যে, টাকা-পয়সা চুক্তি করে কোন ওয়াজ-মাহফিল করবেন না। জাল হাদীস, বানোয়াট কল্পকাহিনি না বলে কুরআন হাদীস গবেষণা করে নির্ধারিত বিষয়ের উপর বয়ান করবেন। মাহফিল কর্তৃপক্ষ মাইকিং পোস্টারিং সহ প্রচার-প্রচারণা করে শ্রোতা উপস্থিত করে ওলামায়ে কেরামকে সেই স্টেইজে বয়ান করার, দ্বীনের দাওয়াহ পেশ করার সুযোগ করে দেন। এটাকে আপনারা সৌভাগ্যের বিষয় মনে করবেন। আয়োজকবৃন্দ কষ্ট করে মাহফিলের আয়োজন না করলে হাজার হাজার মানুষের মজলিসে বয়ান করার সুযোগ আপনারা পেতেন না। তাই ওয়াজ-মাহফিলে কোন ধরনের চুক্তি না করে উম্মাহর মাঝে দ্বীনের দাওয়াত পৌছানো আপনাদের (ওলামায়ে কেরামের) দায়িত্ব ও জিম্মাদারী মনে করে উপস্থিত হবেন।

বাস্তবেই আজ যদি বক্তাগণ এসব নসিহত অনুযায়ী আমাল করতেন তাহলে চলমান এসব সমস্যার সৃষ্টি হতো না।

আমাদের যেই বক্তা মোটা অংকের টাকা ছাড়া প্রোগ্রাম রাখেন না সেই বক্তাকেই কেন দাওয়াত দিতে হবে? সেই বক্তাকে বয়কট করা যায় না? সেই বক্তা ছাড়া মাহফিল হয় না? চুক্তি করা বক্তাদের কয়েক মাহফিলে বয়কট করা হলে এক সপ্তাহের মধ্যে “চুক্তি” ছাড়তে বাধ্য হবেন।

বক্তা ও আয়োজকদের চিন্তা ও কর্মগত এসব সমস্যার সমাধান সময়ের অপরিহার্য দাবী। এখনি এসব সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান না হলে ভবিষ্যতে সকল ওয়াজ-মাহফিল ও বক্তারা মানুষের আস্থা হারাবে। তাই সমস্যার নিরসনে শ্রোতা, আয়োজক ও সম্মানিত দীনি ভাইদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি প্রস্তাবনা পেশ করছি—

  • মাহফিলগুলো যাতে করে রেওয়াজ ও লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।
  • ইলম, আমলওয়ালা বুজুর্গ উলামায়ে কেরামকে মাহফিলে দাওয়াতের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিন।
  • যাঁরা চুক্তি করেন তাঁদেরকে দাওয়াত দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
  • একান্তই দাওয়াত দিতে হলে সর্বজন শ্রদ্ধেয় স্থানীয় কোন বড় আলেম বা মুরব্বির মাধ্যমে দাওয়াত দেওয়া যেতে পারে। তাহলে সেই বড় আলেম/ মুরুব্বির সম্মানের ভয়ে হলেও চুক্তি করা থেকে বিরত থাকবে।
  • চুক্তি করে যারা বয়ান করেন দলিল-প্রমাণ সহ তাদের নামের একটা লিস্ট শীর্ষ উলামায়ে কেরামের কাছে দেওয়া যেতে পারে এবং তাঁরা তাদেরকে ডেকে চুক্তি ছাড়ার বিষয়টি গুরুত্বারোপ করলে ওয়াজ-মাহফিলে চুক্তি বাণিজ্য বন্ধ হতে পারে।
  • বক্তাদের চুক্তির নামে বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘনের শরঈ বিধান কী তা দেশের সকল ফতোয়া বিভাগ থেকে একযোগে প্রচারিত হতে পারে।
  • ওয়ায়েজিনদের সংগঠন বক্তাদের চুক্তি বন্ধে কঠোর নীতিমালা গ্রহণ করতে পারে।

লেখক: তরুণ আলেম, শিক্ষার্থী, ইসলামী আইন ও গবেষণা বিভাগ, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম এবং সভাপতি- জাতীয় লেখক পরিষদ, হাটহাজারী উপজেলা শাখা।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।