Home ইতিহাস ও জীবনী মসজিদ চৌবিন: ইরানের কাঠের মসজিদের ইতিহাস

মসজিদ চৌবিন: ইরানের কাঠের মসজিদের ইতিহাস

“আজ তোমাকে এমন একটা মসজিদে নিয়ে যাব, যা কক্ষনো দেখনি। কল্পনাও করনি এরকম মসজিদ আছে।” হাসতে হাসতে আমাকে বলল আমার ইরানী বন্ধু রাদিন। সালটা ২০১৮, রাদিনের বহু ডাকাডাকির পর শেষ পর্যন্ত আমি ওর দেশ ইরানে ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম। ওর বাড়ি খোরাসানের নেয়শাবুর শহরে। সেখানেই একদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে এই কথোপকথের সূচনা।

“তাই? কী এমন রয়েছে সেই মসজিদে? বেহেস্তের বাগান? দুধের নদী?” আমিও পালটা প্রশ্ন করলাম মজার ছলে।

“এক্কেবারে না, কিন্তু মসজিদের গঠন দেখে তোমার চোখে ধাঁধা লেগে যাবে। স্থানীয়রা এই মসজিদটিকে বলে চৌবিন মসজিদ।”

এখন পারসিকে “চৌবিন” শব্দের অর্থ যে কাঠ, তা আমার জানা ছিল। কৌতূহলী হয়ে পরের প্রশ্নটা করেই ফেললাম, “কাঠ নিয়ে কিছু?”

আরও পড়তে পারেন-

“আজ্ঞে হ্যাঁ দোস্ত, মসজিদটা সম্পুর্ণ কাঠের তৈরি।”

সত্যিই সেই অর্থে দেখতে গেলে সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে বানানো মসজিদ বিশ্বের প্রায় কোথাওই দেখা যায় না। কিন্তু মসজিদ চৌবিন-এ  পা রাখার পর আমি অনুভব করলাম, সেটাই শুধু এটির বৈশিষ্ট্য নয়। গোটা মসজিদ জুড়ে যেন ছড়িয়ে রয়েছে ইসলামী স্থাপত্য সৌন্দর্যের অনুপম ছোঁয়া।

Wooden Mosque - Wikipedia

কোথায় অবস্থিত এই প্রাচীন মসজিদ চৌবিন ?

নেয়শাবুর যেন রূপকথা থেকে উঠে আসা শহর। সেখানেই অবস্থিত এই বিখ্যাত কাষ্ঠ মসজিদ। সাসানিদ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শাসক শাপুর এই শহর পত্তন করেন। ২৪০ থেকে ২৭০ অব্দ পর্যন্ত ছিল তাঁর শাসনকাল। নিজের হাতে পত্তন করে শহর বলে বহু যত্ন নিয়ে নেয়শাবুরকে গড়েছিলেন এই সাসানিদ শাসক। অতঃপর, দশম শতকের প্রথম ভাগে তাহিরিদ সাম্রাজ্যের রাজধানী হয় এই শহর।

এই বংশের অন্যতম সেরা শাসক আবদুল্লা তাহিরের শাসনকালে, অর্থাৎ ৮৩০ অব্দে নেয়শাবুরের প্রভূত উন্নতি হয়। পরবর্তীকালে, ১০৩৭ অব্দে, সেলজুক সাম্রাজ্যের তুঘ্রিল এই শহরকে নিজের রাজধানী হিসাবে গণ্য করেন। এতবার এত সাম্রাজ্যের প্রধান শহর ও রাজধানী হওয়ার কারণে নেয়শাবুর সংস্কৃতির দিক থেকে অত্যন্ত উন্নত ও বহুমুখী। শুধু তাই নয়, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসাবেও এই শহরের অসম্ভব গুরুত্ব ছিল প্রাচীন ইরানে। মার্ভ, হেরাত ও বলখের মত নেয়শাবুরও খোরাসানের বিখ্যাত শহর হিসাবে পরিচিত হতে শুরু করে।

দশম শতকে, সামানাইদ সাম্রাজ্যের সময় নেয়শাবুরের রেনেসাঁ ঘটেছিল বলা যায়। কিন্তু, ১২২০ সনে মঙ্গোল আক্রমণে এই শহর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।

নেয়শাবুরের কাঠের পৃথিবী

কথিত আছে, নেয়শাবুরের সকাল, বাগদাদের সন্ধ্যে আর কায়রোর রাত যে দেখেছে, সে নিজের জীবনের মোক্ষ লাভ করেছে। যদিও, আমার ভাগ্যে শুধু কায়রোর রাত দর্শনই জুটেছিল এতদিন, রাদিনের বদান্যতায় নেয়শাবুরের সকাল দেখাও হয়ে গেল। সূর্য তখন ডিমের কুসুমের মতো আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে আস্তে আস্তে শহরের বুকে। আমি আর রাদিন ধীরপায়ে টিলা বেয়ে উঠতে শুরু করলাম।

মসজিদে পৌঁছে বুঝতে পারলাম, শুধু মসজিদটি নয়, নেয়শাবুরের যে অঞ্চলে এটি অবস্থিত সেই ছোট্ট জনবসতিটিও সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি। বাড়ি, দোকান, বেকারি, এমনকি একটা ছোট্ট সংগ্রহশালা… কাঠের তৈরি গড়ন দেখে মনে হচ্ছিল নিখুঁত কোণও পৃথিবীতে এসে পড়েছি। রাদিন জানালো, এই বাড়িগুলি ৮ রিখটার স্কেল পর্যন্ত ভূমিকম্প সহ্য করতে পারে।

চৌবিন মসজিদের সৌন্দর্য

প্রথমেই নজর টানবে মসজিদের অপূর্ব দুটি মিনার। প্রত্যেকটি ১৩ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট, মাথায় ছোট কৌণিক আকৃতির ডোম রয়েছে। প্রধান হল বা আইওইয়ানের আয়তন প্রায় ২০০ বর্গ কিলোমিটার। রাদিনের থেকে জানা গেল, প্রায় দুই বছর সময় নিয়ে অজস্র মালবেরই, ওয়ালনাট, পাইন ও চেরি গাছের কাঠ দিয়ে এই মসজিদ তৈরি। মসজিদের মধ্যে কিন্তু কোনও থাম নেই। তবে, ইরানীয় স্থপতি হামিদ মোজতাহেদির সবচেয়ে দুঃসাধ্য কাজ ছিল মসজিদ সহ গোটা জনবসতিকে ঘুণপোকার হাত থেকে রক্ষা করা।

আমি আর রাদিন মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করলাম। ফাঁকা উপাসনা গৃহ, অদ্ভুত শান্তিপূর্ণ এক নৈঃশব্দ্য। রাদিনের দিকে তাকিয়ে দেখি সে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করছে।

চৌবিন মসজিদের শান্তিপূর্ণ নৈঃশব্দে যেন নতুন করে বুঝলাম, আল্লাহ তায়লার প্রদেয় এই ইসলাম ধর্ম আসলে কতখানি শান্তির প্রতীক।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।