Home ইতিহাস ও জীবনী পারস্যের নান: ইসলামি খাবারের ঐতিহ্যের এক আখ্যান

পারস্যের নান: ইসলামি খাবারের ঐতিহ্যের এক আখ্যান

পারস্যের নান! ‘নান’ বা যাকে ইংরাজিতে বলা হয় ‘ফ্ল্যাটব্রেড’, সেই রুটির সঙ্গে আপনারা অনেকেই পরিচিত। ভারতীয় উপমহাদেশে নান খুব জনপ্রিয় একটি খাবার। রুটিজাতীয় এই নান দিয়ে কাবাবই বলুন, কী চাপ, রেজালাই বলুন, খেতে দারুণ লাগে। কিন্তু পারস্যের নান কী, অন্যান্য দেশের নানরুটির চেয়ে সেটা কোথায় আলাদা, সে কথা আপনারা অনেকেই জানেন না।

পারস্য অর্থাৎ বর্তমান ইরানে এই নান সাধারণ লোকমুখে ‘নুন’ নামেই পরিচিত। এমনিতেই সারা পৃথিবী জুড়েই ময়দা দিয়ে নানাভাবে পাউরুটি বা রুটিজাতীয় খাবার তৈরি করা হয়। দেশ-কাল ভেদে কখনও তার আকার যায় বদলে, কখনও তার রান্নার প্রক্রিয়াতেও আসে পরিবর্তন। ফলে বদলে যায় স্বাদ, গন্ধ, ফ্লেভার! ইসলামিক ঐতিহ্যে এইধরনের রুটিজাতীয় খাবারের বিশেষ স্থান রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল ইরানের এই ‘নান’।

বর্বর লোকেদের খাবার ‘নুন বারবেরি’!

ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশগুলিতে, যেমন ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশে সাধারণত যে নান রুটির সঙ্গে আপনারা পরিচিত, সেই রুটির আকার হয় ছোট। কিন্তু পারস্যের এই ‘নুন’-এর আকার দেখলে আপনারা অবাক হতে বাধ্য। বেশ বড় সাইজের এই নান আয়তনে প্রায় আড়াই ফুট বাই একফুটের কাছাকাছি। আর এই নান রুটি ঘরে আনলেই সারা ঘর সুন্দর গন্ধে ভরে ওঠে। এগুলিকে সে দেশের স্থানীয় মানুষজন ‘নুন বারবেরি’ বলে থাকেন।

আরও পড়তে পারেন-

কিন্তু কেন এই নাম? জানা যায়, ইরানের পূর্বাঞ্চলে খোরাসানে ‘হজারা’ নামে এক জনগোষ্ঠীর বাস। প্রাচীনকালে পারস্যের মূল ভূখণ্ডে বসবাসকারী মানুষদের কাছে এই হজারা জনগোষ্ঠীকে ‘অসভ্য’, ‘বর্বর’ বলেই পরিচিত ছিল। পারসিক ভাষায় এই বর্বরকে বলা হত ‘বারবের’। পরবর্তীকালে এই দুই জনগোষ্ঠীর মানুষ কাছাকাছি চলে আসে। শুরু হয় তাদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান। এই ‘বারবের’ জনগোষ্ঠীর প্রিয় খাদ্য ছিল এইধরনের মোটা রুটি। তাদের হাত ধরে ১৮ বা ১৯ শতক নাগাদ ইরানের মূল ভূখণ্ডে পারস্যের নান বা ‘নুন’ আস্তে-আস্তে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ‘বারবেরি’ জনগোষ্ঠীর তৈরি হালকা নোনতা ও মিষ্টি স্বাদের মোটা-মোটা রুটি তারপর পারস্যে ‘বারবেরি’ রূপে পরিচিত হয়ে ওঠে।

পারস্যের নান: আরও রকমফের

‘বারবেরি’ ছাড়াও ইরানে আরও নানাধরনের রুটি বা ‘ফ্ল্যাটব্রেড’ পাওয়া যায়। এরই মধ্যে একটি হল ‘লাভোশ’। এই রুটির উৎপত্তি আরমেনিয়াতে। এগুলি ‘বারবেরি’র তুলনায় বেশ পাতলা, এবং এর গায়ে ফুটো-ফুটো থাকে। পাতলা এই ‘লাভোশ’-গুলিকে সহজেই মুড়ে বা রোল পাকিয়ে ফেলা যায়। কিমা করা মাংস, পেঁয়াজকুচি, টমেটো ও ক্যাপসিকাম ভিতরে দিয়ে এই রুটিগুলি মুড়ে একধরনের উপাদেয় খাবার তৈরি করা হয়। ইস্ফাহানের কাছে ভারজানেহ বলে এক গ্রামের রেস্তোরাঁতে ‘লাভোশ’-এর মধ্যে ভেজে গুঁড়ো করা কাবুলিচানা ও কুচনো সবজি দিয়ে দারুণ একটি ‘ফলাফল’ রোল পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, সাধারণ মধুতে ডুবিয়ে ‘লাভোশ’ খেতেও কিন্তু অসাধারণ লাগে। ‘লাভোশ’ ছাড়াও ইরানে রয়েছে ‘নুন সাঙ্গাক’ বলে আর একধরনের রুটি। ফার্সিতে ‘সাং’ কথার অর্থ হল পাথর। ছোট-ছোট গরম করা পাথরের টুকরোর উপর এই রুটিগুলি সেঁকা হত বলে একে ‘নুন সাঙ্গাক’ বলা হয়। তবে মজার

ব্যাপার, ভারতে বা গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই যেমন ঘরে-ঘরে রুটি তৈরি হয়, ইরানে কিন্তু সেরকম একেবারেই হয় না! সেখানকার প্রতিটি জেলাতে বা শহরেই ছোট-ছোট কিছু বেকারির দোকান রয়েছে, যেখানে নানারকম রুটি বিক্রি হয়, মানুষ সেখান থেকেই কিনে আনেন।

মুদির দোকানেও মেলে রুটি!

ইরানে যদি ঘুরতে যান, তাহলে হরদম পথে-ঘাটে চোখে পড়বে এইধরনের বেকারি। ছোট্ট বেকারির আশপাশ গরম রুটির গন্ধে ম’ ম’ করবে। আর বাইরে লাইন দিয়ে ভিড় করে থাকবে লোকে। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর নানারকমের রুটি কিনে তারপর তারা পা বাড়াবে বাড়ির পথে। আপনি যদি কোনও দোকানে ঢুকে পড়েন, তাহলে দেখবেন, বড় একটি পাত্র থেকে বড়-বড় লেচি কেটে বেলছে একজন, তাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেওয়ালের গায়ে একটা ফাঁকা জায়গায়। সেখানেই সেঁকা হচ্ছে পারস্যের বিখ্যাত রুটি। আর শেষে বিশাল আকারের প্রায় টেবিল পাতা কাপড়ের মতো সেই গরম টাটকা রুটিকে নিয়ে রাখা হচ্ছে বেকারির কাউন্টারে। আর পড়তে না পড়তেই হট কেকের মতো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে! বেকারির দোকানগুলি ছাড়াও ইরানের সাধারণ মুদিখানাতেও নানারকমের পারস্যের নানরুটি বিক্রি হয়।

তবে ইরানে গিয়ে আপনি যদি পাউরুটি খোঁজেন, তাহলে কিন্তু আপনাকে হতাশই হতে হবে! কারণ পারস্যের অমন সুস্বাদু ‘নুন’ ছেড়ে পশ্চিমি পাউরুটি খাবেন তাঁরা, এ কথা ইরানিরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না!

আর এখন চলছে পবিত্র রমযান মাস। ফলে ইফতারের সময় নিত্য নতুন খাবারের সন্ধান আপনার কাছে থাকলে আপনারই কাজে লাগবে সেটা। এইসময় আশপাশে অনেক নতুন-নতুন খাবারদাবারও বিক্রি হয়। ফলে যদি দেখেন আপনার কাছে-পিঠের দোকানে পারস্যের নান বিক্রি হচ্ছে, তাহলে চেখে দেখতে ভুলবেন না!

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।