Home ইতিহাস ও জীবনী বুরানা মিনার, কিরগিজস্তানে হারানো শহরের শেষ স্মৃতিস্তম্ভ

বুরানা মিনার, কিরগিজস্তানে হারানো শহরের শেষ স্মৃতিস্তম্ভ

মধ্য এশিয়া বিভিন্ন শক্তিশালী সাম্রাজ্য আর সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল। সেই সব প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মৃতি চিহ্ন আজও এখানে চোখে পড়ে। কিরগিজস্তান প্রজাতন্ত্রের এমনই এক উল্লেখযোগ্য স্মৃতিসৌধ হল বুরানা মিনার । এক সময়ের অত্যন্ত শক্তিশালী সাম্রাজ্যের চিহ্ন হিসেবে একমাত্র এই মিনারটিই অবশিষ্ট রয়েছে। মধ্য এশিয়ার সব থেকে প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন হল এই মিনার। এর পরিকল্পনা এবং নকশা এই অঞ্চল ও ভারতের স্থাপত্যশৈলীকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল।

বুরানা মিনার-এর সুদীর্ঘ ইতিহাস

প্রাচীন লুপ্তপ্রায় শহর বালাসাগুনের সাথে এই মিনারের ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েথে। খ্রিস্টান যুগের প্রথম দিকে প্রাচীন ইরানি সভ্যতা, সোগডিয়ানরা এই মিনার তৈরি করেছিল। পরে এটি দখল করে কারাখানিদরা। এরা ছিল মোঙ্গলিয়া আর সাইবেরিয়ার এক যাযাবর গোষ্ঠী। মধ্য এশিয়ার অনেকটাই এরা দখল করে নিয়েছিল।

কারাখানিদরা মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করার পরে, বিদ্বান মুসলিমদের বিশেষ পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠে। তারা প্রচুর মসজিদ নির্মাণ করেছিল। কিন্তু তাদের ইসলাম গ্রহণ করার ফলে এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে, এবং কিছু সময় পরে তা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তেমনই একটি প্রধান মসজিদের সাথে যুক্ত ছিল বুরানা মিনার। এই মিনারের নকশা ছিল অনন্য। আরব, সোগদিয়ান, পার্সি ইত্যাদি বিভিন্ন জনজাতির শিল্পশৈলীর প্রভাব এই মিনারের নকশায় স্পষ্ট।

আরও পড়তে পারেন-

বালাসাগুন ছিল কারাখানিদ রাজ্যের রাজধানী। কিন্তু এই রাজ্যের পতনের পর, এই শহর পূর্ব কারাখানিদ রাজ্যের রাজধানীতে পরিবর্তিত হয়। বহু শতাব্দী ধরে এই শহর চ্যুভ্যালির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। ১১৩৪ সালে কারা খাতাই এই শহর দখল করেন, তবে এই মিনারটি রক্ষা পেয়ে যায়। ১২১৮ খ্রিস্টাব্দে এই শহর মোঙ্গলরা দখল করে নেয়, কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তখনও এই মিনারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। মোঙ্গলরা মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করার পরে এই মিনারের যত্ন এবং রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু করে এবং একে ব্যবহার করতে থাকে।

পরিত্যক্ত শহর বালাসাগুন

পঞ্চদশ শতাব্দীতে বালাসাগুন শহরে ভূমিকম্প হওয়ার ফলে এই মিনারের উপরিভাগ ভেঙে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে প্রচলিত এক লোকগাথা অনুযায়ী, এক সময়ে কোনও এক ক্ষমতাশালী রাজা তাঁর কন্যার মৃত্যুর পরে কান্নায় ভেঙে পড়লে এই মিনারটি ভেঙে পড়ে। এরপরে বালাসাগুনে আরও কয়েকটি ভূমিকম্প হয় এবং এই শহর ছেড়ে নাগরিকরা অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার ফলে শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। অধিকাংশ বাসিন্দা কিছু দূরের একটি গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বর্তমানে সেই গ্রাম এই পরিত্যক্ত শহরের নামেই পরিচিত।

উনবিংশ শতাব্দীতে রাশিয়ানরা তাদের বসতি স্থাপনের জন্য এই স্থান থেকে ইট স্থানান্তরিত করতে শুরু করেছিল। ফলে বুরানা মিনারের যে বিশাল কাঠামো তখনও দাঁড়িয়েছিল, তা প্রায় হারিয়ে যেতে শুরু করে। বিংশ শতাব্দীতে এই মিনার ভগ্নদশায় চলে যায়। এই সময় কিরগিজস্তান সোভিয়েত ইউনিয়ানের অন্তর্গত হয় এবং সেখানে কমিউনিস্ট শাসকদের কাছে এই ধরনের ধর্মীয় স্মৃতিসৌধের কোনও গুরুত্ব ছিল না।

১৯৭০ সালে বুরানা মিনার পুনরায় মেরামত করা হয়। বর্তমান কিরগিজস্তান সরকার তাদের তহবিল থেকে এই মিনারের দেখাশোনা করে এবং বর্তমানে এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।

বুরানা মিনার – হৃত শহরের শেষ স্মৃতিস্তম্ভ

অতুলনীয় নকশার এই গোলাকৃতি মিনারটি একটি অষ্টভুজ ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। এই সৌধটি তিয়েনশান পর্বতশ্রেণী দিয়ে ঘেরা এক সমতলভূমির উপর অবস্থিত। পুরোনো শহরের পশ্চিমে এটির অবস্থান। বুরানা মিনারের প্রকৃত উচ্চতা ছিল ৪৫ মিটার, কিন্তু বর্তমাবে এর উচ্চতা ২৫ মিটার।

এখনও এই সৌধের বেশ কয়েকটি প্রাচীন এবং স্বতন্ত্র লাল রঙের ইট চোখে পড়ে। এই মিনারের চিত্তাকর্ষক ইটের গাঁথনিতে বেশ কিছু ইসলামিক নিদর্শন জ্যামিতিক আকারে নকশা হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, এর মূল ঘোরানো সিঁড়িটি আর প্রবেশযোগ্য নেই। কিন্তু বর্তমানে ধাতব সিঁড়ির মাধ্যমে পর্যটকরা সেই ঐতিহাসিক ঘোরানো সিঁড়িতে পৌছাতে পারেন। এই সিঁড়ি মিনারের উপরের অংশের দর্শন স্থলে নিয়ে যায়।

মিনারটি বর্তমানে বুরানা জোনের অন্তর্গত। এটি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক উদ্যানের অংশ, যার মধ্যে বালাসাগুন শহরের কিছু অবশিষ্ট অংশ রয়েছে। এই সৌধের আশেপাশে দেখার মতো আরও কিছু জিনিস আছে – কিছু মাটির কাজ, ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গ আর তিনটি মসজিদ। বাকি শহর এখন লুপ্তপ্রায়।

বুরানা মিনার যাওয়ার নির্দেশিকা 

বুরানা মিনার টোকমোক শহরের কাছে অবস্থিত। গাড়ি করে রাজধানী বিশকেক থেকে ঘন্টাখানেকের পথ গেলে এখানে পৌঁছনো সম্ভব। ট্যাক্সি বা গাড়ি ভাড়া নিয়ে এখানে পৌঁছানো সম্ভব। এই মিনারে প্রবেশ আর উপরে ওঠার জন্য প্রবেশ মূল্য লাগে।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।