Home ইসলাম ইবাদতের পাশাপাশি রোযাব্রত পালন পরস্পর সহানুভূতি ও সহমর্মিতার শিক্ষা দেয়

ইবাদতের পাশাপাশি রোযাব্রত পালন পরস্পর সহানুভূতি ও সহমর্মিতার শিক্ষা দেয়

।। আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া ।।

ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘রোযা’। রোযাকে আরবীতে ‘সাওম’ বলা হয়। সাওম-এর বহুবচন ‘সিয়ামুন’। সাওম-এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। আর পারিভাষায় সাওম বা সিয়াম বলতে বুঝায়, কোনো মুমিন ব্যক্তি মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনের নিয়্যাতে তাঁরই নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সর্বপ্রকার খাদ্য-পানীয় গ্রহণ ও স্বামী-স্ত্রীর সহবাস থেকে বিরত থাকাকে বোঝায়।

সাওমকে আমরা বাংলা ভাষাভাষী মানুষ রোযা বলে জানি। রোযা ও সাওম শব্দ দু’টোর মাঝে পরস্পর নিগূঢ় একটি সম্পর্ক রয়েছে। আর তা হলো, ‘জ্বালিয়ে দেওয়া’। ‘রামাযান’ শব্দটি ‘রাময’ ধাতু থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ হলো, জ্বালিয়ে দেওয়া। কারণ, রোযা পাপসমূহকে জ্বালিয়ে দেয়। এ রোযাব্রত পালন ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরয ইবাদত। যা পালন করা প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্ক প্রাপ্তবয়স্ক লোকের উপরই অপরিহার্য।

রোযা ফরয হওয়া সম্পর্কে মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কালামে সুরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেন- হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমনি ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।

মহান আল্লাহর নির্ধারিত ফরয বিধান পালনের ইবাদতের পাশাপাশি এ রোযাব্রত পালন আমাদেরকে পরস্পর সহানুভূতি, সহমর্মিতার শিক্ষা দেয়।

রোযা হল, রমযান মাসে দিনের নির্দিষ্ট একটা সময় তথা সুব্হে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রীসহবাস থেকে নিজেকে বিরত রাখা এবং সাথে সাথে গীবত বা পরনিন্দা, চুগলখোরী, গালিগালাজ, অহেতুক ও অশ্লীল কথাবার্তা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। কারণ, এসব করলে রোযার ফযীলত কমে যায়। এছাড়াও কতিপয় কাজকর্ম রয়েছে যেগুলো করলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে তার ক্বাযা করতে হয়। আর কিছু কাজ রয়েছে যেগুলো করলে রোযা ভেঙ্গে যাবার কারণে তার ক্বাযা আদায়ের সাথে সাথে কাফ্ফারাও দিতে হয়। কাজেই সতর্কতার সাথে এসব দিক খেয়াল রেখে রমযানের রোযাব্রত পালন করা কর্তব্য।

এক মাস রোযাব্রত পালনের বিধান একবারে নাযিল করা হয়নি, বরং এ ব্যাপারে আল্লাহ্ তাআলা ক্রমিক রীতি অবলম্বন করেছেন। কারণ, তৎকালীন মক্কার লোকজন ইসলামের এই রোযার সাথে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। যদি প্রথমেই একমাস রোযা পালনের বিধান জারি করা হত, তাহলে তাদের জন্যে তা পালন করা আকাশসম কঠিন মনে হত। তাই ইসলামে প্রথমে আশূরা অতঃপর ‘আইয়্যামে বীয’ অর্থাৎ প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোযা পালনের নিয়ম চালু হয়। সবশেষে মাহে রমযানের পূর্ণ মাসের রোযাব্রত পালন ফরয ঘোষণা করা হয়। ইসলামে রোযার যেমন স্বতন্ত্র ফযীলত রয়েছে, তেমনি রয়েছে মাহে রমযানেরও ফযীলত। যা অন্য মাসগুলোতে অনুপস্থিত।

রোযা ও রমযানের ফযীলত

হাদীসে কুদসিতে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- আল্লাহ্ তাআলা বলেন, প্রত্যেক নেক কাজের সাওয়াব দশ হতে সাত শত গুণ পর্যন্ত প্রদান করা হয়, কিন্তু রোযা কেবল আমারই উদ্দেশ্যে রাখা হয় বলে এর প্রতিদান আমি স্বয়ং দান করব। আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেন, যারা দুনিয়াতে নেক কাজ করে, তাদের জন্যে রয়েছে পুণ্য। আল্লাহ্র পৃথিবী প্রশস্ত। যারা ধৈর্যধারণ করবে তারা অসংখ্য পুরস্কারে পুরস্কৃত হবে।

হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ধৈর্য ঈমানের অর্ধ্বেক, আর ধৈর্যের অর্ধ্বেক রোযা। হাদীসে কুদ্সীতে আল্লাহ্ তাআলা বলেন, রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আমার নিকট মৃগনাভীর সুগন্ধ অপেক্ষা অধিক প্রিয়। আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেন, আমার বান্দা কেবল আমার সন্তুষ্টির মানসেই পানাহার এবং স্ত্রীসহবাস পরিহার করছে। আমি স্বয়ং এর বিনিময় বা সাওয়াব দান করব।

হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- রোযাদারের নিদ্রা ইবাদত তুল্য, তার শ্বাস-প্রশ্বাস তাসবীহ পাঠ সদৃশ এবং প্রার্থনা নির্ঘাত কবুলযোগ্য। তিনি আরো বলেন- মাহে রমযান আগমনের সাথে সাথে বেহেশ্তের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত এবং দোযখের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানকে তার দলবলসহ শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়। ঘোষিত হয়, হে কল্যাণকামী! শীঘ্র আস, এখন তোমাদের সময় অর্থাৎ কল্যাণ গ্রহণে দ্রুত অগ্রসর হও। এটা তোমাদের জন্যে সুসময়। হে পাপী! পাপকর্ম থেকে নিজেকে বিরত রাখ। রোযার বদৌলতে অনেক লোক আল্লাহ্র দয়ায় জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে। তুমিও তাদের একজন হতে পারো। অতএব নিজেকে পাপকর্ম থেকে বিরত রেখে সৎকর্মে লিপ্ত হও।

আরও পড়তে পারেন-

হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরোও বলেন- রোযা তোমার জন্য ঢাল স্বরূপ। তিনি আরও বলেন- জান্নাতে আটটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হল, ‘রাইয়্যান’। এই দরজা দিয়ে শুধুমাত্র তারা প্রবেশ করবে, যারা রোযাব্রত পালন করেছে, অন্য কেউ নয়। আরও ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের কাজ মনে করে রমযান মাসের রোযা রাখে, তার পিছনের সকল সগীরা গুনাহ্ মাফ করে দেওয়া হয়। অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি নিষ্ঠার সাথে রমযান মাসের রোযা পালন করল এবং শাওয়াল মাসের ছয়টি রোযা রাখল, সে যেন পূর্ণ বছরের রোযা রাখল। অর্থাৎ তাকে পূর্ণ বছর রোযা পালনের সাওয়াব দান করা হবে। আরেক হাদীসে ইরশাদ করেন- রমযান মাস উপলক্ষ্যে জান্নাতকে সুসজ্জিত করা হয় পরবর্তী রমযান পর্যন্ত পুরো বছর ধরে। আর যখন রমযান মাসের শুভসূচনা হয়, তখন থেকে জান্নাতের পত্রপল্লব থেকে আরশ তলের হূরগণের উপর দিয়ে বইতে শুরু করে এক প্রকার মৃদু সমীরণ। আর তারা বলতে থাকে, হে আল্লাহ্! তোমার বান্দাদের মধ্যে থেকে আমাদের স্বামী নর্ধিারণ করে দাও, যাদের দেখে আমাদের নেত্রযুগল শীতল হবে এবং আমাদের দেখে তাদের নেত্রযুগল শীতল হবে।

উম্মত জননী হযরত আয়েশা (রাযি.) বলেন, তোমরা বেহেশতের কপাট ধরে নাড়া দাও। আরয করা হলো, কিভাবে? তিনি বললেন, ক্ষুৎপিপাসা অর্থাৎ রোযাব্রত পালনের মাধ্যমে। (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, বাইহাক্বী, মিশ্কাত শরীফ প্রভৃতি দ্রষ্টব্য)।

আল্লাহ্ তাআলা রোযাকে নিজের দিকে সম্বন্ধযুক্ত করে বলেন, রোযা একমাত্র আমার উদ্দেশ্যেই রাখা হয় এবং আমিই এর বিনিময় প্রদান করব। এর রহস্য কি? অথচ প্রত্যেক ইবাদতই আল্লাহ্র উদ্দেশ্যেই করা হয়?

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল কিছুই আল্লাহ্ তাআলার হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ কিছু বৈশিষ্টের কারণে যেমন কা’বা গৃহকে বিশেষভাবে আল্লাহর ঘর বলা হয়। তেমনি রোযার মধ্যে কিছু স্বতন্ত্র বিশেষত্ব থাকার কারণে আল্লাহ্ তাআলা রোযাকে নিজের দিকে সম্বন্ধযুক্ত করেছেন।

আর সেই বিশেষত্বগুলো হচ্ছে যথাক্রমে- (১) রোযা এমন একটি ইবাদত যদ্বারা খাহেশ বা কুপ্রবৃত্তি ও রিপুর চাহিদাগুলো উপেক্ষা করার সুযোগ ঘটে। এটা অন্তরের কর্ম, লোকচক্ষুর অন্তরালে অহংকারের অবকাশ নেই। (২) এই রোযার দ্বারা শয়তানকে শায়েস্তা করার এক বিস্ময়কর সুযোগ ঘটে। শয়তান আল্লাহ্র দুশমন, আর প্রবৃত্তি হচ্ছে তার সৈনিক।  রোযার দ্বারা এই দু’টোকেই কাবু করার মোক্ষম সুযোগ ঘটে। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ক্ষুধার্ত থেকে শয়তানের চলাচলের পথ দুর্গম করে দাও। (৩) রোযা এমন একটি ইবাদত, যে ইবাদত পালন করা কালীন অশ্লীল ও গর্হিত কাজকর্ম করা এবং অশালীন কথাবার্তা বলার পরিপূর্ণ সুযোগ থাকে, যা অন্য কোন ইবাদতে নেই। অতএব, যে ব্যক্তি এসব গর্হিত কর্ম থেকে বিরত থেকে নির্ভেজাল অন্তরে যতটুকু আল্লাহ্র ধ্যানে ও যিক্র-আযকারে লিপ্ত থাকবে, আল্লাহ্ তাকে তৎপরিমাণ সাওয়াব প্রদান করবেন। এতে করে দেখা যাবে যে, রোযাদারের পরস্পরের সাওয়াবের পরিমাণ পরস্পরের তুলনায় বেশ-কম হবে।

রোযার উপকারিতা

হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- সব কিছুরই যাকাত রয়েছে। আর শরীরের যাকাত হলো, রোযাব্রত পালন। একথা সর্বজন বিদিত যে, যাকাত অর্থ পবিত্রতা বা পবিত্রকরণ পদ্ধতি। সম্পদশালীর সম্পদের নির্দিষ্ট একটা অংশ যা যাকাতে ব্যয়িত হয়, তা অন্য ধনসম্পদকে পবিত্র করে দেয়। তেমনি রোযাও শরীরকে পবিত্র করে দেয়, রোগমুক্ত করে দেয়। এগারো মাস একই নিয়মে পানাহারের ফলে পেটের বিদ্যমান আর্দ্রতা থেকে রোগ জীবাণু ও বিষ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু প্রতি বছর এক মাস রোযাব্রত পালন করার দরুন তা স্বমূলে ধ্বংস হয়ে যায়। যেমন- মা তার বাচ্চাকে দুধ পান করানোর ফিডারটিকে দিনে একবার ওয়াশিং পাউডার দিয়ে পরিস্কার করেন, তেমনি আমরাও এক মাস বিশেষ পদ্ধতির উপবাসব্রত পালন করে পেট পরিস্কার করি, পেটকে আবর্জনা ও দুষণ মুক্ত করি। এতে করে হজমশক্তি বৃদ্ধি লাভ করে, হজম ভাল হয়, ফলে পেট ঠিক থাকে। আর হজমশক্তি ঠিক থাকলে মেজাজের রুক্ষতা কমে যায়। ফলতঃ কাজে-কর্মে, লেখা-পড়ায় মন বসে, মনে এক প্রকার স্ফূর্তি ও উদ্যমি ভাবের সঞ্চার হয়, দেহমনে সর্বদা একটা মিষ্টিমধুর আমেজ বিরাজ করে।

এই রোযার ফলে শরীরের অলসতা দূর হয়। অপ্রয়োজনীয় রক্তগুলো হ্রাস পায়। রক্ত তৈরীর হাঁড়ের মজ্জাকে এক প্রকার স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি আন্দোলিত করে তুলে; ফলে তা থেকে প্রয়োজনানুসারে রক্ত সৃষ্টি হয়। এই রোযা স্নায়ু কোষগুলোকে সক্রিয় করে তুলে, ফলে তা ঠিকমত কাজ করতে থাকে। রোযা পালনের দ্বারা পরস্পরে সহানুভূতি, সহমর্মিতার সঞ্চার হয়, ধনী-গরীবের মধ্যে হৃদ্যতার সৃষ্টি হয়। এছাড়াও আরো অনেক উপকারিতা রয়েছে। রোযার এসব পার্থিব উপকারিতা কোন ধর্ম-বর্ণের পার্থক্য করে না। মানুষ যে কোন ধর্মেরই হোক না কেন, সে যদি রোযা পালন করে, রোযা তাকে এসব উপকারিতা দানে সম্পূর্ণ সক্ষম।

  • আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া, মহাপরিচালক- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।