Home ফিকহ ও মাসায়েল প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান

প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান

।। মুফতিয়ে আযম আল্লামা আবদুচ্ছালাম চাটগামী ।।

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

সমাধান-২ঃ কোন সুস্থ জ্ঞানসম্পন্না প্রাপ্তবয়স্কা মহিলা যদি অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত অসম কোন পরিবারে বিয়ে বসে। যেমন- বংশ-দ্বীন-ধর্ম পেশা এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে যদি কোন নিম্নস্তরের ছেলের সাথে, অথবা অতি অল্প মহরে বিয়ে বসে, তাহলে এসব পরিস্থিতিতে যেহেতু ছেলে-মেয়ে উভয়ই সুস্থ জ্ঞান সম্পন্ন এবং প্রাপ্ত বয়ষ্কা, তাছাড়া শরীয়ত সম্মতভাবে বিয়ের মৌলিক বিধি-বিধান মেনে বিয়ের কার্যাদি সম্পন্ন হয়ে থাকে, এমতাবস্থায় হানাফী মাযহাবের যাহেরী মাযহাব মতে এ বিয়ে শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পন্ন হয়ে যাবে বটে। তবে এতে অভিভাবকের আপত্তি উত্থাপনের অধিকার থাকবে।

যদি অভিভাবক চায়, আদালতের মাধ্যমে এ বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারবে। আর হানাফী মাযহাবের অন্য এক “গাইরে যাহেরী বর্ণনা মতে এ ধরণের বিয়ে শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পন্নই হবে না। এ বিয়েতে বর-কনের উপর বিয়ের আহকাম জারি হবে না। স্বামীর উপর স্ত্রীর এবং স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকার প্রযোজ্য হবে না। উক্ত মহিলার অন্যত্র বিয়ে করার অনুমতিও বহাল থাকবে। আর এর উপরই মুতাআখ্খেরীন উলামায়ে কেরাম রায় দিয়েছেন। এদিকে হানাফী মাযহাবের জাহেরী বর্ণনা মতে যেহেতু সুস্থজ্ঞান সম্পন্না প্রাপ্তবয়স্কা কোন মহিলা অসমকক্ষ পরিবারে অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত বিয়ে করে ফেললে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাবে।

সুতরাং তাদের মতে এ ধরণের বিয়ের উপর বৈবাহিক বিধি-বিধান জারি হবে। কারণ এতে পাত্র-পাত্রী উভয়ই প্রাপ্তবয়ষ্ক।

দ্বিতীয়তঃ মানুষ হিসেবে স্বীয় মাল-সম্পদ ও ব্যক্তি সত্ত্বায় তার অধিকার রয়েছে। তাছাড়া তারা বিবাহের মৌলিক বিষয়াদি ও সাক্ষী ইত্যাদির মাধ্যমে তা সম্পাদন করেছে, সুতরাং সংশ্লিষ্ট বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাবে। তবে একথা অবশ্যই অনস্বীকার্য যে, এখানে উক্ত মহিলা শরীয়ত ও সামাজিক দৃষ্টিকোন থেকে মারাত্মক দু’টি ভুল করে ফেলেছে।

১) শরীয়ত অসম্মত একটি পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। অর্থাৎ- অভিভাবকের মধ্যস্থতা বাদ দিয়ে নিজে নিজেই বিয়ে করে ফেলেছে, যা অশালীন ও অভদ্রোচিত পন্থা। ২) দ্বিতীয়তঃ সে অসমকক্ষ পরিবারে বিয়ে করে অভিভাবকের অবমাননা করেছে। সুতরাং এর প্রতিবিধান কল্পে অভিভাবকের এ বিয়ের ব্যাপারে চিন্তা করার অধিকার থাকবে। চিন্তা ফিকির করার পর যদি বুঝে আসে যে, এ বিয়ে যদিও কিছু বিষয়ে শরীয়ত অসম্মত পদ্ধতিতে হয়েছে এবং এতে আমাদের মুখে চুনকালিও মেখেছে, কিন্তু যেহেতু ছেলের মাঝে অনেক ভাল গুণাবলি আছে, বিয়ে যদি বহাল রাখা হয়, তাহলে সে তার হক আদায় করতে পারবে বলে আশা করা যায়।

এমতাবস্থায় এ বিয়ে বিচ্ছেদ করে দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই, বহাল রাখতে পারবে। আর চিন্তা ভাবনা করার পর যদি বুঝে আসে যে, এ বিয়ে বিচ্ছেদ করে দেয়া জরুরী, তাহলে সাক্ষী প্রমাণের মাধ্যমে আদালতে এ কথা প্রমাণ করাবে যে, ছেলে মেয়ের সমকক্ষ পরিবারের নয়। তাই এ বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটাতে চাই। এতে কারো বিশেষ কোন ক্ষতি সাধিত হবে না এবং প্রত্যেক গ্র€পের চিন্তাভাবনা করার সুযোগ মিলবে। যাহেরী বর্ণনা মতে যতক্ষণ পর্যন্ত উক্ত বিয়ে বহাল থাকবে, ততক্ষণ (এ অন্তবর্তী কালে) তাদের মাঝে যদি কোন দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তাহলে এটাকে জায়েয বলে ধরে নিতে হবে। স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে পূর্ণ মহর আদায় করা তার জিম্মায় জরুরী হবে। আর যদি তারা ‘খুলা’ করে তাহলে স্ত্রীর মহরের অধিকার রহিত হয়ে যাবে। মেয়ের অভিভাবক যদি বিবাহ বিচ্ছেদ করে দেয়, তখন দেখতে হবে যে, কখন বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে। তাদের মাঝে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের আগে, না পরে? যদি আগে হয়, তাহলে মেয়ে মোহরানা পাবে না। কারণ অভিভাবক সেচ্ছায় বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে। সুতরাং সেই মোহরানার যিম্মাদার।

আর যদি এ বিচ্ছেদ হয় দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের পর, তখন মেয়ে তার পূর্ণ মোহরানা পাবে। আর ইমাম হাসান ইবনে যিয়াদের গাইরে যাহেরী বর্ণনা মতে যেহেতু এধরণের বিয়ে প্রথম থেকেই কার্যকর নয়, তাই স্বামীর পক্ষ থেকে না তালাক দেয়ার প্রয়োজন আছে, আর না স্ত্রীর পক্ষ থেকে, না অভিভাবকের আদালতে গিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রয়োজন আছে। অধিকাংশ মুতাআখ্খেরীন ফিক্বাহবিদগণ এর উপরই ফাত্ওয়া দিয়েছেন। আর কিছু সংখ্যক মুতাআখ্খেরীন অবশ্য জাহেরী বর্ণনার ভিত্তিতে ফাত্ওয়া প্রদান করেছেন।

আমাদের হানাফী ইমামগণ থেকেও উভয়বিধ ফাত্ওয়া বর্ণিত আছে। যেমন- জামিয়াতুল উলূম আল ইসলামিয়া, বিন্নুরী টাউন-এর গ্র্যান্ড মুফতী হযরত মাওলানা মুফতী ওলি হাসান টুংকী (রাহ.)এর কর্মপন্থা সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে অধম (লিখক) এই দেখে আসছি। যখন তিনি নিজে ফাত্ওয়া দিতেন, তখন গাইরে জাহেরী বর্ণনার উপর ফাত্ওয়া দিতেন। আর যখন অন্যান্য সহকর্মীরা ফাত্ওয়া দিত তখন ঐ সব ফাত্ওয়াকে সত্যায়ন করতেন। যেগুলো যাহেরী বর্ণনার উপর ভিত্তি করে লিখা হয়েছে। অর্থাৎ যে সব ফাত্ওয়াতে বলা হত যে, উক্ত বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে এবং এতে অভিভাবকের আদালতের মাধ্যমে বিয়ে বিচ্ছেদের অধিকার আছে। শুধু এ সব ফাতওয়াতে তিনি সম্মতি সূচক সাক্ষর দিতেন। অধিকাংশ মুতাআখ্খেরীন ফিক্বাহবিদের ফাত্ওয়ার ব্যাপারে তিনি বলতেন, যে অবস্থার প্রেক্ষিতে তারা গাইরে জাহেরী বর্ণনার উপর ফাত্ওয়া দিয়েছিলেন, তা বর্তমানের তুলনায় ভিন্ন ছিল।

বর্তমানে যেখানে মেয়েরাই স্বয়ং কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে নেয়, সেখানে অভিভাবকরা কোর্ট-কাচারীর ব্যাপারে অনবগত থাকার তো কথাই নেই। সুতরাং অসমকক্ষ পরিবারে বিয়ে করলে অভিভাবক যদি এতে সম্মত না হয়, তাহলে আদালতের মাধ্যমে উক্ত বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারবে। কোন অসুবিধা হবে না। সুতরাং অনায়াসেই তারা ছেলে পরিবারের অসমকক্ষতা প্রমাণ করে উক্ত বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারবে। আমাদের পূণ্যাত্মা আসলাফ থেকে উভয় বিধ ফাত্ওয়াই বর্ণিত আছে। তাই উভয় ধরণের ফাত্ওয়া দেওয়ার অবকাশ আছে।

উপরের এ আলোচনার প্রশ্নপত্রে উল্লিখিত সমস্যা সমূহের চারটির সমাধান এসে গেছে। শাফেয়ী মতাবলম্বী কোন ইমাম এতে দ্বিমত পোষণ করেন না।

প্রমাণ্য দলীলসমূহ

মালেক, শাফেয়ী এবং আহ্মদ (রাহ্.) প্রমূখ ইমামগণ বলেন, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- “তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ণ, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ্ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ্ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। (সূরা নর- ৩২ আয়াত)।

উক্ত আয়াতে মহিলাদের অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষকদের সম্বোধন করা হয়েছে। এর সারমর্ম হল- মহিলাদের যারা পৃষ্ঠপোষক তোমরা স্বীয় অধিনস্থ রমণীদেরকে বিয়ে করাও, এখানে সরাসরি মহিলাদেরকে বলা হয়নি যে, নিজে নিজেই তোমরা বিয়ে করে নাও। এ থেকে স্পষ্ট বুঝে আসে যে, মহিলাদের নিজে নিজেই বিয়ে করে নেবার কোন অধিকার নেই। চাই তারা আকেল-বালেগই হোক না কেন। অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন, “তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দাও এবং তারা তাদের “ইদ্দতকাল” পূর্ণ করে, তারা যদি বিধিমত পরস্পর সম্মত হয়, তবে স্ত্রীগণ নিজেদের বিবাহ করতে চাইলে তোমারা তাদেরকে বাধা দিওনা”।

এ আয়াতেও অভিভাবক ও সাবেক স্বামীদের প্রতি এ-মর্মে নিষেধ করা হয়েছে যে, পতিœহীন মহিলারা যদি বিয়ে করতে চায়, চাই কুমারী হোক বা বিবাহোত্তর তালাকপ্রাপ্তা হোক (এবং ইদ্দতও শেষ করে ফেলেছে) তাহলে বিয়ে থেকে তাদের বিরত রাখা যাবে না। বরং তাদের অনুমতি দেয়া হবে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে অভিভাবকের আপত্তি উত্থাপনের অধিকার রয়েছে। আর তাদের অনুমতি ব্যতিত মহিলাদের বিয়ে হতে পারে না।

আরও পড়তে পারেন-

এতদ সংক্রান্ত হাদীস সমূহঃ হাদিসের বিশাল ভান্ডার থেকে যেসব হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান, তা নি¤েœ প্রদত্ত হল- “প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, পিতৃহীন মেয়েদেরকে ততক্ষণ পর্যন্ত বিয়ে দেয়া যাবে না; যতক্ষণ পর্যন্ত বিয়ের ব্যাপারে তাদের থেকে পরামর্শ নেয়া না হবে। আর কুমারী মেয়েদেরকে ততক্ষণ পর্যন্ত বিয়ে দেয়া যাবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের থেকে অনুমতি নেয়া না হবে।

সাহাবাগণ আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা.)! তাদের থেকে অনুমতি নেয়ার পদ্ধতি কি? তিনি (সা.) বললেন, তাদের থেকে অনুমতি চাওয়ার পর যদি তারা চুপ থাকে, তাহলে সেটাই তাদের অনুুমতি। উক্ত হাদিসেও বিয়ের ব্যাপারে অভিভাবককে সম্বোধন করা হয়েছে। এ হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) অভিভাবকদের সম্বোধন করে বললেন, আকেল-বালেগ, পতিহীন মেয়েরা চাই প্রথম থেকে অবিবাহিতা হোক অথবা বিয়ের পর স্বামী কর্তৃক তালাক প্রাপ্তা হোক কিংবা বিধবা হোক, তাদেরকে বিয়ে করতে চাইলে তাদের পরামর্শ ও সরাসরি সম্মতি ব্যতিত করবে না। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিয়ে দেয়ার অধিকার তো অভিভাবকের আছে বটে, কিন্তু জ্ঞানসম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্কা নারীদের বেলায় তাদের পরামর্শ ও অনুমতি নেয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

৪। অপর একটি হাদিসে এসেছে, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাযি.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে মহিলা তার অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত বিয়ে করবে তার বিয়ে বাতিল বলে গণ্য হবে। এ কথা তিনি তিন বার বলেছেন।

৫। তৃতীয় হাদীসে বলা হয়েছে, হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, এক মহিলা অন্য কোন মহিলার বিবাহ দিতে পারবে না। এমনকি নিজের বিয়েও নিজে করতে পারবে না। এজন্যেই যে মহিলা নিজে নিজে বিয়ে করবে, সে ব্যভিচারিণী বলে বিবেচিত হবে। হযরত আয়েশা (রাযি.) বর্ণিত হাদিসে এ কথা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, মহিলার নিজকৃত বিয়েকে বাতিল ও অকার্যকর বলে ঘোষণ দেয়া হয়েছে। আর হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) হতে বর্ণিত হাদিসে যে মহিলা অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত বিয়ে করে, তাকে ব্যভিচারিণী বলে গণ্য করা হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট বুঝে আসে, যে মহিলা চাই জ্ঞান সম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্কা হোক না কেন, সে অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত বিয়ে করতে পারে না।

৬। একটি হাদিসে বলা হয়েছে, অভিভাবক ব্যতিত কোন মহিলাকে বিয়ে করা যাবে না।

৭। অন্য এক হাদিসে এসেছে, নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেন, অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত মহিলাদের বিয়ে হয় না।

৮। অপর এক হাদিসে বলা হয়েছে, হযরত আয়েশা (রাযি.) একবার স্বীয় (ভাতিজি) হাফসা বিনতে আব্দুর রহমানকে তার পিতার অনুপস্থিতিতে হযরত মুনযের ইবনে যুবায়েরের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। যখন তার পিতা হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর সফর থেকে বাড়ি ফিরলেন এবং নিজের মেয়ের বিয়ের কথা জানতে পারলেন, তখন তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। শাফেয়ী ও হাম্বলী ইমামগণ স্বীয় মতবাদ প্রমাণে আরো যে সব দলিল প্রমাণ পেশ করে থাকেন, তা’হল-

৯। কুরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতে মহিলারা দ্বীন ধর্ম ও জ্ঞান বুদ্ধির দিক দিয়ে অসম্পূর্ণ। বিয়ের ভাল মন্দ যতটা অভিভাবকরা বুঝতে পারবে, ততটা মহিলারা পারবে না। বিশেষতঃ যখন তারা প্রবৃত্তিতাড়িত হয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে চিন্তা করে, তখন যাকে ইচ্ছে তাকেই বিয়ে করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। তারা আরো বলেন, যে সব বিয়ে মহিলারা নিজ পছন্দ অনুযায়ী করে, অনেক ক্ষেত্রেই তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না, অতিশীঘ্র স্বামী-স্ত্রীর মাঝে অনৈক্য দেখা দেয় এবং তিক্ততা শুরু হয়। অনায়াসে তাদের মাঝে বিবেদ সৃষ্টি হয়। পরিশেষে তাদের মাঝে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।

প্রাগুক্ত দলিল প্রমাণ ছাড়াও আরো অন্যান্য প্রমাণাদির ভিত্তিতে শাফেয়ী ও হাম্বলী ইমামগণ বলেন, জ্ঞান সম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্কা কোন মহিলাও স্বীয় অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত বিয়ে করতে পারবে না। পক্ষান্তরে ইমামে আযম আবু হানিফা (রাহ্.) যিনি একজন বিশিষ্ট তাবেয়ী, বহু সাহাবায়ে কেরামের সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়েছেন। যিনি ইল্ম ও তাকওয়ার জগতে সকল ইমামগণের উপর অধিষ্ঠিত ইমাম আবু ইউসূফ ইমাম মুহাম্মদ (রাহ্.) প্রমুখদের ন্যায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন। ইমাম আবু ইউসূফ, ইমাম মুহাম্মদ (রাহ্.) প্রমূখদের ন্যায় ফিক্বাহ, হাদিস ও অন্যান্য ইলমে পারদর্শী। ইমাম সুফিয়ান সাওরী, ইমাম আওযায়ী প্রমুখ বলেন, কুরআন হাদীস এবং ফিক্বহে ইসলামীর আলোকে জ্ঞান সম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্কা কোন মেয়ে যদি স্বীয় অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত নিজ সমকক্ষ কোন পরিবারে বিয়ে করে, তাহলে তা বৈধ হবে।

এ ধরণের বিয়ে শরীয়তের দৃষ্টিকোন থেকে বৈধ বলে গণ্য হবে। তবে যদি অভিভাবকের অনুমতি ক্রমে হতো, তাহলে সবচে উত্তম হতো। এতে অভিভাবকসহ পুরো বংশের মান সম্মান রক্ষা হয়, কেউ কিছু বলার সুযোগ পায় না। অন্যথায় তার পরিবারকে সমাজে অনেক ছোট হতে হয়। মানুষের কথা শুনতে হয়। তাই জ্ঞান সম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্কা কোন মহিলা যদি স্বীয় সমকক্ষ পরিবারে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তাতে অভিভাবকের নিষেধ করা উচিত নয়। বরং অনুমতি দিয়ে দেয়া উচিৎ। নচেত বড় ধরণের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়া ছাড়াও অসম্মানের গ্লানি বহন করার প্রবল আশংকা দেখা দেয়। অথচ কুরআন হাদীসের আলোকে সমকক্ষ পরিবারে বিয়ে করলে সে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে বলে গণ্য হয়। আর এটাও জেনে রাখা দরকার যে, বিয়ের আগে অভিভাবক অনুমতি না দিলেও যদি বিয়ের পরে অনুমতি দেয়, তাহলেও চলবে। বিয়েতো সর্বাবস্থায় বৈধ হয়ে যাবে। তবে অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত হওয়ার কারণে সমাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এতে যে অসম্পূর্ণতা বিরাজ করছিল, তা পরবর্তীতে এ অনুমতির কারণে পূর্ণ হয়ে যাবে। তবে পরের এ অনুমতির পর পুনরায় বিয়ে পড়ানোর প্রয়োজন হবে না।

ইমাম আযম আবু হানিফা ও অন্যান্য ইমামগণ তাদের এ মতবাদের উপর কুরআন হাদীস ও ফিক্বহে ইসলামীর নি¤েœাক্ত দলিলসমূহ পেশ করেছেন- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

“অতঃপর যদি সে তাকে তালাক দেয় তবে সে তার জন্য বৈধ হয় না। যে পর্যন্ত সে অন্য স্বামীর সাথে সংগত না হবে। অতঃপর স্বামী যদি তার স্ত্রীকে তৃতীয় বারের মত তালাক দেয়, তাহলে স্ত্রী যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যত্র বিয়ে না বসবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে প্রথম স্বামীর জন্যে বৈধ হবে না। তারপর যখন দ্বিতীয় স্বামী তালাক দিয়ে দিবে, তখন পূণরায় বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করলে কোন গুনাহ হবে না।

এটা তখনই, যখন তাদের প্রবল ধারণা লাভ হবে যে, তারা আল্লাহ্র দেয়া হুকুম আহকাম বিধি বিধান যথাযথ ভাবে পালন করতে সক্ষম হবে। এ সীমারেখা মহান আল্লাহ্ কর্তৃক প্রদত্ত। যা তিনি জ্ঞানীদের উদ্দেশ্যে বর্ণনা করেন। পবিত্র কুরআনের উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে- (১) তৃতীয় তালাকের পর স্ত্রী-স্বামীর উপর চিরতরে হারাম হয়ে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত না স্ত্রী অন্যত্র বিয়ে বসে (২) দ্বিতীয়তঃ দ্বিতীয় স্বামীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন হওয়ার পর সে যদি স্বেচ্ছায় তালাক দেয়, তাহলে তালাকের ইদ্দত পালন করার পর উক্ত ১ম স্বামীর জন্যে বৈধ হবে।

এখানে সুক্ষ্ম একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, উক্ত আয়াতে দ্বিতীয় স্বামীকে বিয়ে করা না করার স্বাধীনতা মহিলাকে দেয়া হয়েছে। এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী স্বেচ্ছায় যতক্ষণ পর্যন্ত দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে ১ম স্বামীর জন্যে হালাল হবে না। এর দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, দ্বিতীয় স্বামীকে বিয়ে করার অধিকার মহিলার। অভিভাবক তার উপর সম্মত হোক বা না হোক। অভিভাবক বিয়ের অনুমতি দিক বা না দিক।

যেমন উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রূহুল মাআনী প্রণেতা আল্লামা সাইয়েদ মাহমুদ আলুসী বাগদাদী (রাহ.) বলেন, বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার জন্যে অভিভাবকের উপস্থিতি শর্ত নয়। কারণ আল্লাহ তাআলা বিয়েকে মহিলার দিকে সম্বোধন করেছেন। অর্থাৎ উক্ত আয়াতে পাকের শব্দ দ্বারা প্রতীয়মান হয় না যে, বিয়ের জন্যে অভিভাবক জরুরী এবং আয়াতে শব্দ দ্বারা বুঝা যায় যে, বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার জন্যে অভিভাবকের উপস্থিতি বা অনুমতি কোনটারই প্রয়োজন নেই। তাই আয়াত শরীফে বিয়ে সম্পন্ন হওয়াকে মহিলাদের প্রতি সম্বোধন করা হয়েছে যে, “হাত্তা তানকিহু যাওজান্ গাইরাহু”। এ আয়াতে স্ত্রী লিঙ্গের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ তালাক ও ইদ্দতের পর মহিলা যতক্ষণ পর্যন্ত দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে প্রথম স্বামীর জন্যে বৈধ হবে না।

[চলবে]

– আল্লামা মুফতি আব্দুচ্ছালাম চাটগামী, মুফতিয়ে আযম বাংলাদেশ এবং পরিচালনা পরিষদের প্রধান, জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

প্রথম কিস্তি পড়ুন- “প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান-১”