Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলিদের মতো সমান নিরাপত্তা, সাম্য ও আবাসভূমির দাবিদার

ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলিদের মতো সমান নিরাপত্তা, সাম্য ও আবাসভূমির দাবিদার

।। ডিন ওবায়েদাল্লাহ ।।

ইসরায়েল ও হামাসের চলমান লড়াইয়ে জিতবে না কেউ। উভয় পক্ষেই ঘটেছে প্রাণহানি। দুইপক্ষে প্রাণহানির ঘটনা অসম হলেও তা হৃদয়বিদারক। রোববার বিকাল পর্যন্ত ১৯৭ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে রয়েছে আট শিশু, শনিবার গাজার শরণার্থী শিবিরে ক্ষেপনাস্ত্র হামলায় যাদের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়।

অন্যদিকে, হামাসের চালানো রকেট হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ১০ ইসরায়েলি। নিহতদের মধ্যে পাঁচ বছর বয়সী একটি শিশুও রয়েছে।

ইতিহাস থেকে যদি আমরা শিক্ষা নিই, তাহলে দেখা যাবে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছালেই শিরোনাম থেকে এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত ধীরে ধীরে মুছে যাবে। বিশ্ববাসী পুনরায় নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। অন্যদিকে, সকলের মন থেকে আবারও বিস্মৃত হবে ফিলিস্তিনের কথা।

তবে যারা আন্তরিকভাবেই মধ্যপ্রাচ্যে ন্যায় ও স্থায়ী শান্তি দেখতে চান, তাদের জন্য এবারকার পরিস্থিতি ভিন্ন। বিশ্ব, বিশেষত বাইডেন প্রশাসন বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে পারে না। ফিলিস্তিনের প্রশ্নে তাদের অবশ্যই সস্পৃক্ত হতে হবে। 

আমরা এখন ২০২১ সালে অবস্থান করছি। ফিলিস্তিনি মুসলিম ও খ্রিস্টানদের জন্য একটি আবাসভূমি তাদের দীর্ঘদিনের প্রাপ্য। একইসঙ্গে ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষা ও সমতার প্রশ্নের বিধান করাও এখন অনিবার্য।

যতদূর পর্যন্ত স্মরণ করতে পারি, জীবনের শুরু থেকেই এই ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ১৯৩০ সালে পশ্চিম তীরে আমার ফিলিস্তিনি বাবার জন্ম। পশ্চিম তীর তখন ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিনের অংশ (১৯৪৮ পর্যন্ত ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রাধীন)। ১৯৭০-এর দশকের শেষে আমি যখন ছোট, বাবা আমাকে এখানকার গল্প শোনাতেন। সেগুলো কোনো রাজনৈতিক আলোচনা ছিল না। বরং, আমার আত্মীয়স্বজন এবং অন্য ফিলিস্তিনিরা কীভাবে সামরিক দখলদারির অধীনে জীবনযাপন করতেন, সেই ঘটনাগুলোই ছিল মূল আলোচ্য।

সেখানে চলাফেরার স্বাধীনতা ছিল নিয়ন্ত্রিত। ব্যক্তিগত আত্ম-সংকল্প কীভাবে অসংখ্য সামরিক চৌকির তল্লাশির মুখে তছনছ হয়ে যেত, সেই গল্প করতেন বাবা। আমি শুনতাম কীভাবে আমার দাদীর জন্মভূমি ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা দখল করে নিল।

পরবর্তী দশকগুলোতে সীমান্তের উভয় প্রান্তে মার্কিন নির্বাচিত কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারের ওপর প্রাধান্য দেন। তবে ২০১৬ সালে সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স বিষয়টিতে পরিবর্তন আনায় তাকে ধন্যবাদ। সে বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় বার্নি বলেন, ‘আমরা ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সহিত আচরণ করব।’

ইসরায়েলের অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়টিকে সমর্থন করে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি দ্বন্দ্বে ‘এক তরফা’ আচরণ বন্ধ করার আহ্বান জানান।

গত সপ্তাহে ডেমোক্রেটিক দলের নিম্নকক্ষের ২৫ জন সদস্য যা করেছেন তা এক দশক আগেও ভাবা যেত না। ম্যারি নিউম্যান, আয়ানা প্রেসলি, মার্ক পোকান ও জুডি চু-সহ ভিন্নমতধারী এই দল বাইডেন প্রশাসনকে পূর্ব-জেরুজালেমে উগ্র-জাতীয়তাবাদী ইহুদিদের হাতে ফিলিস্তিনিদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ প্রচেষ্টাকে নিন্দা জানানোর আহ্বান জানায়।

বৃহস্পতিবার নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের ডেমোক্র্যাট সদস্যদের একটি দল ফিলিস্তিনি মানবাধিকার রক্ষায় সমর্থন জানিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে জানিয়ে মন্তব্য করেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বিষয়টিকে উল্লেখ করে নিম্নকক্ষের সদস্য আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ প্রশ্ন রাখেন, ‘কিন্তু ফিলিস্তিনিদের কি বাঁচার অধিকার নেই?’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি থাকে, তাহলে তা রক্ষায় আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে।’

প্রেসলি একটি আবেগী বক্তব্য রাখেন। তিনি প্রথমেই ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার’ আন্দোলনের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারের বিষয়টি যুক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর দখল ও নিপীড়ন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে আমরা চুপ করে অন্যায় সমর্থন করতে পারি না।’

ফিলিস্তিনি আমেরিকান রিপ্রেজেন্টেটিভ রাশিদা তলাইব-সহ আরও অনেকে বক্তব্য রাখেন। রাশিদা স্পষ্টভাবেই বক্তব্যের সারাংশটি তুলে ধরেন। তা হলো: ‘ফিলিস্তিনিরা অন্য কোথাও যাচ্ছেন না।’

আরও পড়তে পারেন-

তিনি ঠিকই বলেছেন। ফিলিস্তিন সেন্ট্রাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের তথ্যানুসারে, পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি; অন্যদিকে গাজায় আছেন আরও ২১ লাখ ফিলিস্তিনি। অ্যাসোসিয়েশন ফর সিভিল রাইটস ইন ইসরায়েলের মতে, জেরুজালেমে ফিলিস্তিনির সংখ্যা তিন লাখ ৫৮ হাজার।

তবে বাস্তবতা হলো, জনসংখ্যার দিক থেকে ৯০ লাখের বেশি ইসরায়েলি জনগোষ্ঠীও অন্য কোথাও যাবে না। এদের মধ্যে ৭০ লাখ ইহুদি। বৃহস্পতিবার প্রেসলি বিষয়টি যথাযথভাবে তুলে ধরে বলেন, ‘ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি জনগণের ভবিষ্যৎ একসূত্রে গাঁথা।’

তবে দুইপক্ষের ভাগ্য পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকার অর্থ এই নয় যে, উভয়পক্ষের মধ্যে সমতা বিরাজমান। সম্পদ, রাজনৈতিক ক্ষমতা কিংবা ভোগান্তি- কোনোদিক থেকেই দুই পক্ষ সমান নয়। উদাহরণস্বরূপ, গাজার ৯৫ শতাংশ অধিবাসীর কাছে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নেই। এখানকার ৮০ শতাংশ মানুষই বেঁচে থাকার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।

সম্প্রতি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২১৩ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটিতে তারা ইসরায়েল সরকারকে ‘বর্ণবাদী নীতিমালা ব্যবস্থাপনা’র দায়ে অভিযুক্ত করে। ইসরায়েল ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে ফিলিস্তিনিদের চেয়ে ইসরায়েলি ইহুদিরা অগ্রাধিকার পান বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। (জানুয়ারি মাসে ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা বি’টসেলেমও একই অভিযোগ তুলেছিল)।

নেতৃত্বকে বিবেচনায় আনলে বর্তমানে বড় ধরনের শান্তি চুক্তি এক কথায় অসম্ভব বলেই মনে হবে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা হামাসের পক্ষ থেকে কার সঙ্গে কথা বলবে? অন্যদিকে, ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পশ্চিম তীরের বিশাল অংশকে ইসরায়েলের অধীনে আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একইসঙ্গে সেখানে কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র থাকবে না বলেও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। সেক্ষেত্রে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের প্রসঙ্গ এলে শান্তি স্থাপনে কে তাদের সহযোগী হবে?

মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনার থেকেও বড় জিনিস হলো ফিলিস্তিনিদের ভুলে না যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার রক্ষার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের জন্য এখন বিষয়টি কেবলমাত্র বাস্তুচ্যুত হওয়া নয়। এরসঙ্গে রয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবরণ অনুযায়ী পশ্চিম তীর ও গাজার ফিলিস্তিনিদের কয়েক দশক ধরে বিস্তৃত নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন এবং চলাফেরার স্বাধীনতার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু তারচেয়েও বড় যেটি ফিলিস্তিনিদের জন্য আশঙ্কাজনক, তা হলো বাড়তে থাকা উগ্রপন্থী ইসরায়েলিদের সংখ্যা। উগ্র এই ইসরায়েলিরা রাস্তা দখল করে হুমকির সুরে ‘আরবদের মৃত্যু’ কামনা করছে।

যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে নিশ্চিত করতে হবে, ফিলিস্তিনিরাও যেন ইসরায়েলিদের মতো একই ধরনের নিরাপত্তা, সমতা ও আবাসভূমির নিশ্চয়তা পান। ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার অস্বীকৃতির অবসান ঘটাতে হবে। সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো- ইসরায়েল সরকারকে বার্ষিক অনুদান হিসেবে দেওয়া ৩.৮ বিলিয়ন অর্থ সাহায্যের বদলে বাইডেনকে বিশ্বজুড়ে আমেরিকার প্রভাবশালী ভূমিকা বিস্তারে সচেষ্ট হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নিরপেক্ষ এই প্রক্রিয়া হবে স্থায়ী ও ন্যায্য শান্তি চুক্তির ভিত্তি স্থাপনের লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ।


লেখক: আমেরিকান কমেডিয়ান, আইনজীবী ও সাংবাদিক।
সিএনএন থেকে অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।